• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২১, ১১:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৮, ২০২১, ০৩:৪৬ এএম

প্রেক্ষাপট হলি আর্টিজান হামলা

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান : আইএসআই ও ‍‍‘নাটেরগুরু’

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান : আইএসআই ও ‍‍‘নাটেরগুরু’

টানা তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে কয়টি ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ নির্মূলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হয়ে ওঠার পথ অবরুদ্ধ করা।

তৎকালীন জামাত-বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের যে ভয়াবহ ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল, তা বলিষ্ঠ হাতে নির্মূল করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অভেদ্য প্রাচীরের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বিশেষ করে দেশের মাটিতে জঙ্গিদের সশস্ত্র তাণ্ডব, হত্যা-নৈরাজ্য ও যুব সমাজকে শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে অপশিক্ষা ও ভ্রান্ত পথনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে যে অভিশপ্ত নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছিল তারেক-বাবর-হান্নান চক্র, তা ভেস্তে দিয়ে শাপিত আগামীর দুর্বিষহতা থেকে জাতিকে রক্ষায় কাণ্ডারি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

আইএসআই এজেন্ট তালিকায় তারেক জিয়া

কিন্তু এরই মাঝে অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা গোটা জাতির জন্য বিভীষিকাময় কালচিত্র হয়ে উঠেছে। এরমাঝে অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা হচ্ছে আজ থেকে ৫ বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর লেক পাড়ে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া দেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা। নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। সেই দিন রাত ৮টা ৫০মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি। পরদিন ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর দুঃসাহসী প্যারা কমান্ডো ইউনিট ও বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন শাখার চৌকস সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী ৫ জঙ্গি। 

যখনই ইতিহাসের এমন দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে, তখনই আলোচনায় আসে বাংলাদেশের বুকে জঙ্গিবাদের উত্থান, বিস্তার ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গি তৎপরতা ও সংঘটিত হামলার আলোচিত ঘটনাগুলো। আর এক্ষেত্রে বরাবরই আলোচনায় আসে এদেশের বুকে জঙ্গিবাদী অপশক্তির উত্থানে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সম্পৃক্ততা ও মদদ প্রদানের ইস্যুটি। যে সংস্থার তালিকাভুক্ত অন্যতম একজন সক্রিয় এজেন্ট হিসেবে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার মাস্টার মাইন্ড মেজর জিয়া পুত্র ও বর্তমানে রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম।

বাংলাদেশে ৯০ দশক থেকে যতবার জঙ্গি হামলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদন বা দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি পাকিস্তান দূতাবাসের সম্পৃক্ততার খবরও পাওয়া গেছে কয়েকবার। কিন্তু কোনোবারই দেশটির পক্ষ থেকে জোড়ালো কোনো প্রতিবাদ না আসায় এই প্রতিবেদনগুলোর সত্যতা অনেকাংশেই প্রমাণিত হয়।

খুব সহজ সমীকরণেও বিষয়টি বোঝা যায়। ভারতে যে কয়টি মৌলবাদি জঙ্গি গোষ্ঠী রয়েছে, এর সবকয়টির সঙ্গেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি বা পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থগুলো শুধু এ ধরনের অভিযোগ করেই থেমে থাকেনি। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এসব জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধানদের পাকিস্তানে অবাধে চলাফেলার ছবি ও প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। এতে খুব স্পষ্টভাবেই প্রমাণ হয়, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এই উপমহাদেশে অস্থিরতা বজায় রাখতে নানাভাবে এই জঙ্গি দলগুলোকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। আর পুরনো শত্রুতার জের ধরেই বাংলাদেশে যে তারা এ ধরনের হীন কার্যক্রম চালাচ্ছে না তা নিশ্চিত করে বলার উপায় একেবারেই নেই।

এ সকল হামলায় দেশের সরকারপ্রধান হতে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেটে পরিণত করা হয়। বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে কার্যকর। এছাড়া দেশের সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টাও করা হয় জঙ্গি হামলার মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে।

‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’- এই স্লোগানের মধ্য দিয়েই মূলত বাংলাদেশে মৌলবাদী সংগঠনের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯২ সালে। আফগানিস্তানের তালেবানদের হয়ে যুদ্ধে যাওয়া আফগান ফেরত কতিপয় ব্যক্তিই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রথম হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি)-নামে একটি দল গঠনের ঘোষণা দেয়। এই হুজির অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ- দুটোর পেছনেই কাজ করেছে আইএসআই। এর দুই বছর পরে টাঙ্গাইলের করটিয়ায় বায়েজিদ খান পন্নি ওরফে সেলিম পন্নির নেতৃত্বে ‘কোমরে হাতুরী’ সংগঠন হিজবুত তাওহীদ আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৯৮ সালে হুজি থেকে বেরিয়ে এসে শায়খ আব্দুর রহমান জামালপুরে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) গঠন করেন। শায়খ আব্দুর রহমানের পরামর্শে সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই- এর নেতৃত্বে জেএমবির আরেকটি অংশ জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজিবি) গঠন করে।

পরের বছর কাওসার হুসাইন সিদ্দিকী নামে একজন গড়ে তোলেন আরেকটি জঙ্গি সংগঠন শাহাদাত-ই আল হিকমা। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অংশ হিসেবে ২০০১ সালে ‘হিযবুত তাহরীর’ ও ২০০৭-০৮ সালে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ (এবিটি) বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে।

জামাত-বিএনপির শাসনামলে তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে জোর দাবি ওঠে যে, মূলত হাওয়া ভবনের অন্দর মহলে বসে দেয়া বিএনপি-জামাতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেই বাংলাদেশের বুকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ বিস্তারে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ২০২০ সালে এক গোপন নথির ভিত্তিতে আইএসআই-এর তালিকাভুক্ত গুপ্তচর হিসেবে বর্তমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়ার নাম পাওয়া গেলে এই দাবির সত্যতা সুস্পষ্টভাবেই জনসম্মুখে উপস্থাপিত হয়। (প্রকাশিত সংবাদ : আইএসআই এজেন্ট তালিকায় তারেক জিয়া, প্রকাশকাল : ১০ আগস্ট ২০২০  দৈনিক জাগরণ)।

বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে। হুজি প্রথম হামলা করেছিল কবি শামসুর রাহমানের উপর। তবে সেবার মার্চে বড় আকারে প্রথম বোমা হামলা হয় যশোরে উদীচী সম্মেলনে। এ হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১৫০ জনের বেশি আহত হয়। উদীচীর রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনা শহরে আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হয়।

২০০০ সালের ২২ জুলাই। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা হওয়ার কথা ছিল। সেই জনসভাকে সামনে রেখে হুজি নেতা মুফতি হান্নান ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে। তবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

২০০১ সালের শুরুতেই রাজধানীর পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন এবং পরে একজন হাসপাতালে মারা যান।  তিন মাস পার না হতেই রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। সেই বছরই জুনে গোপালগঞ্জের বানিয়াচং গির্জায় প্রার্থনা চলাকালে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন, আহত অর্ধশত।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাগেরহাটের মোল্লারহাটে খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক নির্বাচনি জনসভায় রিমোট কন্ট্রোল-নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ৮ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়। এই সব হামলাতেই হুজি সদস্যরা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে প্রকাশ এ ধরনের টেকনোলজি ও প্রশিক্ষণ উপমহাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে আইএসআই-ই দিয়ে থাকে।

এরপরে বছর খানেকের বিরতি। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক নির্বাচনি আলোচনা সভায় বোমা বিস্ফোরণে ৪ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। মাত্র দুইদিন পরে সাতক্ষীরা শহরের একটি সিনেমা হল ও স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা হামলায় ৩ জন নিহত ও আহত হয় অন্তত দেড়শ মানুষ।

ওই বছর বিজয়ের মাসের শুরুতে কামানের তোপের মতো আবারো গর্জে ওঠে বোমা। ময়মনসিংহ শহরে চারটি সিনেমা হলে (অজন্তা, ছায়াবাণী, অলকা ও পূরবী) দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর কয়েকটি বোমা হামলায় শিশু ও নারীসহ ১৮ জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়। এ হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদী হিসেবে লাইমলাইটে আসে জেমএমবি। জঙ্গি এই সংগঠনটির সঙ্গে আইএসআই-এর সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে তখনই।

২০০৩ সালে টাঙ্গাইলের সখীপুরের দরিয়াপুর গ্রামের ফালুচাঁন পাগলার মাজারে রাতে বোমা বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ ছাড়াও কয়েকটি স্থানে বোমা হামলা হয়, যার মধ্যে রয়েছে- খুলনায় বাণিজ্য মেলায় কর্তব্যরত পুলিশের উপর বোমা নিক্ষেপ, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বোমা বিস্ফোরণ, খুলনায় অ্যাডভোকেট মঞ্জুর ইমামের ওপর বোমা নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ এবং খুলনা বাস টার্মিনালে একটি পরিবহনের গাড়িতে বোমা হামলা। এ সব হামলায় মোট ৪ জন নিহত হয়।

সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকীকরণের ‘স্পিলওভার ইফেক্টে’ বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ ভয়াবহভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদেশে জঙ্গি হামলার ইতিহাসে প্রথম ভয়াবহ সময় ২০০৪-০৫ সাল। বোমা ও গ্রেনেড হামলার কারণে শুধু ২০০৪ সালেই শতাধিক লোক প্রাণ হারায়।

২০০৪ সালটা শুরু হয় জানুয়ারিতে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার প্রাঙ্গণে প্রথম দফা বোমা হামলা দিয়ে। এ হামলায় প্রাণ হারায় ৭ জন। এখানে দ্বিতীয়বার গ্রেনেড হামলা হয় ২১ মে। দুজন প্রাণঘাতী হুজির এ হামলায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীসহ আহত হন ৭০ জন। জানুয়ারিতে নিহত হন সাংবাদিক মানিক সাহা, ফেব্রুয়ারিতে হামলা হয় হুমায়ুন আজাদের উপর, জুনে হামলায় মারা যান সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, জুলাইয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জে বোমা হামলায় ৬ জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন। আগস্টে সিলেটে গুলশান হোটেলে গ্রেনেড বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয় এবং ডিসেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ইউনুস আলীকে হত্যা করা হয়।

২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহীর বাগমারায় ও নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর এলাকায় সর্বহারা দমনের নামে সিনেম্যাটিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাভাই-এর জেএমবি। বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের পলাশী গ্রামে মোনায়েম হোসেন বাবুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাই-এর তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। আট-নয় মাসের মধ্যে একে একে সে ২৪ জনকে হত্যা করে এবং তিন শতাধিক লোকের উপর বর্বর নির্যাতন চালায়। এই সংঘবদ্ধ গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ হামলায় ২৪ জন নিহত হয়, আহত হয় ৪শরও বেশি লোক।

বাংলাদেশে যাত্রা-সংস্কৃতির জন্য এক দুঃসময়ের বছরও এটি। পরপর তিন মাসে তিনটি যাত্রা প্রদর্শনীতে বোমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়।  নভেম্বরে মৌলভীবাজার, ডিসেম্বরে গাইবান্ধা ও জানুয়ারিতে বগুড়ায় হয়েছিল এ তিনটি হামলা।  সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- সিনেমা হলে, যাত্রামঞ্চে জেএমবির এ সব হামলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

২০০৫ সালে সেটি হলো আদালতের এজলাস ও এনজিও প্রতিষ্ঠানে বোমা হামলা। লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি ও গাজীপুরে বিভিন্ন আদালতে হামলায় বিচারক সোহেল আহমেদ চৌধুরী, বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও কয়েকজন আইনজীবীসহ নিহত হয় ১৮ জন, আহত হন ৯০ জনেরও বেশি। এ বছরে দুবার এনজিও ‘ব্র্যাক’ কার্যালয়ে হামলা হয়। গোপালগঞ্জ ও নওগাঁয় এ হামলায় আহত হয় পঞ্চাশ জনেরও বেশি।

সে বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলা। এ দিনে জেএমবি ৬৩টি জেলার ৫১১টি স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এতে ৩ জন নিহত ও ২ শতাধিক মানুষ আহত হয়। সে বছরই হবিগঞ্জে বোমা হামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত হন, আহত হন আরও ৫০ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ৮ জন, গাজীপুর ডিসি অফিসে বোমা হামলায় নিহত হয় ১ জন ও আহত হয় ৪৮ জন। নেত্রকোনায় উদীচী ও শতদল শিল্পগোষ্ঠীর অফিসে বোমা হামলায় নিহত হয় ৮ জন ও আহত হয় ১০০ জন।

দেশে জঙ্গি হামলা শুরুর ষষ্ঠ বছরের পর থেকে আমাদের শম্ভুক বোধোদয় হতে থাকে। জঙ্গিবাদ দমন ও জঙ্গিদের ধরপাকড়ে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে শাহাদাত-ই আল হিকমা, হুজি, জেএমজেবি, জেএমবি, হিযবুত তাহরীর ও এবিটি অন্যতম।
২০০৬ সালে সিলেটের টিলাগড় এলাকা থেকে হলিউড সিনেমার কায়দায় শায়খ রহমান (২ মার্চ), ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় (৬ মার্চ) বাংলা ভাই এবং  ১৯ মার্চ ডেমরা থেকে খালেদ সাইফুল্লাহ গ্রেপ্তার হয়। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইকে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালে জেএমবি কর্তৃক ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটর হায়দার হোসেনকে গুলি করে হত্যা এবং এর দুই বছর পরে গাজীপুরের পুলিশ সুপারের সম্মেলনে গ্রেনেড হামলা ছাড়া দীর্ঘদিন বড় ধরনের জঙ্গি নাশকতা দেখা যায়নি। তাই মানুষের মন থেকে জঙ্গিবাদ, বোমাতঙ্কও ধীরে ধীরে মুছতে থাকে।

পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই আজাদি-এর অস্ত্র-বোমা তৈরিতে প্রশিক্ষিত শেখ রহমত উল্লাহ মাসুম ২০১২ সালে জেএমবিকে সংগঠিত করেন বলে কথিত আছে। ১৯৯৯ সাল থেকে বিভিন্ন নামে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত (আইএসআইএল) আত্মপ্রকাশ করে ২০১৩ সালে। প্রথম দিকে ইরাক, সিরিয়া, লেভান্ত অঞ্চলে ইসলামি শাসন বিস্তারের ইচ্ছা থাকলেও পরে এ সংগঠন বিশ্বব্যাপী ইসলামি ‘খেলাফত’প্রতিষ্ঠার নেশায় বিভিন্ন দেশে রক্তের হোলি খেলা শুরু করে। পরের বছর এরা নিজেদেরকে ইসলামিক স্টেট (আইএসআই বা ডায়েশ) পরিচয় দিতে শুরু করে।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে এবিটি, জেএমবি, হুজিদের হত্যা মিশনে নতুন সংযোজন হলো, নাস্তিকতার ব্যাখ্যায় টার্গেট কিলিং একের পর এক তাদের হামলার শিকার হন আসিফ মহিউদ্দীন, রাজিব হায়দার, জগতজ্যোতী তালুকদার, সানাউল রহমান, আরিফ রায়হান দ্বীপ, উম্মুল মোমিনিন তৈয়ুবুর রহমান ও তার পুত্র, তন্ময় আহমেদ, জাকারিয়া বাবু ও পীর লুৎফর রহমানসহ ৬ জন।  এ ধরনের হামলা পরের বছরেও চলতে থাকে। এ বছর শিকার হন উল্লাহ দাস, রাকিব, টিভি উপস্থাপক শেখ নুরুল ইসলাম ফারুকী, আশরাফুল ইসলাম এবং সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ‘টার্গেট কিলিং’ হয় ২০১৫ সালে। একে একে হামলার শিকার হন চট্টগ্রামে নার্সিং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা অঞ্জনা দেবী, ব্লগ সাইট মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নীলয় নীল, শিক্ষক মানব চন্দ্র রায়, ইতালির নাগরিক তাবেলা, জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও, আধ্যাত্মিক নেতা খিজির খান, প্রকাশক আরেফিন ফয়সাল দীপন, শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুল, বাহাই সেন্টারের ডিরেক্টর রুহুল আমিন এবং ইসকনের প্রেসিডেন্ট বীরেন্দ্র নাথ। আগের বছরের মতো হত্যার অস্ত্র হিসেবে চাপাতি বহাল থাকল। তবে বেশ কয়েকটি হত্যার দায় স্বীকার করে আইএসআই।

ওই বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিয়া ও দ্বিতীয়বারের মতো আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়। অক্টোবরে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় নিহত হয় একজন, আহত অর্ধশতাধিক। পরের মাসে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন। ডিসেম্বরে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। একই মাসে দিনাজপুরে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে বোমা বিস্ফোরণে ১০ জনেরও বেশি আহত হয়। সব হামলাতেই আইএসআই ও জেএমবি উভয়ই দায় স্বীকার করে।

২০১৬ সালের শুরু থেকে একে একে যারা জঙ্গিবাদের শিকার হন, তারা হলেন- পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ, ঝিনাইদহে শিয়া ধর্ম প্রচারক আব্দুল রাজ্জাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ‘রূপবান’ পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস মান্নান,  নাট্য ও সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী মাহবুব তন্ময়, নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, রাজশাহীর তানোর উপজেলার ‘পীর সাহেব’মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বান্দরবানের বাইশারী ইউনিয়নের চাক পাড়ার বৌদ্ধ ভিক্ষু মংশৈ উ চাক, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জুতা ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিক, নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি, পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে, ঝিনাইদহের শ্যামানন্দ দাস ও বান্দরবানের মংশৈনু মারমা। এসব হত্যাকাণ্ডের কয়েকটিতে আনসার-আল-ইসলামের নাম এলেও অধিকাংশ হত্যার জন্য আইএসআই দায় স্বীকার করে।

উদীচী, রমনা, একুশে আগস্টের সংঘবদ্ধ জঙ্গি হামলা, ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলার পরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ঘটনার নাম গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা। এদেশে চোরাগোপ্তা, আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ইতিহাস থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের স্টাইলে জিম্মিকরণের মাধ্যমে এমন হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম। এই জিম্মি ঘটনায় ১৭ বিদেশিসহ (৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয়) ২০ জন, ৫ জঙ্গি ও এক সন্দেহভাজন এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হয়।

পুরো জাতিকে ট্রমাটাইজড করা এ হামলার রেশ কাটতে না কাটতে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের কাছে বিস্ফোরণ ও গুলির ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশসহ নিহতের সংখ্যা ৪। আহত হয় ১২ জন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশের সদস্য।

ইসলামি আইন, শরিয়াহ কায়েমের কথা বলে এদেশে যে জঙ্গি হামলার সূত্রপাত হয়েছে তা এখন সেই অবস্থানে নেই এবং কোনোদিন সেটা ছিলও না- এ সত্যটুকু বুঝতে প্রায় ২৫ বছর পার হয়ে গেল। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পরেও কি আমরা বিশ্বাস করব না যে, জঙ্গিবাদের কোনো ধর্ম কোনো দিন ছিল না, যেমন আজও নেই।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় একটি জঙ্গি হামলার নীল নকশা তৈরি করা হয়। যার সঙ্গে পাকিস্তানের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা এবং বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মদদের কথা উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের একটি স্বনামধন্য পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট। এই চক্রান্তের যৌথ সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয় লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপি নেতা ও দুর্নীতি মামলায় কারাবদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান এবং ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের কথা। যেখানে দৃঢ়ভাবেই উঠে এসেছে পাক গোয়েন্দা সংস্থাটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠনকে অর্থ সহযোগিতা প্রদানের তথ্য।
 

এসকে/আরআইএস