লেখক || রেজাউল করিম সহযোগী অধ্যাপক • ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।
একশত বছর ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হলেও প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট নয়। এই একশত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনও কম নয়, ব্যর্থতাও কম নয়। তার বড় অবদান বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকাশে তার রয়েছে অনন্য অবদান। বিংশ শতকের ষাটের দশক ছিল তার যৌবনকাল। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তার ত্যাগ, আদর্শ, মহিমা, শৌর্য-বীর্য ছিল গৌরব করার মতো। ১৯৭১ সালের পর থেকে তার গৌরব ম্রিয়মান হতে থাকে। আজ গৌরব করার মত তার কিছু আছে বলে মনে হয় না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকে মুক্তচিন্তার ওপর (A university stands on freethinking) আর ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে বিশ্বাসের ওপর (Religion or religious institution stands on believing)। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বাসের জায়গা নয়, জ্ঞান চর্চার জায়গা, নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ ও গবেষণার জায়গা; সন্দেহ, বিতর্ক ও জিজ্ঞাসার জায়গা; মুক্তচিন্তার জায়গা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন মুক্তচিন্তা ধরে রাখতে পেরেছিল ততদিন তার গৌরব, মহিমা, ত্যাগ, আদর্শ সবই ছিল। মানুষ বিকশিত হয় দুটি কারণে। এক-বংশগতি (Heredity), দুই-পরিবেশ (Environment)। অনুকূল পরিবেশ না পেলে মেধার বিকাশ হয় না। ধরুণ, ভারতের চলচিত্র জগতের আমির খান, সালমান খান, শাহরুখ খানের কথা। তাঁরা ভারতের তথা পৃথিবীখ্যাত নায়ক। কিন্তু তাঁরা যদি আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের নাগরিক হতেন, তাহলে তারা কি এতবড় নায়ক হতে পারতেন? পারতেন না। কারণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতে যে উদার পরিবেশ রয়েছে, তা মুসলিম দেশে নেই। পরিবেশ একটা বিরাট ব্যাপার। পরিবেশ পেলে কেউ না কেউ বিকশিত হবেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশে কি সে পরিবেশ আছে? ইউরোপ-আমেরিকায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কারণ সেখানে সেই পরিবেশ আছে।
রেনেসাঁর পর ইউরোপে মুক্তচিন্তার প্রভাবে যেভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, সাহিত্যের বিকাশ হয়, তা কল্পনাতীত। ইংল্যান্ডে ১৬৬০ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ৯৭০টি প্রযুক্তি নিবন্ধন লাভ করে। ১৬৬০ থেকে ১৭২৯ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত হয় ২৭০টি। ১৭৩০ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত হয় ৭০০টি। এভাবে আবিষ্কারের হিড়িক লেগে গেল। কেউ সুতা কাটার কল আবিষ্কার করে, কেউ বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করে, কেউ খনিতে কাজ করার যন্ত্র আবিষ্কার করে, কেউ ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করে, কেউ আমেরিকা আবিষ্কার করে। রেনেসাঁ তাদেরকে এমনভাবে তাড়া করল যে, তারা অদেখাকে দেখার জন্য, অচেনাকে চেনার জন্য, অজানাকে জানার জন্য, অসাধ্যকে সাধন করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। রেনেসাঁ বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইউরোপীয়ানদের একটা চেতনা ও পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয় যার ওপর ভিত্তি করে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ইউরোপ যতদিন বিশ্বাস ও পোপতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল ততদিন তারা অন্ধকারেই ছিল। রেনেসাঁই তাদেরকে আলোর পথ দেখায়। সে আলোই সারা বিশ্বে কম বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রেনেসাঁর ছড়িয়ে পড়া ছিঁটে ফোঁটা আলোর বিচ্ছুরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর ছিল ছাত্র ৭৭৬, ছাত্রী ১ জন (লীলানাগ), শিক্ষক ৬০ জন, অনুষদ তিনটি (কলা, বিজ্ঞান, আইন), বিভাগ ১২টি এবং ৩টি আবাসিক হল । বর্তমানে এর অনুষদ ১৩টি, বিভাগ ৮৩টি, ইনস্টিটিউট ১২টি, হল ২০টি, ছাত্র-ছাত্রী ৩৭ হাজার এবং শিক্ষক ১৯৯২ জন। এর সবকিছু কোয়ানটিটিতে বাড়ছে, কোয়ালিটিতে নয়। কোয়ালিটি বরং হ্রাস পেয়েছে। ব্রিটিশ আমলে, এমনকি পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানের ছাত্র-শিক্ষক ছিল তাতে এর পরিচিতি পায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন বোস বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্র সংশোধন করে দেন। যার জন্য সে থিওরির নাম হয় বোস-আইনস্টাইন থিওরি। তখন অনেক প্রখ্যাত শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের পরেও ছিলেন। কিন্তু এখন আর নেই। এখন যারা বিখ্যাত আছেন তাঁরা সবাই অবসরপ্রাপ্ত, কেউ এমিরেটাস।
মানুষের অধিকার আদায়ে, আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ভুলবার নয়। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে ভাষা আন্দোলনের পূর্বে বাংলার রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না। ১৯৪৬ সালে বাংলায় এত বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো, ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা খণ্ডিত হল, খণ্ডিত পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যোগ দিল -এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা তার ছাত্র-শিক্ষকদের কোনো সুচিন্তিত মতামত দেখি না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারাও তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত ছিলেন না, ছিলেন সাম্প্রদায়িক হর্ষে বিমোহিত। পাকিস্তানে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই তাদের হর্ষ যখন বিষাদে রূপান্তরিত হলো, তখন তাদের ঘুম ভাঙ্গল। এ পাকিস্তান দিয়ে বাঙালির কোনো কাজ হবে না। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চাই। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডও সুখকর নয়। ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতিতে বিভক্ত, হল দখল, সিট দখল, পাল্টা দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়কে ম্লান করে দিচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ গবেষণার চেয়ে অর্থ উপার্জনে বেশি মনোযোগী। মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকদের বিরাট অংশ উর্দি পরা সামরিক শাসকের দল করে, তার নামে স্লোগান দেয়। তা-ও আবার সেই সামরিক শাসক যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূলনীতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। যে চেতনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেও রক্ত দিয়েছে। তার ১৭ জন খ্যাতনামা শিক্ষক, ১০১ জন ছাত্র, ১ জন কর্মকর্তা, ২৮ জন কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এ ছাড়াও শহীদদের তালিকায় আছেন গুরু দুয়ারা নানকশাহী, শিব ও রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিত ও ভক্তবৃন্দ, অতিথি, হল-ক্যান্টিনের বয় বেয়ারা প্রমুখ। ১৯৫ জনের তালিকা পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর বাইরেও আছেন নাম না জানা অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ভরপুর ছিল। টিএসসি, কলাভবন, চারুকলা, শাহবাগ, শহিদ মিনার, দোয়েল চত্বর, ডিপার্টমেন্ট এবং হলগুলোতে কোনো কোনো অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রভৃতি লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে মনে হতো কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা শুনি বা দেখি। সেগুলো এখন কমে গেছে, এমনকি নেই বললেই চলে। টিএসসি সড়ক দ্বীপে ডাসের দুই পাশে অনেকগুলো উন্মুক্ত পানির কল ছিল। মানুষ সেখানে হাত-মুখ ধৌত করত, পানি পান করত। এখন সেখানে সে সুযোগ নেই। পানির কলগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। আমরা কথায় কথায় ব্রিটিশদের গাল মন্দ করি কিন্তু তাদের আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে আদর্শ, জ্ঞান-গরিমা, গবেষণা, নীতি-নৈতিকতা, সেবার মনোভাব ছিল, এখন কি তা আছে?
সমাজ যখন বিশ্বাসে ভরপুর তখন সেখানে ভিন্নমত পোষণ করা যায় না; ভিন্ন কিছু আশাও করা যায় না। যেখানে প্রশ্ন করার, সন্দেহ করার স্বাধীনতা নেই, মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই, সেখানে সৃষ্টি হবে কিভাবে? নতুনত্ব আসবে কিভাবে? সন্দেহ হচ্ছে জ্ঞান-প্রজ্ঞার মূলমন্ত্র (Doubt is the origin of wisdom), বলেছেন মহাজ্ঞানী রেনে দেকার্তে। বিশ্বাস অজ্ঞতা ও অন্ধকারের জননী। আমাদের জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ বিশ্বাসের দিকে ঝড়ের বেগে ধাবিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ রাষ্ট্রের বাইরে নয়। সুতরাং, সে আর আগের গৌরব ধরে রাখতে পারছে না। তারপরেও তার কাছে প্রত্যাশা, সে যেন তার পূর্ব গৌরবে, পূর্ণ যৌবনে প্রত্যাবর্তন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও বাঙালি ও বাংলাদেশের আলোর দিশারী। তার দুয়ার হওয়া উচিত উন্মুক্ত ও উন্নত সংস্কৃতির বলয়। যেখান থেকে মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা শিখবে; মনুষত্ব, মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানালোক ধারণ করবে এবং তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিবে।
দ্রষ্টব্যঃ- প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।