• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১, ০৬:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১, ০৬:১৭ এএম

কেন বৃথা তর্ক, কেন বাক্য ক্ষয়

কেন বৃথা তর্ক, কেন বাক্য ক্ষয়
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

একটা অপ্রয়োজনীয় এবং যুক্তিহীন বিষয় নিয়ে কথা চালাচালি কেন হচ্ছে সেটা আমার বোধগম্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিন যে কথাটি বলেছিলেন এবং যে প্রসঙ্গে বলেছিলেন সেটার মর্মার্থ অনুধাবন না করেই দু’পক্ষই তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল- সেটা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে মেতেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ওখানেই তো শাহ্‌ আজিজুর রহমান যে স্বাধীনতা বিরোধীদের মোড়ল বলে ইতিহাসে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। ওখানেই, ওই সংসদ ভবন এলাকায় খান সবুর খানের মতো রাজাকার শিরোমণিকে কবর দেয়া হয়েছে, মশিউর রহমানের কবরও রয়েছে ওখানেই। তমিজুদ্দিন খানেরও বটে।  

চন্দ্রিমা উদ্যানে একটি সমাধিতে বিএনপি ফুল দেয়ার নামে একটা সমাবেশের আয়োজন করেছিলো আর করোনায় সমাবেশ বিধি না মানার কারণে পুলিশি ব্যবস্থা নিয়েছিল সরকার। এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে, বিএনপির পক্ষের লোকজন নানা রকম মন্তব্যও করেছেন আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী-কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ওখানে যে সমাধিক্ষেত্র আছে- তাতে জিয়ার লাশ আছে কি নেই- তাই নিয়ে। আমার ধারণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জিয়ার লাশের অস্তিত্ব নিয়ে বলার পেছনের কথাটি ছিল অন্য। বিশ্বনন্দিত স্থাপত্যশৈলী লুই ক্যানের অনন্য সৃষ্টি সংসদ ভবন এবং এর সংলগ্ন এলাকায় এমন কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে যা মূল নকশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ অত্যন্ত নির্দয়ভাবে কিছু দুষ্কর্ম তো করাই হয়েছে। ওখানেই তো শাহ্‌ আজিজুর রহমান যে স্বাধীনতা বিরোধীদের মোড়ল বলে ইতিহাসে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। ওখানেই, ওই সংসদ ভবন এলাকায় খান সবুর খানের মতো রাজাকার শিরোমণিকে কবর দেয়া হয়েছে, মশিউর রহমানের কবরও রয়েছে ওখানেই। তমিজুদ্দিন খানেরও বটে।  

এবার আমি চন্দ্রিমা উদ্যানের ওই কথিত জিয়ার কবরের বিষয়টিকে  নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমার অবশ্য বাস্তবে ওই জায়গাটি দেখা হয়নি, তবে ছবিতে যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে যথেষ্ট সুন্দর নির্মাণশৈলীই হবে। বিষয়টি সেটা নয়। যে প্রসঙ্গ নিয়ে তর্কটা জমে উঠেছে- তা হলো  ওই সৌধটিতে জিয়ার মৃতদেহটি কি আদৌ আছে, না নেই। মির্জা ফখরুল যখন বলেন এস. এ. বারির পিএস হিসেবে তিনি লাশটা স্বচক্ষে দেখেছেন তখন তার সেই বক্তব্যধরনে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে। যদি আমরা সেই সময়টাতে ফিরে যাই, তাহলে কেমন হয় চিত্রটা?

ফুলে-পতাকায় আস্বাদিত হয়ে গেলো কফিনটি। কিন্ত লাশের মুখ কেউই দেখলেন না। জিয়ার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে মন্ত্রী, নেতা-কর্মী কেউই না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যে দাবি করলেন তিনি লাশ দেখেছেন, সে কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? কফিন দেখা আর লাশ দেখা কি এক কথা? 

১৯৮১ সালের ৩০ মে, সকাল। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ক্ষতবিক্ষত-বিকৃত লাশটি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের দোতলার চত্বরে পড়ে আছে। একেবারে অরক্ষিত। ঘটনাটি ঘটে গিয়েছিলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই। লে. কর্নেল মতি আর তার দল ঘটিয়ে ফেলেছিল ঘটনাটি। দোতলার ৪ নং ঘরের সামনের চত্বরে। গুলি ছুড়েছিল কর্নেল মতি। গুলির পর গুলি। পেটে, বুকে। লুটিয়ে পড়া জিয়ার সর্বাঙ্গ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কিন্ত মতি থামছে না। এলএমজির বাট দিয়ে জিয়ার মুখটি সে ঘুরিয়ে নিলো। তারপর আবার গুলি। চোখে, মুখে, মাথায়। মাথার একটি অংশ উড়ে গেলো গুলির ঘায়ে। ছিন্নভিন্ন হয়ে মাংসের দলার মতো হয়ে গেলো শরীরটা। এলএমজি’র সব গুলি ফুরিয়ে যাবার পর নিরস্ত হলো কর্নেল মতি। কিন্ত ততক্ষণে মানুষটাকে চেনার কোনও উপায়ই নেই।

সকাল সাড়ে আটটা। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তখন জনমনিষ্যি নেই। ভেতরে পড়ে আছে তিনটি লাশ। লেফটেনেন্ট কর্নেল আহসান, ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং জিয়া। মেজর মজাফফর এবং মেজর শওকতের আগমন ঘটলো ঘটনাস্থলে। জিয়ার সেই ছিন্নভিন্ন শরীরটাকে বোধহয় কেউ একজন বিছানার সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো। মজাফফর এবং শওকত লাশ তিনটিকেই তুললো একটি সামরিক ভ্যানে। তারপর সেটি চলল কাপ্তাই রোড ধরে। উদ্দেশ্য রাঙ্গুনিয়ার কাছাকাছি কোনও একটা জায়গায় লাশ তিনটি কবরস্থ করা।

আসল যে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো- লুই ক্যানের স্থাপত্যশৈলীকে এর মৌলিক আদলে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য নির্মমতা প্রয়োজন হলেও মানতে হবে। সংসদ এলাকা তো গোরস্থানে রূপান্তরিত করা উচিৎ নয়।

৩০ মে সকাল নয়টা থেকে দশটার মধ্যে কোনও একটা সময়। সে সময় রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র, নাম তার মোহম্মদ বশির- তার চোখে পড়ে একটা সামরিক ভ্যান হঠাৎ ওই কলেজ প্রাঙ্গণে একটুখানি দাঁড়িয়েছে। তারপর ওখান থেকে সোজা স্থানীয় বাজারের দিকে যায় এবং কয়েকজন কুলিকে ভ্যানে ওঠায়। চকিতে বশিরের চোখে পড়ে কাপড়ে ঢাকা কয়েকটা মৃত দেহের দিকে। সে একটু কৌতূহলী হয়ে সেদিকে তাকাতেই এক সেনা সদস্যের প্রচণ্ড ধমক খায়। সেই ধমকানি তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দেয়। সামরিক ভ্যানের মধ্যে কী এমন ছিল? কেন সেনা প্রহরীরা এতো উত্তেজিত হয়ে পড়লো? কেন কয়েকজন কুলিকে ওঠানো হলো ওই লাশের ভ্যানে? এদের গন্তব্য এই জঙ্গলেই বা কেন? এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটি ঘুরপথ দিয়ে একটি ছোট্ট টিলার ওপরে উঠলো যেখান থেকে আঁকাবাঁকা ওই সড়কে চলাচল করাটা চোখে পড়ে। চারদিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই হঠাৎ তার নজরে পড়লো সামরিক ভ্যানটি। পাথরঘাঁটা নামক একটি জায়গায় থেমে আছে। আর অদূরে কুলিরা কয়েক জন মাটি  খুঁড়ছে। নিজেকে আড়াল করে বশির রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে রইলো কি হয় শেষ পর্যন্ত তা দেখার জন্যে। সাদা কাপড়ে মোড়া লাশগুলো নামানো হলো, পাশের কোনও এক মাজারের ইমামকে ডেকে জানাজার সংক্ষিপ্ত আয়োজন করে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়া হলো। তারপর একজন সেনা প্রহরীকে ওখানে রেখে ভ্যানটি ওই স্থান পরিত্যাগ করলো। বশির এই সব দেখে এক সময় ঘরে ফিরল। পর দিন সে খবর পেলো, চট্টগ্রামের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে, বিদ্রোহীরা চলে গেছে। এই খবর শুনে সে তাড়াতাড়ি ছুটল সেই জঙ্গলা জায়গায় যেখানে তিনটি লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো। আশেপাশে ওই প্রহরীকেও দেখা গেলো না। সম্ভবত সে সটকে  পড়েছে। বশির সেখান থেকে সোজা চলে গেলো রাঙ্গুনিয়া থানায় এবং তার দেখা ঘটনাগুলোর বর্ণনা করলো। এরপরই ঘটনাটি জানাজানি হলো, নানান কাহিনীর জন্ম হলো। আর সে প্রসঙ্গে না যাই। তবে এ কথা সত্য যে, ভ্যানটির মধ্যে একটা লাশ কফিনবদ্ধ করে নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা করা হয়েছিলো। বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় আনা হয়েছিলো, অনেক রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পাদিত হয়েছিলো- এমনকি সাদা কাফনমোড়া লাশটি একটা স্বচ্ছ কফিনে রাখাও হয়েছিলো। ফুলে-পতাকায় আস্বাদিত হয়ে গেলো কফিনটি। কিন্ত লাশের মুখ কেউই দেখলেন না। জিয়ার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে মন্ত্রী, নেতা-কর্মী কেউই না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যে দাবি করলেন তিনি লাশ দেখেছেন, সে কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? কফিন দেখা আর লাশ দেখা কি এক কথা? 

কাজেই এই নিয়ে বিতর্ক বৃথা, বাক্যক্ষয় মাত্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথাচ্ছলে বলেছেন হয়তো যে ওখানে আদৌ জিয়ার লাশ দাফন করা হয়েছে, না কি, না। তা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে, তবে সেটা নিয়ে এতো কথার কি কোনও দরকার আছে? আসল যে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো- লুই ক্যানের স্থাপত্যশৈলীকে এর মৌলিক আদলে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য নির্মমতা প্রয়োজন হলেও মানতে হবে। সংসদ এলাকা তো গোরস্থানে রূপান্তরিত করা উচিৎ নয়। একবার সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু লেকের ওপরে নির্মিত সেতুটি তুলে দিয়েছিলেন বলে বিএনপি-জামাত প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত মঞ্জু সাহেব বাধ্য হয়েছিলেন সেতুটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। পরে জামাত-বিএনপি জোট ক্ষমতা দখল করে সেতুটি অধিকতর সুদৃশ্য করে গড়ে রাখলো। এভাবেই লুই ক্যানের স্বপ্নসৌধ লুঠ করা হয়েছে।

কাজেই অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক পরিহার করে মূল শেকড়ে ফেরৎ যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। মাটির নিচে কি আছে বা কে আছে- তা নিয়ে মাথা না ঘামানোই উচিৎ হবে। আর ওই কাঁচের কফিনের ভেতরে রাখা সাদা কাপড়ে মোড়া লাশটির চেহারা কেউ যখন দেখেনি তখন ওখানে কি আছে কিংবা কে আছে বা নেই- তা নিয়ে এতো কোলাহল কেন?

    

লেখক ● সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ  

জাগরণ/এসকেএইচ 

আরও পড়ুন