• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১, ১২:০৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১, ০৬:০৬ এএম

পর্ব তিনঃ

নারীর সম-অধিকারে ধার্মিকদের এত আপত্তি কেন?

নারীর সম-অধিকারে ধার্মিকদের এত আপত্তি কেন?
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

হিন্দু ধর্মীয় আইন-প্রথা সংস্কারে ব্রিটিশরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন- এতে কোনও সন্দেহ নেই। মুসলিম ধর্মীয় আইন সংস্কারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও বেশ ভূমিকা রেখেছেন। আইয়ুব খান ১৯৬১ সালের ৭ অক্টোবর মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের লক্ষ্যে ৮ নং অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন- যা ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন নামে পরিচিত। এই সংস্কার আইনটি একটি মুসলিম দেশের জন্য ছিল বৈপ্লবিক ঘটনা। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশও আইনটি বহাল রেখেছে। এই সংস্কার আইনটিতে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

১. মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে লা-ওয়ারিশ বিধান মতে, দাদা বেঁচে থাকতে পিতা মারা গেলে মৃত পিতার পুত্র/কন্যা অর্থাৎ দাদার নাতি-নাতনিরা সম্পত্তি পেত না। দাদার সম্পত্তির মালিক হতো চাচারা। এতিমের করুণ পরিণতি। একদিকে পিতার মৃত্যু, অন্যদিকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চনা। বিষয়টি আইয়ুব খানের মতো একজন স্বৈর- শাসককেও বিচলিত করে। কিন্তু ধার্মিকদের করেনি। আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন করার সময় লা-ওয়ারিশ বিধান বাতিল করে এতিমদের দাদার সম্পত্তিতে পিতার অংশের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেন। ১৯৬১ সালের পর থেকে দাদা জীবিত থাকতে পিতা মারা গেলেও নাতি-নাতনিরা বা মৃত পিতার সন্তানেরা সম্পত্তির (পিতা জীবিত থাকলে যেটুকু পেতেন সেটুকুর) মালিক হতে পারছে।

২. ইসলামি বিধান মতে, তিন তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রী তালাক হয়ে যায়। আগে মুসলিম সমাজে অহরহ এই ঘটনা ঘটতো। মানুষ ছিল অশিক্ষিত, অভাবী। মাথা এমনিতেই গরম থাকত। রাগের বশত তিন তালাক উচ্চারণ করে ফেলত। তিন তালাক একবার উচ্চারণ করলেই রক্ষা নেই। বউ তালাক হয়ে যায়। মাথা ঠাণ্ডা হলে রাগ কমলে লোকটি ভুল বুঝতে পারে। সে তার ওই স্ত্রীকে নিয়ে আবার সংসার করতে চায়। কিন্ত চাইলেই পারা যায় না। সামনে আছে ধর্মীয় বিধান। তাকে ওই স্ত্রীকে পেতে হলে পুনরায় বিয়ে করতে হবে। শুধুই বিয়ে নয়; হিল্লাহ বিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ ওই মহিলাকে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিতে হবে। ওই নতুন স্বামী তাকে তালাক দিলে পুরাতন স্বামী পুনরায় তাকে বিয়ে করতে পারবে। (কুরআন ২ঃ২২৯, ২৩০)।  আইয়ুব খান তিন তালাক ও হিল্লাহ বিয়েকে বাতিল করে আইন প্রণয়ন করেন।

৩. ইসলামি বিধান মতে একজন পুরুষ ৪ টি বিয়ে করতে পারেন এবং ৪ জন স্ত্রী বর্তমান রাখতে পারেন। কোনও স্ত্রীর মৃত্যু বা তালাক হলে তদস্থলে আরেকটি বিয়ে করতে পারেন। আইয়ুব খান বহুবিবাহকে আইনের শর্ত আরোপ করে নিয়ন্ত্রণ করেন। শর্ত হলো- পুরুষ পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের অনুমতি লাগবে, নচেৎ জেল, জরিমানা ভোগ করতে হবে।

৪. প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌখিক তালাকের পরিবর্তে লিখিত তালাকের বিধান করেন। তালাক প্রদানকারীকে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন বা পৌরসভার চেয়ারম্যানের নিকট তালাক প্রদানের কথা চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেব দুই পক্ষকে নিয়ে বসবেন, আপোসের চেষ্টা করবেন। আপোসে রাজি না হলে তালাক হতে বাধা নেই। কোন সময়ে, কোন প্রেক্ষিতে তালাক হচ্ছে- তা বুঝে স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানের বিধান করেন।

৫.ইসলামি মতে, দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে নর-নারীর বিয়ে বৈধ। আইয়ুব খান অলিখিতি বিয়ে অকার্যকর করে বিয়েতে রেজিস্ট্রি-প্রথা চালু করেন। বাল্যবিবাহ রোধ করতে কনের বয়স কমপক্ষে ১৮ এবং বরের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর নির্ধারণ করেন।

সব দেব-দেবী, নবি-রাসুল, অবতার জন্ম নেন মায়ের উদরে, লালিত-পালিত হন মায়ের কোলে, জীবন ধারণ করেন মাতৃদুগ্ধে। তাঁরাই বড় হয়ে মাকে (নারীকে) রাখেন অবদমিত করে, দাসী-বান্দী ও করুণার পাত্র করে। ধর্মশাস্ত্র ও দেশের আইন অনুযায়ী সন্তানের মালিক পিতা, মাতা নয়। মায়ের অধিকার সন্তান গর্ভধারণ, জন্মদান, দুগ্ধদান ও লালন-পালন এই পর্যন্তই। সন্তান যেই বড় হবে অমনি পিতা মালিক হবে। আহ! কী ন্যায় বিধান!

আইয়ুব খান যখন ইসলামি ধর্মীয় আইন সংস্কার ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন করেন তখনও মৌলবাদী মোল্লারা বসে থাকেননি। তারাও আন্দোলন সংগ্রাম করেন। তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, আইয়ুব খান কি আল্লাহর চেয়ে বেশি বুঝে? আইয়ুব খান সামরিক শাসক। তিনি মোল্লাদের কাছে মাথা নত করেননি। একনায়ক যদি জ্ঞানদীপ্ত বা আলোকিত হন, এর চেয়ে মহান শাসক আর কেউ হতে পারেন না। গণতান্ত্রিক সরকার দুর্বল সরকার। সে সব সময় মৌলবাদিদের ভয়ে ভীত থাকে। আইয়ুব খান মোল্লাদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে, ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালে ৮ নং অধ্যাদেশ জারি করে যেই মুসলিম পারিবারিক আইন করেন- তা খুবই যুগান্তকারী এক ঘটনা। আইয়ুব খানের পরে বহু সামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে, কিন্তু তাঁর মতো ওই রকম যুগান্তকারী, বৈপ্লবিক আইন কেউ করতে পারেননি। বরং তারা মোল্লাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

পুরুষের একক বীজে সন্তান হয় না। সঙ্গে নারীর বীজও লাগে। নারী বীজেরও অর্ধেক অধিকারী এবং ক্ষেত্রের পুরো অধিকারী। তাই মায়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচয় হওয়া উচিত।

সন্তান উৎপাদন, লালন ও পালনে মায়ের যে ভূমিকা- তাতে পরিবার হওয়া উচিত মাতৃতান্ত্রিক। কেননা সন্তান উৎপাদন, লালন-পালন ও দুগ্ধদানে মায়ের ভূমিকাই মুখ্য। ব্রাহ্মণদের মানবশাস্ত্র মনুসংহিতায় আছে, নারী শস্য ক্ষেত্রস্বরূপ, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। (মনুসংহিতা ৯/৩৩)। কুরআনেও অনুরূপ কথা আছে, নারী পুরুষের শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে খুশি সেভাবে সেথায় গমণ কর। (কুরআন ২/২২৩)। পুরুষ বীজস্বরূপ, নারী শস্যক্ষেত্রস্বরূপ মেনে নিলেও তো নারীই শ্রেষ্ঠ হয়, বেশি মূল্যবান হয়। কারণ বীজের চেয়ে জমির মূল্য অনেক বেশি। মনুসংহিতায় আরো আছে, বীজ ও ক্ষেতের মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ। (মনুসংহিতা ৯/৩৫)। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হতো পুরুষের শুক্রানু হলো বীজ আর নারীর ডিম্বাশয় বা জরায়ু হলো ক্ষেত্র। বিজ্ঞানের ভাষায় বীজের অধিকারী শুধু পুরুষ নয়, নারীও। সন্তান উৎপাদনের জন্য দরকার XY বা XX ক্রোমোজম। পুরুষের থাকে XY ক্রোমোজম, নারীর থাকে XX ক্রোমোজম। পুরুষের Y ক্রোমোজম + নারীর X ক্রোমোজম= পুত্র সন্তান। পুরুষের X ক্রোমোজম +নারীর X ক্রোমোজম= কন্যা সন্তান। পুরুষের একক বীজে সন্তান হয় না। সঙ্গে নারীর বীজও লাগে। নারী বীজেরও অর্ধেক অধিকারী এবং ক্ষেত্রের পুরো অধিকারী। তাই মায়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচয় হওয়া উচিত। সমাজে একটা ভুল ধারণা আছে, কন্যা সন্তান প্রসবের জন্য স্ত্রীকে দায়ী করা হয়। শুধু দায়ী নয়, তাকে বকাবকি করা হয়, মারপিট করা হয়, তালাকও দেয়া হয়। এমনিতেই কন্যা সন্তান প্রসবের জন্য মা হীনমন্যতায় ভুগে, তারপর আবার তার ওপরে চলে নির্যাতন। বিষয়টি অমানবিক। অথচ, স্ত্রী বা নারী এর জন্য দায়ী নয়। দায়ী যদি কেউ হয়, তাহলে সে হবে পুরুষ। কেননা পুরুষের থাকে XY ক্রোমোজম। পুরুষ Y ক্রোমোজম প্রেরণ করলে ছেলে হবে। আর X ক্রোমোজম প্রেরণ করলে মেয়ে হবে। মূলত ছেলে-মেয়ে হওয়ার জন্য কেউই দায়ী নন। পুরুষ ইচ্ছা করলেও তো X বা Y ক্রোমোজম সিলেক্ট করে প্রেরণ করতে পারছে না। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান যদি এর সমাধা দেয়, সেটা হবে ভিন্ন কথা। যাহোক, নারীপুরুষের সমান অধিকার থাকলে মেয়ে নিয়ে মানুষের এত দুশ্চিন্তা থাকত না।

প্রকৃতিতে মায়ের পরিচয়ই মুখ্য। যেমন মাছ, পশু, পাখি, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি। এদের পিতার পরিচয় কোথায়? মানুষও এক সময়ে মাতার পরিচয়ে পরিচিত হতো যখন  ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। ধীরে ধীরে পেশি শক্তির জয় হতে থাকে, মাতৃতান্ত্রিক পরিবার পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে রূপান্তরিত হতে থাকে। আর ধর্মগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিভূ বনে যায়। সব দেব-দেবী, নবি-রাসুল, অবতার জন্ম নেন মায়ের উদরে, লালিত-পালিত হন মায়ের কোলে, জীবন ধারণ করেন মাতৃদুগ্ধে। তাঁরাই বড় হয়ে মাকে (নারীকে) রাখেন অবদমিত করে, দাসী-বান্দী ও করুণার পাত্র করে। ধর্মশাস্ত্র ও দেশের আইন অনুযায়ী সন্তানের মালিক পিতা, মাতা নয়। মায়ের অধিকার সন্তান গর্ভধারণ, জন্মদান, দুগ্ধদান ও লালন-পালন এই পর্যন্তই। সন্তান যেই বড় হবে অমনি পিতা মালিক হবে। আহ! কী ন্যায় বিধান!

ধর্মীয় বিধান ও বৈষম্যের কারণেই মানুষ পুত্র সন্তান কামনা করে, পছন্দ করে এবং তাকে অগ্রাধিকার দেয়। তাই সম্পত্তিতে নারীপুরুষের সম-অধিকার দেয়া হলে পুত্রের জন্য ব্যাকুলতা কমবে।

নারী পুরুষের বৈষম্যের কারণে মানুষ পুত্র সন্তান কামনা করে। কন্যা সন্তান হলে নাখোশ হয়, হীনমন্যতায় ভোগে। কে ভিটায় বংশের বাতি জ্বালাবে? কন্যা তো সম্পত্তি ধরে রাখতে পারবে না। কেননা কন্যা তো সম্পত্তির পূর্ণ মালিক হতে পারে না। ইসলামি মতে, পুত্র ব্যতীত এক কন্যা থাকলে সে পৈত্রিক সম্পত্তির অর্ধাংশ পাবে, বাকি অর্ধেক শরিকরা পাবে। পুত্র ব্যতীত একাধিক কন্যা থাকলে পাবে দুই তৃতীয়াংশ। হিন্দু মতে, কারো পুত্র ব্যতীত শুধু কন্যা থাকলে তারা মালিক হতে পারে না। কন্যার পুত্র হলে সে পুত্র মালিক হবে। ধর্মীয় বিধান ও বৈষম্যের কারণেই মানুষ পুত্র সন্তান কামনা করে, পছন্দ করে এবং তাকে অগ্রাধিকার দেয়। তাই সম্পত্তিতে নারীপুরুষের সম-অধিকার দেয়া হলে পুত্রের জন্য ব্যাকুলতা কমবে। নারীকে ভাইয়ের সমান না দিলেও ভাই না থাকলে বোন যেন পিতার সম্পত্তির পূর্ণ মালিকানা পায় এই আইনটি করা জরুরি। শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য পিতার সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না- এটা অযৌক্তিক ও অমানবিক। (চলবে)

লেখক  সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।  rejaulkarim1975@gmail.com

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।