• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১, ০৯:১৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৯, ২০২১, ০৩:১৬ এএম

চতুর্থ পর্ব

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক।

মোহা. শাজাহান আলি।। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী। এবং নিজে একজন মুসলমান বলে গর্ব অনুভব করি

হংকং যাবার আগে চীনের বর্ডারে ছোট একটা পুল। পুল পার হয়ে ব্রিটিশ এলাকা। আবার ট্রেনে করে হংকং। ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে নয়াচীনের কর্মচারীদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেন। কারো সাথে এরা খারাপ ব্যবহার করে না। হংকং এর উদ্দেশ্যে যাত্রার আগে ‘নয়াচীনের কর্মচারী ও শান্তি কমিটির সভ্যবৃন্দ’তাদের বিদায় সংবর্ধনা জানান এবং যদি তাদের ব্যবহারে অসুবিধা হয় তাহলে এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কোমল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু সেসময় আপ্লুত হয়েছিলেন এবং খোদার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন ‘খোদা তুমি এদের মঙ্গল করিও’। পরের দেশের জন্য মঙ্গল কামনার সময়ও বঙ্গবন্ধু তার সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার বইয়ের আলোচনা কয়েকটি বিষয়কে তুলে এনেছেন: ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা; বেকার সমস্যা দূরীকরণ; পতিতাবৃত্তি বন্ধ করা; বিদ্যমান সমাজের কুসংস্কার ও  ধর্মীয় গোড়ামী। 

ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ: 
চীন একদিন ভিক্ষুকের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ পঁচিশ দিনের নয়াচীন ভ্রমণে কোনও ভিক্ষুক দেখতে পাননি। সরকার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে প্রত্যেক বড় বড় শহরে এবং জেলায় জেলায় ভিক্ষুকদের জন্য ‘ওয়ার্ক হাউজ’ করেছেন। সমস্ত ভিক্ষুককে ধরে সেই ক্যাম্পে নিয়ে কাজ দেয়া হয়। যাদের কাজ করার ক্ষমতা নাই যেমন ‘আতুর’, তাদের সরকারের পক্ষ থেকে খাবার দেয়া হয়। ঠিক এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধ ‘ওয়ার্ক হাউজ’ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের কাজে লাভ-ক্ষতি মূখ্য বিষয় নয় বরং ‘সরকার যে অর্থ দেয় তা জনগণের জন্য এবং জনগণের দেয়া এই টাকা’।

আফিম, চুরি-ডাকাতি বন্ধ:
আফিমের জন্য  চীন বিখ্যাত ছিল। বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করেন সেই আফিমের নেশা হতে চীন প্রায় বের হয়ে এসেছিল। গণচীনের সরকার আফিম খাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল। সরকার ঘোষণা করে, যদি কেউ সরকারের আদেশ অমান্য করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এতে জনগণের সাড়া পাওয়া যায়। দিনে দুপুরে খুন খারাবি হতো। চীনের ডাকাতি নিয়ে অনেক গল্প ছিল। মানুষকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতো। কিন্তু নতুন সরকার এসে কড়া হাতে এদের দমন করে। সরকারের তৎপরতা ও জনগণের সম্পৃক্তার জন্য আস্তে আস্তে ডাকাতি অনেক কমে গিয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু দুইটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন; জনগণের সম্পৃক্ততা এবং সুষ্ঠ কর্মপরিকল্পনা। ডাকাতি, চুরি বা খুনের জন্য প্রধান কারণ বেকার সমস্যা। চীন সেই জায়গায় কাজ করেছে বলে বঙ্গবন্ধুর কাছে মনে হয়েছিল। 

বেকার সমস্যা দূরীকরণে চীন সরকারের ভূমিকা:
চিয়াং কাইশেকের সময়ও জমিদার প্রথা চালু ছিল। জমির ওপর চাষীদের কোনও অধিকার ছিল না। চাষীরা শোষিত ও বঞ্চিত হতো। প্রসঙ্গক্রমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জমিদারী প্রথার সাথে সাদৃশ্য টেনেছেন। সেখানের জমিদারী প্রথার বর্ণনার সাথে বাংলাদেশের জমিদারী প্রথার সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। জমিদারদের খামখেয়ালিপনা এবং চাষীদের জমি হতে বঞ্চিত ও শোষিত হওয়ার ফলে বেকার সমস্যা, ডাকাতি, খুন, ভিক্ষাবৃত্তি সহ দুর্ভিক্ষের পথকে প্রসারিত করত। নয়াচীন সরকার ‘লাঙ্গল যার জমি তার’নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে জমিদারদের জমি চাষীদের মধ্যে বন্টন করে দেয়। চাষীরা জমির মালিকানা পায়। বঙ্গবন্ধু নয়াচীনে একখন্ড জমি অনাবাদি পায়নি। প্রথমদিকে চীনের জনগণ কম্যুনিষ্টদের ভয় পেত। কম্যুনিষ্টরা মানুষের কাছে সেই নিবেদন নিয়ে যেতে পেরেছিল এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল। জমির মালিকানা শুধু পুরুষ না বরং স্ত্রীও সমানভাবে পেয়েছিল। কৃষকরা যাতে নায্য মূল্য পায় সেই ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক এলাকাতে সরকারি দোকান ছিল সেখানে সস্তায় জিনিস পাওয়া যেত। এই ধরনের ক্রয় বিক্রয়ে কোনও দুর্নীতি ছিল না। যদি কেউ করে থাকে, তাহলে জনগণ তাকে ধরিয়ে দিত। এইভাবে চাষীদের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। 

বেশি ফসল উৎপাদনের জন্য প্রণোদনা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। গ্রামে গ্রামে ‘মিউচুয়াল এইড’ গড়ে তোলা হয়েছিল। চাষীদের মধ্যে মালিকানা তৈরি হওয়ায় বেকার সমস্যা কমে যায়। সরকার জনগণের সাহায্য নিয়ে নদী-খাল কর্মসূচী, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কর্মসূচী গ্রহণ করে। হোয়াংহো এখন চীনের দুঃখ না। এখন আর হোয়াংহো নদীতে বন্যা হতে পারে না। একসময় চীনে খাদ্যাভাব দেখা দিত। আর আজ নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করে। এটা সম্ভব হয়েছে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। 

সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছিল। খাদ্য, ঔষধ জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারে সরকারি কর্মচারীদের নিশ্চিত করতে হতো। প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু করা হয়। তারা ছোট-খাটো রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিকে নজর দিত। তারা ছোট-খাটো বিচার কাজ করতে পারত। মিথ্যা মামলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার সুযোগ ছিল না। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে নিজ দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরক্তি ফুটে ওঠে। সাথে মহাজনদের ফাঁদে সাধারণ মানুষ কিভাবে সর্বস্বান্ত হয় তার ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে বঙ্গবন্ধু দুঃখ পেয়েছেন। 

নয়াচীন বেকার সমস্যা দূর করতে কুটির শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছিল। কুটির শিল্প বিকাশ হওয়ায় হাজার হাজার বেকার কাজ পায়। সূতা আমদানীতে কালোবাজারি বন্ধের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সূতা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। কুটির শিল্প শুধু কাপড় বা সূতা তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং যে সমস্ত পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হতো, সে সমস্ত পণ্য যেমন টেবিল, চেয়ার, খাট, হাঁড়ি, পাতিল, কাঁচি ইত্যাদি কুটির শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিল সরকার। কুটির শিল্পের পাশাপাশি বড় বড় শিল্প গড়তে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করেছিল চীন সরকার। টেকনিক্যাল ট্রেনিং করা হয়েছে যেখানে বিভিন্ন মেয়াদে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের কর্মপরিকল্পনায় চীনাদের সে সময় বিশ্বাস ছিল আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে চীনে কোনও বেকার সমস্যা থাকবে না। 

পতিতাবৃত্তি বন্ধ:
চীনের পতিতাবৃত্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই সময়ে চীনের প্রেক্ষাপটে পতিতাবৃত্তি বন্ধে সরকারের কর্মপরিকল্পনা এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও পিছিয়ে পড়া নারীদের আমাদের সমাজে সম্মানজনক অবস্থান তৈরিতে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন (পৃষ্ঠা ৯৫-১০০)। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে এ ধরনের কাজে আইনের চেয়ে মানবিক ব্যবহার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ক্ষেত্রে সেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার এবং নৈতিক পরিবর্তনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার চীনে কায়েম হলেও বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমান অধিকার সুদূর পরাহত। এর কারণ সমাজ কাঠামো আর আমাদের ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু ধর্মব্যবসায়ী। গরীব অশিক্ষিত সমাজের এ মানুষগুলোকে তারা ধর্মান্ধতার পথে ঠেলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মানবিক গুণাবলির মধ্যে অন্যন্য নারীদর প্রতি সম্মান ও শিষ্ঠাচারবোধ। একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর নারীর প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু দ্বার্থহীনভাবে দাবি করেন, ‘এমন কোনো মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে কি যে সমানভাবে সকল স্ত্রীকে দেখতে পারে? কোনোদিন পারে না।’ একাধিক বিয়ে চীনে তুলে দেয়া হয়েছিল। নয়াচীনের নারী-পুরুষের সমান অধিকার যা নয়াচীনকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে বলে বঙ্গবন্ধুর কাছে মনে হয়েছে।

সরকারি  কর্মচারীদের নিষ্ঠা, আদর্শ ও দেশপ্রেম:
বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়াচীন’ রচনাটির মাধ্যমে চীনের সরকারি কর্মচারীর বেতন, সুযোগ-সুবিধা এবং তাদের দায়িত্ববোধের সাথে বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীদের বৈসাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। ৬০ কোটি লোকের নয়াচীনের প্রধান কর্মকর্তা মাও-সে-তুং বাংলাদেশি টাকায় সে সময় বেতন ছিল ৫০০ টাকা। আর কর্মচারীর সর্বনিম্ন বেতন ছিল ৫০ টাকা। যার সর্বনিম্ন বেতন ৫০ টাকা সে কিভাবে জীবনযাপন করবে, কোথায় থাকবে, তার ছেলে মেয়েরা কিভাবে লেখাপড়া করবে তার একটা পূর্ণাঙ্গ কৌশলপত্র ছিল সরকারের। সরকারি  দোকান ছিল যেখানে নায্যমূল্যে জিনিসপত্র পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধু মনে করে, ‘জিনিসের দামের সামঞ্জস্য থাকলে ৫০ টাকায় সংসার চালানো কষ্টকর হয় না।’ অন্যদিকে তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতির বেতন ছিল মাসে ‘১২০০ টাকা’। এবং সকলের ছোট কর্মচারী পেত ‘২০/২৫’টাকা। অন্যান্য মন্ত্রী ও কর্মচারীদের বেতন ‘২ হাজার’। এ ধরনের বৈষম্যে গরিব কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতো। নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া, কাপড়চোপড় ক্রয়, বাসা ভাড়া ইত্যাদি এই স্বল্প আয়ে সম্ভব হতো না। তাছাড়া বাজার অস্থিতিশীল ছিল। বাসাভাড়া পরিশোধ করে সংসার চালানোর মতো দুর্দশার কথা বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন। সরকারি  কর্মচারীদের ঘুষ-দুর্নীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছেন, মাত্র ২/৩ বছরের মধ্যে চীনের সরকারি  কর্মচারীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ত্যাগের মনমানসিকতা তৈরি হয়েছে। নয়াচীনে কোনো কর্মচারী ঘুষ খেতে পারত না। আর খেতে চায়ও না। ঘুষ ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত। অন্যদিকে তৎকালীন নিজ দেশের ঘুষের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখানে ঘুষ না খাওয়াই ব্যতিক্রম।’

বঙ্গবন্ধুর ১৪ বৎসরের জেল জীবনে জেলখানার ‘বৈজ্ঞানিকভাবে’ ঘুষ খাওয়ার চিত্র অবলোকন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, কাস্টমস, কোর্ট কাচারী, সাব রেজিস্টার অফিস, ইনকাম ট্রাক্স, কেউ কারো চেয়ে কম না’ (পৃষ্ঠা-১০৪)। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে বঙ্গবন্ধু ‘জাতির নৈতিক’পরিবর্তন এবং কর্মপরিকল্পনার তাগিদ দিয়েছেন। নয়াচীনে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঘুষ দুর্নীতি তুলে দিতে বন্ধপরিকর। মাঁও তাঁর বন্ধুকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করেনি। দুর্নীতি বলতে শুধুমাত্র ঘুষ না বরং চোরাকারবারী, কালোবাজারী এ ধরনের দুর্নীতিবাজদের প্রভাবপ্রতিপত্তির কথাও বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন এবং এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। অথচ তিনি নয়াচীনে দেখেন, কোনও ব্যবসায়ী সেখানে এক পয়সা বেশি নিতে পারত না। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা ছিল। অথচ সেই সময় এ ধরনের অনিয়ম ছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নয়াচীনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু মনে করেন ‘জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর। 

অসাম্প্রদায়িক নয়াচীন:
চিয়াং কাইশেকের সময় চীনের চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরাজ করত। চীনের মোট ৬০ কোটি জনসংখ্যার ৮০ ভাগ বৌদ্ধ, প্রায় ৫ কোটি মুসলমান এবং কিছু খ্রিস্টান। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলমানদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল। মুসলমানদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং বহু লোককে হত্যা করা হয়। সে সময় ধর্মকে ব্যবহার করে শোষন নিপীড়ন চলত। শাসন যন্ত্রের সাথে যারা জড়িত ছিল তারা ধর্মকে ব্যবহার করত নিজেদের স্বার্থের জন্য। বৌদ্ধের অহিংস নীতি ‘হিংসা’য় পরিণত হয়েছিল। হাজার হাজার লোককে গুলি করে হত্যা করে চিয়াং কাইশেকের দল। বঙ্গবন্ধু এর জন্য ধর্মকে দোষ দেননি। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রদর্শিত ইসলাম আজ কত ভাগে বিভক্ত। ‘সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানি, ইসমাইলি, আগাখানি, আবার মোহাম্মাদি, ওহাবি কত রকমের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে একই ধর্মের মধ্যে। অন্য ধর্মের সাথে বিরোধ আবার নিজেদের মধ্যে কত খুনাখুনি ও রক্তাক্ত ঘটনা। আমাদের দেশে তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ীরা ইংরেজি পড়া হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমদকে ‘কাফের’বলে ফতোয়া দিয়েছিল। 

ভারত ভাগের সময় সিলেট জেলা পাকিস্তানে যাওয়ার বিরুদ্ধে কিছু মাওলানা কেন সিলেট জেলা পাকিস্তানে যাওয়া উচিত হবে না এ নিয়ে তারা ফতোয়া দিয়েছিল। এ নিয়ে গণভোট হয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে বঙ্গবন্ধু সিলেটে যায়। প্রাণের ভয় থাকলেও বঙ্গবন্ধু পিছিয়ে আসেনি। ফতোয়া দিয়ে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধুকে সমাবেশে কথা বলতে দেয়নি। প্রায় ২ ঘন্টা মাওলানাদের বিপক্ষে সিলেটকে পাকিস্তানের অংশ করার পক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন। সমাবেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে বঙ্গবন্ধুর প্রাণহানি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। টাকার লোভে ‘একদল মাওলানারা’ কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিত। এই দান্দ্বিকতা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে না বরং বৌদ্ধ ধর্মে, খ্রিস্টান ধর্মে, আছে হিন্দু ধর্মেও। বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসার বদলে হিংসা, ঘৃণা, অত্যাচার আর অবিচার, খ্রিস্টান ধর্মের দেশগুলিতে ‘নয়া নয়া’ মারণাস্ত্র তৈরি করছে। দেশভাগের সময় ধর্মের নামে হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা। দেশভাগের সময় ভারত-পাকিস্তানের নেতারা যা পারেনি মাও-সেতুং সরকার কঠোর হস্তে সেই দাঙ্গা বন্ধ করেছিলেন। নয়াচীন নিয়ে বাইরে যে প্রচারণা ছিল তার সত্যতা বঙ্গবন্ধু পাননি। সেখানে মুসলমানদের ধর্ম পালনে কোনও  প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণে এবং ইসলামী শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিককরণে নয়াচীনের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। এ লক্ষ্যে নয়াচীন সরকার ‘অল চায়না ইসলামিক কালচারাল আসোসিয়েশন’ গঠন করেছিলেন। এর পাশাপাশি বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের জন্য এ ধরনের এ্যাসোসিয়েশন ছিল। এর মাধ্যমে সমাজে কুসংস্কার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ‘তাবিজ-কবজ’ ফুঁ-ফাঁ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

বঙ্গবন্ধু ঠিক এ ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে, সমাজের কুসংস্কার দূরকরতে এবং ইসলামের সমুন্নত আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য ১৯৭৫ সালে ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিয়ে যে দর্শন তাতে বঙ্গবন্ধু নিজকে ‘একজন মুসলমান বলে’গর্ববোধ করতেন। তার এই আদর্শ আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী। এবং নিজে একজন মুসলমান বলে গর্ব অনুভব করি।’ নয়াচীনের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করেছেন, ‘ধর্মের দোহাই দিয়ে সেখানে আজ রাজনীতি চলে না, যা চলছে আজ আমাদের দেশে।’ তারা ‘নিজেদের স্বার্থের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে-নিজেদের নেতৃত্ব রক্ষা করার জন্য। জনসাধারণকে ধর্মের নামে ধোকা দিয়ে তাদের শাসন ও শোষন করতে চায়’ (পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)।

নয়াচীন সরকারের সমাজ পরিবর্তনের কাজের সবাই প্রশংসা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে চীন সফরকারী অন্য সঙ্গীরা যেমন আতাউর রহমান ও ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া ঘোর কম্যুনিষ্ট বিরোধী হয়েও চীন সরকারের প্রশংসা করেছিলেন। দেশ ও জনগণের জন্য নয়াচীন সরকার যে কাজ করছে তা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও প্রশংসা করেছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়ার যে কোনো শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের সাথে এদের তুলনা করা যাবে।’বঙ্গবন্ধুর এই ভবিষ্যৎ বাণী আজ শুধু সত্য নয় বরং মহাসত্য। চীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই বড় অনুঘটক। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে চীনা জনগণের আমেরিকা বিদ্বেষ বহুদিন আগে থেকে প্রচলিত আছে। চীনকে জাতিসংঘের সদস্য না করা নিয়ে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, এটা অন্যায় ৬০ কোটি লোকের একটা দেশ আজ ইউএনও-তে ঢুকতে পারছে না, কারণ তাতে আমেরিকার স্বার্থে আঘাত লাগে। দেখা যায়, থাইল্যান্ড, ইরাক, ইরান, ব্রহ্মদেশ, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, এমনকি ১০ লক্ষ লোকের দেশ ২/১ টা আছে যারা ইউএনও-এর সদস্য। ইংরেজদের বিষয়ে চীনের জনগণ নমনীয় ছিল। সে সময়ে নয়াচীন সরকারকে ইংরেজরা স্বীকৃতি দিয়েছিল। হংকং চীনের মূল ভূখণ্ডের ভেতর একটা ইংরেজ কলোনি। ইংরেজদের ব্যবসা আছে সাংহাইতে। চীন মনে করত ইংরেজদের মধ্যে কিছুটা হলেও মনুষ্যত্ব আছে। নয়াচীন পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এশিয়ানদের সাথে বন্ধুত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। 

বঙ্গবন্ধু যা অবলোকন করেছিলেন এবং অনুধাবন করেছিলেন তাই তিনি তুলে ধরেছেন। এই সত্য উপস্থাপনে তিনি ছিলেন অবিচল ও নির্ভীক। চীনের সব কিছু ভাল লাগলেও যা তার ভালো লাগেনি তাও তিনি অকপটে বলে গিয়েছেন। ‘নয়াচীন সরকার কম্যুনিষ্ট মতবাদ ছাড়া অন্য কোন মতবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি’। নয়াচীনে ভিন্ন মত/আদর্শ প্রকাশের পথ সংকুচিত করার এই মনোভাবকে বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। তা সত্ত্বেও চীনা জনগণের মাঝে যে মনোবল দেখেছিলেন আর নয়াচীন যেভাবে উন্নতি করেছে তাতে বঙ্গবন্ধু আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, ‘দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সাথে তারা মোকাবেলা করতে পারবে।’


 

লেখক জ্যেষ্ঠ সহ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।

 

এসকেএইচ