• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৭, ২০২১, ০৭:১১ এএম

কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া। ছবি- সংগৃহীত।

আমরা জানতাম, গাছে ফল ধরলে গাছ যেমন নুইয়ে পড়ে, তেমনি ধার্মিক হলে তিনিও নুইয়ে পড়েন। অর্থাৎ তিনি বিনয়ী, মানবিক, সহনশীল, আস্থাশীল ও পরোপকারী হন। আজকালকার ধার্মিকরা মিছিল নিয়ে দল বেঁধে বের হয়ে যান ভিন্নমত, পথ ও ধর্মের অনুসারীদের হত্যা করতে; তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে; বাড়িঘর লুটপাট করতে; দেশের সম্পদ সরকারি-বেসরকারি যানবাহন পোড়াতে; অফিস আদালত ধ্বংস করতে। আমরা এ-ও জানতাম, পৃথিবীতে ধর্ম আসছে মানুষের কল্যাণের জন্য। একজন ধার্মিকের কাজ মানুষের কল্যাণ করা। বর্তমান ধার্মিক ভাইদের কাজকর্ম দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে ধর্মের সংজ্ঞা পাল্টে গেল কিনা? অথবা আমি ব্যাকডেটেড হয়ে পড়লাম কিনা? আমি কেন ওদের দলে যোগ দিচ্ছি না? আমি ওদের দলে যোগ দিতে পারি, তাদেরকে এসব কাজে উৎসাহ দিতে পারি। কিন্তু আমার বিবেক আমার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বিবেকই আমার বিপদের কারণ। বিবেকের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে মিলে যেতে পারছি না। এটা আমার অক্ষমতা! এ অক্ষমতা কিভাবে দূর হবে তা-ও জানি না!

মহান সংখ্যাগরিষ্ঠ ধার্মিক ভাইদের প্রথম টার্গেট সংখ্যালঘিষ্ঠের মত, পথ ও ধর্মের অনুসারীদেরকে শেষ করা। হোক সে ভিন্ন ধর্মের লোক বা স্বধর্মের লোক। ভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘিষ্ঠ হলে তো কথাই নেই। স্বধর্মের সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও ছাড় নেই। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভারত থেকে আলাদা হওয়া দেশ- এ তিন দেশেই প্রচুর হিন্দু ছিল। কালে কালে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে হিন্দু প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে হত্যা, সহিংসতা দূর হয়েছে? নাকি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে? আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে অহরহ হিংসা, সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে বোমাবাজি হচ্ছে জনসমাগমে, মাজারে, মসজিদে, ঈদের নামাজে, জুমার নামাজে, বিয়ে বাড়িতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে; আত্মঘাতি হামলা হচ্ছে। এ সবের বেশির ভাগ শিকার হচ্ছেন শিয়া ও আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। চলতি মাসের ১৫ তারিখ শুক্রবার আফগানিস্তানের কান্দাহারে শিয়া মসজিদে জুমার  নামাজ চলাকালে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৪৭ জন নামাজি নিহত হন এবং শতাধিক আহত হন। তার আগের শুক্রবার কুন্দজে জুমার নামাজের সময় বোমা হামলা হয়। তাতে ৩২ জন মুসল্লি নিহত হন, আহত হন শতাধিক। এ মাসের ১৬ তারিখে সৌদি জোট হামলা চালিয়ে ইয়েমেনে ১৬০ জন মুসলমানকে হত্যা করে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কোনও একজন মুসলমান বা মুসলিম দেশ এসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে শুনিনি।

সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করে, ধর্ষণ করে, তাদের ঘরবাড়ি অগ্নি সংযোগ করে, মন্দির ধ্বংস করে, দখল করে এক শ্রেণির মুসলমান নিজেদেরকে গাজি ভাবে আর আরেক শ্রেণি তাদেরকে সমর্থন দিয়ে পরকালের পুণ্য অর্জন করেন। কেউ বলতে পারেন হিন্দুদের হত্যা, ধর্ষণ করলে আপনার কী? আমি বলি আমারও কিছু আছে। একটা গল্প বলি। একজনের বাপ মারা গেছে। সে কান্নাকাটি করছে। প্রতিবেশীরা এসে তাকে বুঝায়, সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাছাড়া, তোমার বাবার বয়স হয়েছে। পরিণত বয়সে তিনি মারা গেছেন। এতে এতো কান্নার কী আছে? লোকটি উত্তর দিল, বাজান মারা গেছে আপত্তি নেই। কিন্তু জমে (আযরাইল) যে বাড়ি চিনে গেল। আজ হিন্দুদের সাথে যা করা হচ্ছে, কাল যে আমার আপনার সাথে তা করবে না তার নিশ্চয়তা কী? হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও সহিংসতা থামবে না। হিন্দুরা চলে গেলেই যদি দেশে শান্তি আসত, তাহলে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, সিয়েরালিওনে কেন শান্তি আসছে না? সেখানে যারা বোমাবাজি করে আর মরে, মারে, তারা কি হিন্দু, না মুসলমান? এসব দেশে হিন্দুদের পরেই নাজুক অবস্থায় আছে শিয়ারা, কাদিয়ানিরা। ইরান ইসরায়েল-আমেরিকার বিরুদ্ধে রণ হুংকার দেয়। কিন্তু আফগানিস্তানে শিয়াদের হত্যা করা হচ্ছে ইরান ঘুমিয়ে আছে। জিন্নাহর বাবা পুঞ্জলাল ঠাকুর ওরফে পুঞ্জ বাই জিন্না হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে শিয়া ইসমাইলিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। জিন্নাহ ভারতের মুসলমানদের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান কায়েম করেন। লাহোর প্রস্তাবের লেখক স্যার জাফরুল্লাহ খানও ছিলেন শিয়া। জাফরুল্লাহ খান, জিন্নাহ সাহেব আজ বেঁচে থাকলে দেখে যেতে পারতেন তাঁর শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরা কেমন শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে পাকিস্তানে আছে?

আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানরা বেশি সাম্প্রদায়িক, বেশি মৌলবাদী এবং হিন্দু বিদ্বেষী। এদের পূর্ব-পুরুষ হিন্দু ছিল বলেই কি এরা হিন্দু বিদ্বেষী? কেননা এরা মায়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলে না, চীনের বিরুদ্ধে কথা বলে না। মায়ানমার ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিল। এদেশের জিহাদি ধার্মিক ভাইদের কোনও টু শব্দ করতে দেখলাম না। ১৯৪৯ সালে চীন পূর্ব তুর্কিস্তান যার আয়তন ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি- তা দখল করে চীনের প্রদেশ বানিয়ে নাম দিল জিংজিউয়ান। সেখানকার উইঘুর মুসলিমরা আজ নিশ্চিহ্নের পথে। কোনও মুসলিম ধার্মিক বা মুসলিম দেশের প্রতিবাদ দেখলাম না। বরং মুসলিম দেশগুলোকে চীনের কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার আশায় তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। হিন্দুরা চিরকালই ভীরু, কাপুরুষ। ব্যাঘ্র যেমন হরিণ শিকার করে মজা পায়, তেমনি মুসলমান জিহাদিরা হিন্দুদের শিকার করে আনন্দ পায়।

বাংলাদেশে এখন লক্ষ লক্ষ মসজিদ, মাদ্রাসা। গ্রাম, গঞ্জ, শহর, বন্দর মাদ্রাসায় কিলবিল করছে। জানি না এ সব জায়গায় কী মহান শিক্ষা দেয়া হয়? মসজিদ হলো ইবাদতের জায়গা, স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পনের স্থান। সে জায়গা থেকে বের হয়ে দল বেঁধে ছুটে যায় হিন্দুদের মন্দির ভাঙ্গতে, তাদের বাড়িঘর লুটপাট করতে, তাদের বউ মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতে। বুঝি না এরা কী ইবাদত করে? এরা এত বেপরোয়া যে এদের ভয় পায় না এমন কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নেই। এরা হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী! বিচার বিভাগ এদের কাছে অসহায়, সেনাবাহিনী নতজানু। সরকার হচ্ছে হুকুমের গোলাম। সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক স্বরূপ একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল। এদের এক হুমকিতে সুপ্রিম কোর্ট সে ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকা বিমান বন্দরের সামনে সুফি সাধক বাউল সম্রাট লালন ফকিরের ভাস্কর্য স্থাপিত হবে। এমন অবস্থায় মৌলবাদি জিহাদি ভাইয়েরা দিল হুমকি। তখন ক্ষমতায় সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ তখন সর্বেসর্বা। মৌলবাদিদের কাছে তিনি নতি স্বীকার করলেন। ফলে সেখানে লালন ভাস্কর্য স্থাপিত হলো না। আর সরকার মৌলবাদিদের হুকুম পালন করতে সদা প্রস্তুত। নাস্তিক, হিন্দু লেখক, কবিদের কোনও লেখা, কবিতা পাঠ্যসূচিতে রাখা যাবে না। সরকার মহোদয় বললেন, জী হুজুর। হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতা পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ ছিল তা বাদ দেয়া হলো। হিন্দুদের লেখা কমিয়ে দেয়া হলো। হাট-হাজারি মাদ্রাসার জন্য রেলের জায়গাটা দরকার। তারা তা দখল করে নিল। পরে সরকার তা মঞ্জুর করে দিলেন। দায়রা হাদিসকে এমএ পাসের সমতুল্য বলে স্বীকার করে নিতে হবে। সরকার তা স্বীকার করে নিল। তারা আবার বলল, বাউল ফকিররা গান বাজনা করে আর মোল্লাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। সুতরাং বাউলদের ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করতে হবে। সরকার বলল, অসুবিধা নেই। সরকার তাদের কথামতো শরিয়ত বয়াতিকে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে দফা সারা করে জেলে পুরে দিল। সংসদে হাসানুল হক ইনু প্রধানমন্ত্রীর কাছে শরিয়ত বয়াতির মুক্তির দাবি জানালেন। প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিলেন। বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা দেয়া হলো। রাজবাড়ীর অসীম বাউলকে মোল্লারা হুমকি দিল। তাঁকে কিছুদিন আত্মগোপনে চলে যেতে হলো (১৭/১০/২০২১ তারিখে তিনি মারা গেছেন)। অনেক বাউলের চুল কেটে, শারীরিক লাঞ্জনা দিয়ে গ্রাম ছাড়া করা হলো। অথচ মাওলানা মামুনুল হক প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার ঘোষণা দিল। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল তো দূরের কথা, একটা জিডিও হয় না! মোল্লারা ওয়াজের নামে হরহামেশায় কত কিছু বলে- সেখানে ডিজিটাল আইন অসার, অন্ধ। ডিজিটাল আইন মুক্তচিন্তুকদের বেলায় ভারী সরব।

শত শত বছর ধরে বাউল শিল্পীরা গান পরিবেশন করে আসছে। বাল্যকালে আমি অনেক বিচার গান শুনেছি। বাউল শিল্পীরা পালা করে বিচার গান বা কবি গান করত। এসব গানে পাল্লার বিষয় ছিল- শরিয়ত-মারিফত, গুরু-শিষ্য, জীব-পরম, আদম-শয়তান, নারী-পুরুষ, নবুয়ত-বেলায়েত, সাকার-নিরাকার, রাধা-কৃষ্ণ ইত্যাদি। গানে এসব বিষয় নিয়ে করচা হতো। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করত। শরিয়তের পক্ষ যে নিত সে কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি শরিয়তের বিধি বিধানের কথা বলত। আর মারিফতের পক্ষ যে নিত সে ধর্মের এসব বাহ্যিক বিষয়াবলীর চেয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত বিষয়াবলীকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এরা গুরুবাদ বা তরিকা, মোরাকাবা-মোশাহেদার কথা বলত। গুরুর মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের পথ বাতলাতো। সসীম থেকে অসীমে, পার্থিব ও লৌকিক জীবন থেকে অসীম লোকে উন্নীত হওয়ার কথা বলত। মানুষ তন্ময় হয়ে এসব যুক্তি-তর্ক শুনত, আনন্দ পেত। ভাল-মন্দ বেছে নিতে পারত। কোনটা যুক্তিযুক্ত- তা বুঝতে পারত। ধর্ম সম্পর্কে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারত। আর এখন সেসব কথা উচ্চারণ করার স্বাধীনতা নেই। উচ্চারণ করলেই বলি (খুন)। আগে গ্রামে-গঞ্জে পীর-ফকিরের বাড়িতে বার্ষিকী গান হতো। এসব এখন ওঠে গেছে বললেই চলে। পাড়া-মহল্লা এখন মসজিদ, মাদ্রাসায় টইটুম্বুর! গানের পরিবর্তে এখন হয় ওয়াজ মাহফিল। এখানে কোনও পক্ষ-বিপক্ষ নেই। সবই এক তরফা। এসব ক্ষেত্রে প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল, গোঁড়া ও সীমিত জ্ঞানের অধিকারী আলেমগন তাদের ইচ্ছামত কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। মানুষকে আরো রক্ষণশীল, উগ্রবাদী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক করে তুলেন। তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করার উপায় নেই। ভিন্নমত পোষণ করলে তাকে কাফের, মুরতাদ বলে ফতোয়া দেয়া হয়। আর উগ্রপন্থী জঙ্গীরা মনে করে, কাফের বা মুরতাদকে হত্যা করতে পারলে বেহেস্ত নিশ্চিত। অথচ বিংশ শতকের সত্তরের দশক এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলেমদের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করা যেত। প্রথা, ধর্ম সম্পর্কে স্বাধীন মত প্রকাশ করা যেত। এখন তা অসম্ভব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া। কিন্তু রাষ্ট্র হয়ে গেছে মৌলবাদির সহযোগী শক্তি।

সংস্কৃতি মানুষকে একদিকে আনন্দ দেয়; অন্যদিকে মানুষকে করে সতেজ, বিনয়ী, উদার, বড় মনের অধিকারী। আমি ছোটবেলায় যা দেখেছি তা থেকে এ কথা বলতে পারি, দেশ ছিল সংস্কৃতিতে ভরপুর, মানুষ ছিল সংস্কৃতিমনা। ভোর হলে ঘুম ভাঙতো মোরগের ডাক, পাখির গান শুনে। বিচার গান, কবি গান, বৈঠকি গান, নৌকা বাইচের গান, পৌষ পার্বণের গান, বিয়ের গান, নাটক, যাত্রা, পূজা, খেলা, মেলা নানা কিছু হতো। মোল্লারা ফতোয়া দিল- এসব বিদাত, নাজায়েয। সরকার তাদের পক্ষে। ফলে এসব বন্ধ হয়ে গেল। মানুষ এক রোখা, রক্ষণশীল, বোধহীন, বিবেকহীন, নীরস, জড় হয়ে যাচ্ছে। জাতিকে সতেজ করতে হলে সংস্কৃতিকে বেগবান করতে হবে। মৌলবাদ রুখতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। মোল্লারা যত ফতোয়াই দিক, গান-বাজনা, খেলাধুলা হলে এখনো ওয়াজের চেয়ে বেশি মানুষ জড়ো হয়। সংস্কৃতিবান মানুষ অপরাধ করতে পারে না। কেননা তার বিবেক জাগ্রত, আলোকিত। তাই মোতাহার হোসেন চৌধুরী তাঁর সংস্কৃতি কথা গ্রন্থ শুরু করেছেন এ কথা দিয়ে- “ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার হল শিক্ষিত মার্জিত মানুষের ধর্ম।” সংস্কৃতির শূন্যতায় মানুষ হয় উগ্র-বিশ্বাসী। উগ্র-বিশ্বাসের ফল আফগানিস্তান, পাকিস্তান। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অভাবে বাংলাদেশও কি সে পথের পথিক হতে যাচ্ছে?

যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা তো স্রষ্টায় বিশ্বাসী। সকল মানুষই  স্রষ্টার সৃষ্টি। হোক সে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক, মুরতাদ। তাহলে ধর্মের নামে কিভাবে এক মানুষ আরেক মানুষকে ঘৃণা করে বা হত্যা করে? কেউ  স্রষ্টার অনুশাসন না মানলে, পরকালে সে  স্রষ্টার নিকট বিচারের সম্মুখীন হবে এবং স্রষ্টাই তাকে শাস্তি দিবেন। এজন্য কোনও মানুষকে তো স্রষ্টা আরেক মানুষকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা প্রদান করেননি। কোনও ধর্মেই এর অনুমোদন নেই। কেউ রাষ্ট্রের আইন অমান্য বা ভঙ্গ করলে, রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিবে। তদ্রূপ কেউ  স্রষ্ট্রার আইন অমান্য বা ভঙ্গ করলে,  স্রষ্ট্রা তাকে শাস্তি দিবেন। এটাই তো বিধান। যারা  স্রষ্টার নামে, স্রষ্টার দেয়া বিধানের নামে মানুষ হত্যা করে বা মানুষকে শাস্তি দেয়, তারা কি ভাবেন স্রষ্টা দুর্বল বা শাস্তি প্রদানে অক্ষম? তাই  স্রষ্টার পক্ষ হয়ে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। শাস্তি প্রদান করার জন্য তিনিই যথেষ্ট। স্রষ্টা তো সর্বশক্তিমান। তিনি তো কারো কাছে শক্তি ধার চাননি যে তাঁর পক্ষ হয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। অথচ সমাজে  স্রষ্টার নামে, ধর্মের নামে চলছে কতই না হিংসা-বিদ্বেষ, বিচারের নামে অবিচার, খুন-খারাবি, জবর দখল, লুট-তরাজ। যারা এসব করে তারাই বড় ধার্মিক দাবিদার। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ বলেন, “মসজিদ ভাঙ্গে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙ্গে ধার্মিকেরা, তারপরেও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙ্গাভাঙ্গিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।” যাহোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশের গতি আফগানিস্তানের দিকেই!

 

 

লেখককলামিস্ট।। 

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।

 

জাগরণ/এসকেএইচ