• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২২, ০৩:৪৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৬, ২০২২, ০৩:৪৭ এএম

এক পৃথিবী এক রাষ্ট্র

এক পৃথিবী এক রাষ্ট্র
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কানাডিয়ান দার্শনিক হার্বাট মার্শাল ম্যাকলুহান তাঁর (The Gutenberg Galaxy: The Making of Typographic Man ও Understanding Media গ্রন্থে পৃথিবীকে তুলনা করেন একটি গ্রামের সাথে। নাম দেন বিশ্বগ্রাম (Global Village)। গ্রামগুলো হয় স্বভাবত লম্বা। পৃথিবী তো আর লম্বা নয়। গোলাকার। এ জন্য পৃথিবীকে বলা হয় গোলাকার গ্রাম বা বিশ্বগ্রাম। গ্রাম হচ্ছে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র জনবসতি; যেখানে কেউ চিৎকার করলে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শোনা যায়, মুহূর্তেই যে কোনো সংবাদ মানুষের মুখে মুখে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ যুগে পৃথিবীর অবস্থাও তদ্রূপ। প্রযুক্তি উদ্ভাবণের ফলে পৃথিবীর কোন দেশে, কোন প্রান্তে কী ঘটে, কী হয়- তা মুহূর্তেই অন্যান্য দেশে বা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে যেমন সহজেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া যায়, তেমনি পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া যায়। এ সব বিবেচনায় পৃথিবী এখন একটি গ্রাম। যেহেতু পৃথিবী এখন একটি গ্রাম, সেহেতু সে গ্রামে এত রাষ্ট্র, এত ভাষা, এত জাতীয়তাবাদ, এত ধর্ম, এত মুদ্রার কী দরকার? হয়রানি ছাড়া বহু রাষ্ট্র, বহু ভাষা, বহু জাতীয়তাবাদ, বহু মুদ্রা, বহু ধর্ম কি মানুষের কোনো উপকারে আসে? উপকারে তো আসেই না; বরং এগুলোর জন্য অপচয় হয় সময়, শ্রম ও অর্থের।

১. রাষ্ট্র: বহু রাষ্ট্র বহু বিপত্তির মূল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয় মারণাস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র, পোষা হয় সামরিক বাহিনী। Stockholm International Peace Research Institute 2022 Fact Sheet for 2021- এর মতে, বিশ্বে সামরিক খাতের বাজেট ১৯৮১ বিলিয়ন ডলার; যা জিডিপির ২.৪ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫টি দেশ সামরিক খাতে ব্যয় করে ১৬২২.২ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র একাই করে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। তারপরে চীন ২৫২, ভারত ৭২.৯, রাশিয়া ৬১.৭, যুক্তরাজ্য ৫৯.২, সৌদি আরব ৫৭.৫ বিলিয়ন ডলার।  যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা যদি মানব কল্যাণে ব্যয় করা হতো, তাহলে পৃথিবীতে কোনো মানুষ দরিদ্র থাকত না। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে জ্ঞানার্জনের জন্য, চিকিৎসার জন্য, বাণিজ্যের জন্য, শ্রম বিক্রির জন্য যেতে হয়। এর জন্য থাকতে হবে পাসপোর্ট-ভিসা। বনের পশু-পাখির লাগে না পাসপোর্ট-ভিসা, অথচ মানুষের লাগে। সে মানুষ নাকি সভ্য ও স্বাধীন? তাছাড়া, পাসপোর্ট-ভিসা সাধারণের জন্য সহজ ব্যাপার নয়। তার ওপরে রয়েছে অর্থ খরচ। প্রতি দেশে রয়েছে হাইকমিশন বা অ্যাম্বাসি নামে কুটনৈতিক অফিস। এ সব অফিসের খরচ হাতির খোরাককে হার মানায়। তাই বিশ্বব্যাপী একটি রাষ্ট্র হলে মানুষ এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেত। যুদ্ধাস্ত্র ও মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা থেকে পৃথিবী রক্ষা পেত। বিশাল সামরিক বাহিনী পোষার প্রয়োজন হতো না। একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধ মানে ধ্বংস,  জানমালের ক্ষয়। তাই বিশ্বব্যাপী একটি রাষ্ট্র হলে মানুষ যুদ্ধ থেকে মুক্তি পেত, শান্তিতে থাকতে পারত,  বাধাহীনভাবে চলাচল করতে পারত। সুতরাং, সমগ্র পৃথিবীকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র করা দরকার । এ রাষ্ট্রের থাকবে একটি কেন্দ্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। বর্তমান রাষ্ট্রগুলো প্রদেশের ন্যায় শাসিত হবে, প্রয়োজন হলে কিছু পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে।

২. জাতীয়তাবাদ: মানুষের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত করা দরকার। জাতীয়তাবাদ মানুষকে উগ্র করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদের ফসল। দেশপ্রেমও ভালো না। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতার পরিচায়ক। দেশপ্রেম নয়, দেশপ্রেমিক নয়; দরকার বিশ্বপ্রেম, বিশ্বপ্রেমিক। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বাদ দিতে হবে; মানুষের জাতীয়তাবাদ হবে মানবতাবাদ।

৩. মুদ্রা: ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রা বড়ই যন্ত্রণা। বিশ্বের প্রতিটি দেশের একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন রয়েছে। একই মুদ্রা হলে কতই না সুবিধা হতো! চিকিৎসার জন্য, পড়াশোনার জন্য, বিনোদনের জন্য, বাণিজ্যের জন্য মানুষকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হয়। এক দেশের মুদ্রা আরেক দেশে অচল। তখন তা ডলারে রূপান্তর করতে হয়। ডলারে রূপান্তর করতে করতে মুদ্রার মান কমতে থাকে। তাছাড়া, বিষয়টি বিরক্তিকর। যেমন-  কেউ যদি চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়, সে টাকা নিয়ে যাবে। প্রথমে টাকাকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়। ডলারকে আবার ভারতীয় মুদ্রা রূপিতে রূপান্তর করতে হয়। যতবার মুদ্রা পরিবর্তন করা হয় ততবারই টাকার পরিমাণ কমতে থাকে। ডলার দ্বারা লাভবান হয় আমেরিকা। আর এর জন্য রয়েছে নানা দালাল ফড়িয়াদের দৌরাত্ম। এসব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী একই মুদ্রা প্রবর্তন করা।

৪. ভাষা: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘Summer Institute of Linguistics’ এর ২০০৯ সালের তালিকা অনুযায়ী পৃথিবীর ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯। পৃথিবীতে দুই বিলিয়ন লোক আছে যাদের মাতৃভাষার লিখিত রূপ নেই। ১০০০ লোকের কম লোক কথা বলে এ রকম ভাষা আছে ২০০০ এর অধিক। পৃথিবীতে প্রধান ভাষা হচ্ছে ২৩টি। বিশ্বায়নের যুগে বহু ভাষা বহু সমস্যা। মানুষকে নানা প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে হয়, যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। কিন্তু সেখানে বড় বাধা ভাষা। ভাষা না বুঝার কারণে এক দেশের শ্রমিক অন্য দেশে গিয়ে কম বেতন পান। নতুন করে ভাষা শেখা সহজ ব্যাপার নয়। আমার স্কুল জীবনের সহপাঠীদের দেখেছি, এক ইংরেজি পড়তেই সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে দিশেহারা হয়ে যেত। পৃথিবীতে একটি ভাষা হলে মানুষের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হতো। মানুষ সহজেই একে অন্যকে বুঝতে পারত, জ্ঞান অর্জন করতে পারত। জানি, মাতৃভাষাকে কেউ ত্যাগ করতে রাজি হবে না। যার যার মাতৃভাষা তার তার কাছে প্রিয়। এর সঙ্গে রয়েছে আবেগ অনুভূতির সম্পর্ক। ‍তাহলে উপায় কী? উপায় একটা আছে তা হলো- আগে বর্ণমালা এক করে ফেলা। যেহেতু রোমান বর্ণমালা বেশি লোক ব্যবহার করে, সেহেতু সেটি বেছে নেয়াই শ্রেয়। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে বাংলা ভাষার বর্ণমালা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কুদরাত-ই-খুদা, নজিবুর রহমান প্রমুখ রোমান বর্ণমালা গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান বর্ণমালার পক্ষে ছিলেন। পরে তিনি পিছিয়ে যান। (বশির আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ ৬৮৫-৬৮৬)। পঞ্চাশের দশকে বাংলা বর্ণমালার স্থলে রোমান বর্ণমালা গ্রহণের প্রস্তাব উঠেছিল। আজ মনে হচ্ছে সেটা হলে ভালো হতো। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে শব্দের পরিভাষা সৃষ্টি না করা। নতুন শব্দকে আত্মীকৃত করে নেয়া। ভাষা এমনিতেই বিবর্তনের ধারায় একীভূত হয়ে যাবে। তার জন্যে সময় লাগবে কিছু।

 ৫. ধর্ম: সব ধর্মই বলে সৃষ্টিকর্তা একজন। এক সৃষ্টিকর্তার একাধিক ধর্ম, একাধিক বাণী থাকে কী করে-  বোধগম্য নয়। তাও আবার বিপরীতমুখী বাণী! এই বিপরীতমুখী ধর্মাচরণ, ধর্মবাণী ও নির্দেশাবলীর কারণে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ, মারামারি, রক্তারক্তি লেগেই আছে। প্রতিটি ধর্ম সৃষ্টির পিছনে রয়েছে রক্তের ইতিহাস। ধর্ম মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। ধর্ম যদি স্রষ্টার সৃষ্ট হয়, তবে মানুষও স্রষ্টার সৃষ্ট প্রাণী। একই স্রষ্টার সৃষ্টি হলে ধর্মে ধর্মে বিভেদ, বৈষম্য কেন? কেন ধর্মে ধর্মে বিয়েশাদী, বন্ধুত্ব, সহাবস্থান হবে না? তাই ধর্মের বিভাজন লাঘব করতে দরকার মানবিক সমাজ, মানবিক ধর্ম, যাকে বলা যেতে পারে মানবধর্ম। মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত মানবধর্ম। মানবধর্ম ব্যতীত মানুষের মুক্তি অসম্ভব। তাই তো লালন ফকির বলেন,

‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।