• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২২, ১২:৫৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২২, ২০২২, ০৬:৫৭ এএম

রুশ-ইউক্রেন সংকট ও মুসলিম বিশ্ব

রুশ-ইউক্রেন সংকট ও মুসলিম বিশ্ব

রুশ-ইউক্রেন সংকট মানে রুশ-মার্কিন সংকট। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রকারান্তরে রুশ-মার্কিন যুদ্ধ। আমেরিকা হচ্ছে বিশ্ব মোড়ল। এক সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আরেক মোড়ল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। ইউক্রেন তাদের একটি। আমেরিকা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভেঙে দিয়ে একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। এতেই আমেরিকা থেমে থাকেনি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া যাতে আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সে রাশিয়ার চারপাশে ন্যাটো নিয়ে হাজির। ন্যাটো হচ্ছে সামরিক জোট। ন্যাটো দ্বারা রাশিয়াকে ঘেরাও করে রাখাই আমেরিকার উদ্দেশ্য। ওয়ারশো প্যাক্টের অনেক সদস্যকে ন্যাটোর সদস্য করা হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কতিপয় সদস্য লাটভিয়া, লিথুনিয়া, এস্তোনিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করা হয়েছে। এখন মস্কোর নিকটবর্তী ইউক্রেনকে আমেরিকা ন্যাটোর সদস্য করবে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে সেখানে আমেরিকা কয়েকটা মিসাইল মস্কোর দিকে তাক করে রাখবে। ফলে, রাশিয়ার আর মোচড় দেওয়ার উপায় থাকবে না। ফলে, রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট পুতিন বার বার আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বকে বলছে- ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত না করতে। কিন্ত আমেরিকা তাতে কর্ণপাত করেনি। সংকট এখানেই। পুতিন মনে করেন, যুদ্ধ অনিবার্য। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আগেই যুদ্ধ করা শ্রেয়।

আমেরিকা ও তার দোহারগণ (পশ্চিম ইউরোপ) সরাসরি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে হাজির না হলেও ইউক্রেনের পক্ষে তারাই সব কিছু করছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউক্রেনিদের হাতে নেই। এ যুদ্ধ চলে গেছে আমেরিকা ও ন্যাটোর হাতে। ন্যাটো সরাসরি সৈন্য দিচ্ছে না। তবে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ, প্রশিক্ষণ, অর্থ সবই দিচ্ছে তারা। প্রতিদিন ১৭টি প্লেনে অস্ত্র যাচ্ছে ইউক্রেনে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক কাড়ি কাড়ি টাকা দিচ্ছে ইউক্রেনকে। রুশ আক্রমণের দুইদিন পর জো বাইডেন ইউক্রেনের জন্য ৩৫ কোটি ডলার সাহায্য ঘোষণা করেন। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র ১০/০৩/২২ তারিখে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার, ১২/০৩/২২ তারিখে ২০ কোটি ডলার সাহায্যের ঘোষণা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০.২ বিলিয়ন ইউরো, আইএমএফ ১.৪ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ব ব্যাংক ৪৮.৯ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে ইউক্রেনকে। এই টাকা দেওয়া হচ্ছে অস্ত্র কেনার জন্যে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে দিচ্ছে জ্যাভলিন এন্টিট্যাংক, রকেট লাঞ্চার, স্ট্রিংগার এন্টিক্রাফট মিসাইল। এগুলো প্রকাশ্যেই দিচ্ছে। আর অপ্রকাশ্যে অনেক কিছু। ইউক্রেন সরকার হচ্ছে পশ্চিমাদের হাতের পুতুল, যেমনি নাচায় তেমনি নাচে।

আমেরিকা ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় শরিক হতে বলেছে। আর যারা শরিক হবে না তাদেরকে সে রাশিয়ার সহযোগী বলে মনে করবে। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো (দু’একটা ব্যতীত) নীরব ভূমিকা পালন করছে। যেহেতু রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, সেহেতু তারা প্রকাশ্যে রাশিয়াকে সমর্থন করতে পারছে না। আর আমেরিকাকেও তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। এবার মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা ভিন্ন মনে হচ্ছে। মনে হয়, তাদের বোধোদয় হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব বরাবরই ছিল আমেরিকার পক্ষে, রাশিয়ার বিপক্ষে। এবার তারা আমেরিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পূর্বে আমেরিকা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তানকে  যা বলত, তাতেই জি হুজুর বলত। এবার তারা আমেরিকার কথা কর্ণপাত করছে না। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের যুবরাজ জায়েদ আল নাহিয়ানকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফোন দিলে তারা ফোনই ধরেননি। আবার ভারত পাকিস্তান চির বৈরি। একজন একদিকে গেলে অন্যজন আরেকদিকে যায়। অথচ রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত পাকিস্তান একই পন্থা অবলম্বন করছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ভোট দানের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের ২৮ জন রাষ্ট্রদূত আহবান জানান। তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কড়া প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, আমরা কি পশ্চিমাদের দাস? তারা যা বলবে তাই আমরা করব?

ধার্মিক মুসলিমগণও পুতিনের পক্ষে, আমেরিকার বিপক্ষে। এর কারণও আছে। ১. আমেরিকা মুসলমানদের নিয়ে খেলে। খেলা শেষে লাথি মেরে ঝোপে ফেলে দেয়। ২. আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে। ৩. ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভ। আর সেই ইসরায়েলর পৃষ্ঠপোষক হলো আমেরিকা। ৪. ইসলাম ও কমিউনিজম উভয়ই সর্বহারাদের প্রাধান্য দেয়। পার্থক্য কমিউনিজম ধর্মকে অস্বীকার করে। ইসলাম ধর্মকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এখন রাশিয়ায় কমিউনিজম নেই। পুতিন রাশিয়ায় ধর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন, মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। ৫. আরেকটা কারণও হতে পারে তা হলো- ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হচ্ছেন একজন ইহুদি। মুসলমানরা স্বভাবত ইহুদি বিরোধী।

যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় বলা যায় না। কেননা প্রেম আর যুদ্ধ কোনও নিয়ম মানে না। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা জড়ালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানে পারমানবিক যুদ্ধ। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য অগ্নি পরীক্ষা। এই যুদ্ধে রাশিয়া জয়লাভ করলে রাশিয়া আবার বিশ্ব নেতৃত্বে উঠে আসবে। বিশ্বশক্তিতে ভারসাম্য আসবে। এশিয়া- আফ্রিকার দেশগুলো বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো রাশিয়ার কাতারে চলে আসবে। বিশ্ব আমেরিকার বিকল্প শক্তি ও নেতৃত্ব খুঁজছে। আর যদি রাশিয়া পরাজিত হয়, তাহলে আমেরিকা ও মিত্র দেশগুলো মিলে রাশিয়াকে মাটিতে পিষে ফেলবে। আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি রাশিয়ার উপর এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ নেই যা আরোপ করেনি। সে নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ কাটিয়ে রাশিয়ার টিকে থাকা দায়। তবে ইতিহাস তো বিজয়ীর কথা বলে। বিজয়ই বলে দিবে ইতিহাস কার পক্ষে যাবে?

আমেরিকার কোনও নীতি আদর্শ নেই। তার একমাত্র আদর্শ স্বার্থ। এজন্য আমেরিকা কারো বন্ধু নয়। ইরানের রেজাশাহ ছিলেন মার্কিনপন্থি। তাঁর সাথে আমেরিকার দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল। রেজাশাহ পারমানবিক শক্তির অধিকারী হতে চেয়েছিলেন। আর এতে আমেরিকা রেজাশাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ১৯৭৯ সালে যখন ইসলামি বিপ্লবের নামে খোমেনি ইরানের ক্ষমতা দখল করেন, তখন রেজা শাহ আমেরিকায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। আমেরিকা তাঁকে আশ্রয় দেয়নি। আবার আমেরিকা খোমেনির ক্ষমতা দখলকেও মেনে নেয়নি। সে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ইরানের সেনাবাহিনী বিপ্লবী গার্ডকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে রেখেছে। ফলে, ইরানের সাথে আমেরিকার দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। আবার ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্বেও ঘি ঢালছে।

আমেরিকার আরেক কাজ হচ্ছে ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখা। ইসলামি দেশগুলোতে বিভিন্ন উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠন যেমন মুজাহিদীন, তালেবান, আলকায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, দায়েশ, লস্কর-ই তওবা, ইসলামিক সালভেশন প্রভৃতি আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায়ই সৃষ্টি হয়। তাদেরকে আমেরিকা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। আবার তারা কথা শুনতে একটু দেরি করলে জঙ্গি তকমা আখ্যা দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করে। তাদেরকে দমনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। অস্ত্র বিক্রির জন্য সে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাখে। আবার আমেরিকায় রয়েছে বিভিন্ন লবিস্ট ফার্ম। তাদের কাজ হচ্ছে এক গ্রুপের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আরেক গ্রুপ বা আরেক দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা। এই দালালদের সুপারিশেই আমেরিকা বিভিন্ন দল বা দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমেরিকা যা খুশি তাই করে। তাতে মানবাধিকার লংঘিত হয় না। অপর কেউ কিছু করলে তার ওপর সে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আনে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাতে সায় দেয়। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে যত প্রচার প্রপাগান্ডা, পশ্চিমের বাইরে তা নেই। কারণ পশ্চিমাদের প্রতি সকলেরই রয়েছে কম বেশি ক্ষোভ।

আমেরিকার বড় অস্ত্র হচ্ছে ডলার। ডলার বিনিময় তার বিরাট উপার্জন। দরকার ডলারের পরিবর্তে আরেকটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রবর্তনের। এটি সম্ভব হলে আমেরিকার দাপট হ্রাস পাবে। এ যুদ্ধে রাশিয়া জয়লাভ করলে আরেকটি বিকল্প মুদ্রার আবির্ভাব হবে। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ তাতে শরিক হবে বলে মনে হয়। অনেক মুসলিম দেশও তাতে সায় দেবে।

 

লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর। 

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।