• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২২, ১২:১১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৬, ২০২২, ১২:১১ এএম

বাংলার স্বাধীনতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন

বাংলার স্বাধীনতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা, শেখ মুজিব ছিলেন সেই আন্দোলনের কর্মী। যেভাবে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো তাতে গুরু-শিষ্য উভয়েই হতাশ হন। হতাশার প্রথম কারণ- বাংলা ভাগ; দ্বিতীয় কারণ- সমস্ত কর্তৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে অর্পণ। শেখ মুজিব তখনই উপলব্ধি করলেন, এই পাকিস্তান দিয়ে বাঙালির কোনো উপকার হবে না। বাঙালিদের স্বার্থে এই পাকিস্তান ভাঙতে হবে। এজন্য দরকার দল। কেননা দল ছাড়া বল নেই। তাই তিনি ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। তারপরে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা; যে স্বপ্ন তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, বাংলা পিডিয়ার প্রধান সম্পাদক, ডঃ সিরাজুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় মাঝে মধ্যে আমার কথা হতো। একদিন স্যার বলেন, শেখ মুজিব পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা করতে থাকেন। স্যার বলেন, তাঁর কাজিন এ. কে. রফিকুল হোসেন ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু। রফিকুল হোসেন ১৯৫৪ সনের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিব মাঝে মাঝে স্যারদের বাসায় যেতেন এবং তাঁর ভাইয়ের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। তখনই শেখ মুজিবকে বলতে শুনতাম, এ পাকিস্তান দিয়ে কাজ হবে না। এটাকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। এসব শুনে স্যার তখন ভীষণ কষ্ট পেতেন। কেবল পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে, আর এরা এখনই একে ভেঙে ফেলতে চায়। স্যার তখন স্কুলে পড়তেন, পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। 

বিশিষ্ট কম্যুনিস্ট নেতা ও লেখক খোকা রায়ের মতে, শেখ মুজিব ১৯৬১ সাল থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি তাঁর ‘সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবের কয়েকটি গোপন বৈঠক হয়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। কম্যুনিস্ট নেতাদের তিনি একাধিকবার বলেন, গণতন্ত্র, বন্দি মুক্তি প্রভৃতি দাবির সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার দাবিও এখনই উঠানো উচিত। তাঁরা বললেন, এখনো সময় আসেনি। জনগণকে প্রস্তুত করেই চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে হবে। এখন গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। তিনি বললেন, আমার নেতা শহীদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর চিন্তাধারা আপনাদের মতোই। আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, যুক্তিগুলো মানতে পারলাম না। তবে স্বাধীনতাই আমার শেষ কথা।  

১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী লন্ডন যান চিকিৎসার জন্য। ১৯৬৩ এর নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান তাঁর প্রিয় নেতার দেখাশোনা ও পার্টির পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে। লন্ডনে বাঙালিদের আড্ডার স্থল আর্লস কোর্ট এলাকায় ‘গ্রিনমাসক’ রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন ভোজন করছেন গুরু-শিষ্য (সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব)। খাবার তদারক করছেন রেস্টুরেন্টের মালিক প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নান সানু মিয়া। শেখ মুজিব বললেন, “স্যার, আপনিই হউন আর মওলানা সাহেবই (মওলানা ভাসানী) হউন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী, আপনারা কোনো অবস্থায়ই ইস্ট পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারবেন না। কারণ ওয়েস্ট পাকিস্তান ইস্ট পাকিস্তানকে গিলতে বসেছে। ইস্ট পাকিস্তানকে একদিন না একদিন আলাদা হতেই হবে। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। এ কথা শুনে সোহরাওয়ার্দী রেগে যান এবং বলে, Don’t talk nonsense।’ শেখ মুজিব চুপ করে গেলেন। একটু সামলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী বললেন, তোমাদের কী আছে যে আলাদা হয়ে যাবে? পারবে ওদের সাথে যুদ্ধ করে আলাদা হতে? (সুলতান মাহমুদ শরীফ, লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (প্রবন্ধ), জাতির জনক তাঁর সারা জীবন, শিশু- গ্রন্থমালা ১, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, পৃ. ১২৯)। পরবর্তীতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করে গুরুর সে প্রশ্নের উত্তর শিষ্য ঠিকই দিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী নিজে লিখেছেন, আমি চাই পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় করতে। কিন্তু শেখ মুজিব চায় আলাদা হয়ে যেতে।” আসলে শেখ মুজিবের সারা জীবনের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনাই ছিল বাংলার স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু ব্যতীত কোনো বাঙালি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন এমন কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। হোক সে নেতা বা বুদ্ধিজীবী। সাধারণ মানুষের থাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, আর বুদ্ধিজীবীদের থাকে নাকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। অথচ ১৯৭১ সালের পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো বুদ্ধিজীবীর লেখা বই পুস্তক তো দূরের কথা, আভাসও মেলেনি। তারা ছিলেন সুবিধাবাদী, সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। এ ব্যাপারে আহমদ ছফা তাঁর  সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থে বলেন, “আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কোন জাতীয় সম্ভাবনা আঁচ করতে পারেনি। বাংলাদেশ যে স্বাধীন সার্বভেীম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে আমাদের কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দুই যুগ, এক যুগ, ছয় যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোন বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারে তার ছিঁটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে।” অথচ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মূলে ছিল বুদ্ধিজীবীগণের লেখনী। ভলতেয়ার, মনতেস্কু, রুশো, দিদেরো প্রমুখ বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক তাঁদের লেখনির মাধ্যমে অন্যায়, অযৌক্তিকতা, অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমনে বৈপ্লবিক ভাব জাগিয়ে তুলেন। কিন্তু বাংলার জনমনে স্বাধীনতার জন্য যিনি বৈপ্লবিক ভাব জাগিয়ে তোলেন তিনি বঙ্গবন্ধু ব্যতীত আর কেউ নন।’’

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। ছয় দফার মধ্যে ছিল দুইটি মুদ্রা, দুইটি রিজার্ভ ব্যাংক, আঞ্চলিক সেনা গঠনের অধিকার। দুই মুদ্রা চাওয়া মানেই তো দুইটি দেশ চাওয়া। সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বলে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলা। ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “সাধারণ মানুষ কি আপনার ছয় দফা বুঝে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আসলে ছয় দফা টফা কিছু নয়, আমার দফা তিনটি, কত নেছো, কত দেবা, কখন যাবা।” বঙ্গবন্ধু নিজেই ছয়দফা সম্পর্কে মন্তব্য করতেন, সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের জন্য।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র বৈধ নেতা। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশে) জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। তাই বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার শুধু তাঁরই ছিল। জনগণ তাঁকে ম্যান্ডেড দেন। তারপরও পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী যখন তাঁকে ক্ষমতা দিচ্ছে না, তখনো তিনি ধৈর্যহারা হননি, একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য সেদিন ঢাকায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। সেদিন তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, স্বাধীনতাও ঘোষণা করতে পারতেন। সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তাঁর উপর ছাত্র-জনতার চাপও ছিল। তবে সেদিন তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি, আবার বাদও রাখেননি। সেদিন তিনি স্বাধীনতার জন্য জনগণকে প্রস্তত হওয়ার দিক নির্দেশনা দেন। তিনি জানতেন আলোচনা ব্যর্থ হবে। তবুও তিনি আলোচনা করেন। আলোচনা ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানিরা অকস্মাৎ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সেই সুযোগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এসবই ছিল তাঁর রাজনীতির চরম পরিপক্কতা। 

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং তিনি ফিরে আসবেন এমন নিশ্চয়তা ছিল না। তা জেনেও ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। তাঁর নামেই সরকারের নামকরণ ‘মুজিবনগর সরকার’ করা হয়। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। কারণ তখন নেতা বলতে মানুষ একজনকেই চিনত, মানত এবং তাঁর নামে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। আর তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মন্ত্রী মওদুদ আহমদ তার বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা গ্রন্থে বলেন, “আওয়ামী লীগে কোনো পর্যায়ে শেখ মুজিবের স্থলাভিষিক্ত হবার মতো কোনো নেতা ছিলেন না এবং নেতৃবর্গ জানতেন যে, একমাত্র শেখ মুজিবের নামে সংগ্রাম পরিচালনা করলেই জনগণের সমর্থন অর্জন করা সম্ভব। এটা ছিল বাস্তবিক অর্থে বিস্ময়কর যে, শেখ মুজিব পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলেও এবং নিজে গ্রেফতার বরণ করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি ছিল অটুট। এভাবে এমন একজনের নামে নয় মাসব্যাপী সংগ্রাম পরিচালনা করা হয় যিনি স্বয়ং সংগ্রামে উপস্থিত ছিলেন না এবং কোনদিন নিজ বাসভূমিতে ফিরে আসবেন এমন নিশ্চয়তা ছিল না। মুজিবের জীবনে এটাই ছিল সর্বোচ্চ সাফল্য।”

 

লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।