• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০১৯, ১০:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৫, ২০১৯, ১০:১৮ পিএম

ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে

ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা - ফাইল ছবি

দলীয় ফোরাম ও নির্বাচনি জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক এক করে গণফোরামের দুই নেতার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম এবং বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এই জোট গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে তাদের নির্বাচিত এমপিদের শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সন্দেহের শুরুটা হয়েছিল মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে দিয়ে। শেষ করেছেন সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরামের প্রতীক উদীয়মান সূর্য প্রতীকে নির্বাচিত মোকাব্বির খান। মোকাব্বির দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্যও। এর মধ্যে গণফোরামের সদস্য ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সুলতান মনসুর প্রচণ্ড বিরোধিতা ও সমালোচনা উপেক্ষা করে  শপথ নিয়েছেন এক মাসে আগে, গত ৭ মার্চ। আর সর্বশেষ মোকাব্বির শপথ নিলেন ২ এপ্রিল। দুজনের ক্ষেত্রেই গণফোরাম থেকে বলা হয়েছে তারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নিয়েছেন। পরপর এমন দুটি ঘটনাকে ভালো চোখে দেখছে না জোটের অন্যতম দল বিএনপি।

গণফোরামের আরেক নেতা মোকাব্বির খান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে আস্থার সংকট আরও তীব্র হবে বলে এই জোটের নেতাদের অনেকে মনে করছেন। তাদের আশঙ্কা, গণফোরাম থেকে নির্বাচিতদের শপথ বিএনপির নির্বাচিত এমপিদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে পারে। গণফোরামের দুজনের শপথে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা যেমন অস্বস্তিতে রয়েছেন, তেমনি তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও গণফোরামকে দেখছে সন্দেহের চোখে। শুরু থেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে গণফোরামের সঙ্গে জোট গঠনকেও ভালো চোখে দেখেননি বিএনপির নেতাকর্মীরা।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, বিএনপির অনেকেই বলে আসছেন, ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়াটাই তাদের ভুল হয়েছে। এখন গণফোরামের দুই নেতা শপথ নেয়ায় তাদের সেই ধারণাটা আরও দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

তিনি বলেন, এ অবস্থায় বিএনপিতে নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূলের আস্থার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর সাধারণ নেতাকর্মীদের আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে, এখন তা আরও বেশি প্রকট হতে পারে।

বিএনপি থেকে যে ৬ জন এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া অন্যদের দলের কেন্দ্রীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে তেমন কোনো অবস্থান নেই। ফলে, গণফোরামের দুই নেতার শপথের পর, তাদের সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে একটা মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে ধারণা করছেন দলের নেতারা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বিএনপি নেতা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোনো শর্তের প্রশ্ন এলে বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া বা না-যাওয়ার বিষয়কে কৌশল হিসেবে ব্যবহারের একটা চিন্তা দলে রয়েছে।

জানা গেছে, বিএনপির তৃণমূল আগে থেকেই গণফোরামের সঙ্গে জোট বাঁধা নিয়ে নেতিবাচক অবস্থানে ছিল। মোকাব্বির খানের শপথ নেয়ার পর বিএনপির ভেতরে জোট ভাঙার আওয়াজ উঠেছে। তারা এ-ও বলছেন যে, গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুজন যেভাবে শপথ নিয়েছেন- এতে ষড়যন্ত্র আছে। গণফোরাম প্রকাশ্যে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ভেতরে ভেতরে তাদের শপথ নেয়ার পক্ষে কি না-তা নিয়েও সন্দেহ করছেন তারা।

বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দুজন নেতা নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা মনে করছেন সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খানের শপথ নেয়ার সঙ্গে গণফোরামের সায় রয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের রাজনীতিক গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। বিএনপির ধারণা, তার মৌন সম্মতিতে তাদের দুজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। নির্বাচিত দুজনকে শপথ নিতে বলে তিনি এখন বহিষ্কারের নাটক করছেন। এক্ষেত্রে গণফোরাম বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করছে। দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই দলের সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও পথ চলা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ওই দুই নেতা।

জানতে চাইলে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, তিনি (মোকাব্বির খান) দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে শপথ নিয়েছেন। এর সঙ্গে গণফোরামের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি গণফোরামের যে দলীয় প্যাডে চিঠি দিয়ে শপথ নেয়ার কথা লিখেছেন সেখানে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কোনো স্বাক্ষর নেই। তাছাড়া, আমাদের দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত- কেউ শপথ নেবেন না। তারা নিয়েছেন। এটা প্রকাশ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত ও দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পরবর্তী স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা শেষে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

এক প্রশ্নের জবাবে মন্টু বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ওই দুজনের শপথ নেয়ায় আমাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়নি। হবে না। কারণ আমরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে জোট করেছি।

বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, তিনি (মোকাব্বির খান) জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। নিশ্চয়ই দল এবং জোটের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার এভাবে শপথ নেয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ দুষ্টু লোকের চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো। 

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় না আসা পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে, ঐক্যফ্রন্ট থাকবে। 

তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট যেমন আছে তেমনি থাকবে। ঐক্যফ্রন্ট ভাঙবে না, ঐক্যফ্রন্ট মানুষের জায়গা, মানুষ ঐক্যফ্রন্টকে চায়, মানুষ ঐক্যফ্রন্টকে ভালবাসে। 

মান্না আরও বলেন, আমরা নিজেদের মধ্যে সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে আমাদের ঐক্যের বন্ধনকে অটুট করে বৃহত্তর কর্মসূচি নিয়ে আসব। এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি- ঐক্যফ্রন্ট আছে, ঐক্যফ্রন্ট থাকবে। আর ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলনের মধ্যেই থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় না আসবে।

এবারের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৮টি আসনে জয়লাভ করে। এর মধ্যে বিএনপি ৬টি ও গণফোরাম ২টি আসন পায়। গণফোরামের আরেক সদস্য সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হন। গত ৭ মার্চ তিনি শপথ নেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেয়ায় তাকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়। ৭ মার্চ মোকাব্বির খানেরও শপথ নেয়ার কথা ছিল। তবে এর আগের দিন তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। 

অন্যদিকে, বিএনপি থেকে নির্বাচিতরা হচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (বগুড়া-৬), মোশারফ হোসেন (বগুড়া-৪), রেজাউল করিম বাবলু (বগুড়া-৭), আমিনুল ইসলাম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), হারুনুর রশিদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩) ও উকিল আব্দুস সাত্তার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২)। তারা এখনও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। যদিও বিএনপিতে গুজব-গুঞ্জন আছে- এখনও প্রকাশ্যে কোনো কথা শোনা  না গেলেও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার পক্ষে এসব নির্বাচিতরা। যেকোনো প্রকারে দলীয় গ্রিন সিগনাল পেলেই তারা শপথ গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত।

সূত্রে জানা যায়, শপথ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত বদলানোর কোনো চিন্তা বিএনপিতে রয়েছে বলে কোনো নেতাই এখনও বলছেন না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়কে একমাত্র ইস্যু হিসেবে নিয়ে এগুতে চাইছে। সেজন্য বিভিন্ন কৌশল নিয়ে দলে আলোচনা রয়েছে।

দলটির নেতাদের অনেকে বলেছেন, বিএনপি বারবার সংকটে পড়ছে। ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এমনকী খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন দলটি গড়ে তুলতে পারেনি। দলের অনেক নেতাই এখন প্রকাশ্যে বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একান্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সমঝোতার প্রয়োজন হলে সেখানে বিএনপি সংসদে যোগ দিতেও পারে। তবে বিষয়টি শুধুমাত্র বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। 
খালেদা জিয়ার অতীত ইতিহাস দেখে বিএনপি নেতারা সমঝোতার বিষয়ে সন্দিহান। কারণ তিনি আদৌ কোনো সমঝোতায় যাবেন কি না, এটা নিয়েও বিএনপি নেতাদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে একমাত্র খালেদা জিয়াই সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্য কেউ নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো আলোচনা, আপস বা সমঝোতা হচ্ছে না। সম্ভাবনাও নেই। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া শুধু আমাদের চেয়ারপারসন নন, তিনি দেশের গণতান্ত্রিক নেত্রী। সেক্ষেত্রে তার মুক্তি জরুরি। সেজন্য আমরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে আন্দোলনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। আন্দোলন করে যাচ্ছি।

টিএস/ এফসি