• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০১৯, ০৬:৩০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৪, ২০১৯, ০৬:৩০ পিএম

মামলা করেছিলেন ইনু

এরশাদ ছিলেন আদালত কর্তৃক স্বীকৃত অবৈধ শাসক 

এরশাদ ছিলেন আদালত কর্তৃক স্বীকৃত অবৈধ শাসক 
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ - ফাইল ছবি

চলে গেলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের এই মৃত্যুকে ঘিরে এখন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে তাকে নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। বার বার ঘুরে ফিরে আসছে এরশাদের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি। জেনারেল এরশাদের শাসন ক্ষমতা যে অবৈধ ছিল, তার পুরো শাসনামলই যে গণতন্ত্র আর শাসনতন্ত্রের প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা, সে বিষয়ে এ দেশের জনতার কোনো সন্দেহ নেই। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়েও এই শাসনক্ষমতা দখলকে অবৈধ বলেই দেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর সপ্তম সংশোধনী বাতিলের এই রায়টি আগামী দিনে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর বিচারের পথ করে দিয়েছে। কিন্তু দেশের আইনবিদরা মনে করেন,  প্রচলিত আইনেও এরশাদের ক্ষমতা দখলের বিচার করা সম্ভব ছিল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু যে মামলাটি করেছিলেন সেটি পুনরুজীবিত করলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যেত। যেটা হাইকোর্টের রায়েও ঈঙ্গিত দেয়া আছে। 

মোশতাক, সায়েম ও জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ ঘোষণার মতো সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকেও ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জারি করা সামরিক শাসন, ওই সময় থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সামরিক আইন, সামরিক বিধি, সামরিক আদেশসহ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সব আদেশ ও নির্দেশকে সংবিধানপরিপন্থী এবং অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেয়ায় এরশাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়ার পথ সুগম হয়। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের ওপর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এ রায় দেন।

রায়ে আরও বলা হয়, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ। তার সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, কার্যক্রম, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের আদেশ অবৈধ। তবে ওই সময়ে জনস্বার্থে নেয়া সিদ্ধান্ত বা কাজকে ক্ষমা করে দিয়ে বৈধতা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য এই ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়েছে,  মার্জনার অর্থ এই নয় যে এসব কাজ বৈধ হয়ে গেল। ভবিষ্যতের জন্য এমন কাজ কেউ করলে তা অবৈধ হবে।

আদালত রায়ে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। জিয়ার উত্তরসূরি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এরশাদ তার দায় এড়াতে পারেন না। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেছেন। সংবিধান স্থগিত করেছেন। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে সামরিক আইনকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন মেনে নেয়া যায় না। এমন কার্যক্রম মার্জনীয় নয়।

আদালত রায়ে বলেন,  অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের সাজা পাওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীসংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে সংসদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে বলেও আদালত মন্তব্য করেছেন। 

আদালত বলেছেন, ভবিষ্যতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রোধ করার জন্য সংসদ সংবিধানে ও দণ্ডবিধিতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের সংজ্ঞা ও শাস্তি নির্ধারণ করে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে ক্ষমতাশীলরা নিরুৎসাহী হবে।

রায়ে আরও বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে সংবিধান কার্যকর করার সময় পর্যন্ত গৃহীত সব কাজকে ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে বৈধতা দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকরা তাদের অবৈধ কাজকে ওই অনুচ্ছেদে যুক্ত করে বৈধতা দিয়েছেন। এই অনুচ্ছেদে ভবিষ্যতে কোনো বিধান যুক্ত করার পথ চিরতরে বন্ধ করা হলো। কোনো সংসদ সংবিধানপরিপন্থী কোনো আইন পাস করতে পারে না এবং বৈধতা দিতে পারে না।  সামরিক আইন, আদেশ অবৈধ হওয়ায় এর অধীন জারি করা সব কাজ, ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা এবং সেই আদালতে বিচারও অবৈধ।

আদালত বলেন, সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের ওপর সামরিক আইনসহ কোনো আইনেরই অবস্থান হতে পারে না।

১৯৮২ সালে সাত্তারের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা নিয়ে এরশাদ দেশে আবার সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, জাতির প্রয়োজনে তিনি ক্ষমতা নেন। অথচ তাকে কেউ ডেকে আনেনি। তিনি সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকার স্থগিত করেন। আবার সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তার সামরিক শাসনামলের সব অবৈধ কাজকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর সংসদের মাধ্যমে বৈধতা দেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ গঠিত হলে ওই সংসদে এরশাদের সব সামরিক ফরমান ও কাজের বৈধতা দেয়ার জন্য সপ্তম সংশোধনী পাস করা হয়।

জেডএইচ/এসএমএম

আরও পড়ুন