• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০১৯, ০৯:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৮, ২০১৯, ০৯:৫৮ পিএম

নতুন গৃহদাহ জাপায়

রংপুরে উপনির্বাচন ঘিরে মুখোমুখি এরশাদের দুই পুত্র!

রংপুরে উপনির্বাচন ঘিরে মুখোমুখি এরশাদের দুই পুত্র!
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দুই পুত্র- (বাঁ থেকে) রাহাগির আল মাহি শাদ ও এরিক -ফাইল ছবি

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই গৃহদাহে জ্বলতে শুরু করেছে দলটি। এরশাদের মৃত্যুর দুদিনের মাথায় তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের একটি গ্রুপ নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এ গৃহদাহ শুরু হয়। জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান মানতে অস্বীকার করে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে বিবৃতি দেন এরশাদপত্নী রওশন, জাপার কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অন্য নেতারা। পরে জি এম কাদের তার ভাবী রওশনের সঙ্গে একান্তে ও পারিবারিক পরিবেশে কথা বলে আপাতত সেই বিরোধ মীমাংসা কতে সক্ষম হন। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে আবারও নতুন করে গৃহদাহ উসকে উঠেছে। দলটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।

গত ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন এরশাদ। ১৬ জুলাই তার রংপুর-৩ আসনটি শূন্য হওয়ার গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, আসন্ন শূন্য হওয়ার দিন থেকেই ৯০ দিন গণনা করা হয়। এক্ষেত্রে আগামী ১১ অক্টোবরের মধ্যে ওই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে।

জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা যায়, এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য রংপুর-৩ আসনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রচণ্ড দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটির সিনিয়র নেতারা। দলের সিনিয়র নেতা ও এরশাদের স্ত্রী রওশন তার ছেলে শাদকে এরশাদের আসন থেকে সংসদ সদস্য বানাতে চান। কিন্তু জাপার অনেক সিনিয়র নেতা ও স্থানীয় জাপার নেতাকর্মীরা তা মানতে নারাজ। তারা চান রংপুরের তৃণমূলকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী দেয়া হোক। 

এদিকে রংপুর-৩ আসনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে গত শনিবার গঠিত পার্টির পার্লামেন্টারি বোর্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন, পার্টির গঠনতন্ত্রে বিভাগ অনুযায়ী সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বোর্ড গঠন করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি।
 
জাপা সূত্রে জানা যায়, এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে এরশাদ-বিদিশাপুত্র এরিককে দিয়ে দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করানো হয়েছে। এ নিয়ে জাপার যুগ্ম মহাসচিব ও রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির দলটির নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন এরিকের মা ও এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী বিদিশা।  

বিদিশা তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল এখন সার্কাসে পরিণত হয়েছে। দলীয় চেয়ারম্যানের একমাত্র উত্তরসূরী প্রতিবন্ধী সন্তানকেও এখন রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতির কাছে আমার প্রশ্ন, যারা এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের বিবেক বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়ে গেছে?’

এদিকে এরশাদপত্নী ও বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ বড় ছেলে রাহাগির আল মাহি শাদকে রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী করতে চান। এরশাদের মৃত্যুর পর বাবার আসনে দুই ভাইয়ের সম্ভাব্য এই মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে জাপার রাজনীতিতে উৎকণ্ঠা বিরাজ করতে শুরু করেছে। 

জানা যায়, এরশাদ পরিবারই এখনও রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নের বিষয়ে একমত হতে পারেননি। পরিবার থেকে মনোনয়ন দৌড়ে শাদ এরশাদ ছাড়াও ভাতিজা (ছোট ভাইয়ের ছেলে) সাবেক এমপি আসিফ শাহরিয়ার, ভাতিজা (মামাতো ভাইয়ের ছেলে) মেজর (অব.) খালেদ আখতার, ভাগনি (এরশাদের বোন মেরিনা রহমানের মেয়ে) মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পাও নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।

পরিবারের বাইরে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি এসএম ইয়াসিরকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানিয়ে এরইমধ্যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত এ আসনে মনোনয়ন পেলেই বিজয়ী হবেন এমনটা ধরে নিয়ে লবিয়িং-তদবির বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রার্থীরা। অনেকেই পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের কাছে নিয়মিত ধর্ণা দিচ্ছেন।
 
সূত্র জানায়, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ রয়েছে প্রয়াত এরশাদের সহোদর ও পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের। সেক্ষেত্রে এ আসনে অনেক হিসাব-নিকাশ করে মনোনয়ন দিতে চান তিনি।

জানা যায়, গত ২০ আগস্ট মঙ্গলবার রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় যান জি এম কাদের। এ সময় জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাও জি এম কাদেরের সঙ্গে ছিলেন। সেখানে পার্টির চেয়ারম্যানের পদ ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নিয়ে তারা নিজেদের মাঝে সমঝোতা করে নেন। কিন্তু শনিবার হঠাৎ করেই সিনিয়রিটি না মেনে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করায় সেই সমাঝোতা ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

জাপা সূত্রে জানা যায়, বোর্ডে যাদের রাখা হয়ে তাদের অনেকেই পার্টিতে নবীন। অনেক সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতাদের রাখা হয়নি। যাদের নাম রাখা হয়েছে তাদের বেশিরভাগেই সর্বশেষ প্রেসিডিয়াম ও এমপিদের যৌথসভায় জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যানের পাশাপাশি বিরোধীদলের নেতা বানানোরও দাবি জানান।

এ সব বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য একটি বোর্ড গঠন করে দিয়েছি। তারাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। বোর্ড গঠনে পার্টির গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী সিনিয়রিটি মানা হয়নি- এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, সিনিয়রদের নিয়েই করতে হবে এমনটি অত্যাবশকীয় নয়। প্রয়োজনে গঠনতন্ত্রও পরিবর্তন হতে পারে। 

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, পার্টির যৌথ সভায় আলোচনা হয়েছে। তৃণমূল থেকে চারটি নাম চাওয়া হয়েছে। চারটি নাম থেকেই পার্লামেন্টারি বোর্ড একজনকে চূড়ান্ত করবেন।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, এরশাদ পরিবার বা পরিবারের বাইরে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হোক না কেন রংপুরের তৃণমূলের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। 

এ বিষয়ে রংপুর মহানগর জাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, রংপুরের মানুষ এরশাদের পরে তার পরিবারে জি এম কাদের ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। 

রংপুর জাপা সূত্র জানায়, এরশাদ মৃত্যুর আগে সর্বশেষ মার্চের ৩ তারিখ রংপুরে যান। ৪ তারিখে রংপুর গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেলে জেলা ও মহানগরীর যৌথ সভায় আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এরিক আমার একমাত্র সন্তান। রংপুরের সবাই আমার সন্তান সমতুল্য। আমার মৃত্যুর পর পল্লীনিবাসে আমাকে শায়িত করবে। তোমরা আমার এরিককে দেখে রাখবে।

এসময় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) খালেদ আখতার, মেয়র মোস্তাফিজার রহমান ও তার সহধর্মিণী, এসএম ইয়াসির, লোকমান হোসেন, ছাত্র সমাজের আহ্বায়ক আসিফসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।  

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জাপার পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রসঙ্গত. এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার দুই বছর পর রওশন এরশাদের পুত্র সাদের জন্ম হয় বঙ্গভবনে ! ১৯৯৮ সালে বিদিশাকে বিয়ে করেন এরশাদ। এর বছর দুই পর এরশাদ-বিদিশা ঘরে এরিকের জন্ম হয়।

টিএস/ এফসি

আরও পড়ুন