• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯, ০৩:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯, ১১:৪২ এএম

কাউন্সিলেও হাওয়া ভবনের থাবা

হাইকমান্ডের চেষ্টায়ও সিন্ডিকেটের বাইরে যেতে পারছে না ছাত্রদল!

হাইকমান্ডের চেষ্টায়ও সিন্ডিকেটের বাইরে যেতে পারছে না ছাত্রদল!

বিএনপির হাইকমান্ড বিশেষ করে লন্ডনে নির্বাসিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আপ্রাণ চেষ্টার পরও নেতৃত্ব নির্বাচনে ‘তথাকথিত বড়ভাই’ ও ‘সিন্ডিকেটে’র বাইরে যেতে পারছে না ছাত্রদল। অভিযোগ উঠেছে, কাউন্সিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চাচ্ছেন কাউন্সিলরদের কাছে। এদের অনেকেই বহুল বিতর্কিত সেই ‘হাওয়া ভবন’ এর সুবিধাভোগী। যা নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন অনেকে।

দীর্ঘ ২৭ বছর পর আন্দোলন-সংগ্রামে একসময়ে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তি প্রশ্নে আন্দোলনে ব্যর্থতার পর হঠাৎ একসময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী এ সংগঠনটির দিকে নজর দেয় হাইকমান্ড। সেই কারণে সাতাশ বছর পর এবারই প্রথম কাউন্সিল ও নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গঠনের এ উদ্যোগ। ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে এরইমধ্যে সংগঠনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সমন্বয়ে নির্বাচন পরিচালনায় কয়েকটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছে হাইকমান্ড। উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক ও ভোটের মধ্যদিয়ে সংগঠনটির আগামীর নেতৃত্ব বের করে আনা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ডের শত চেষ্টার পরও ‘সিন্ডিকেটে’র বাইরে আসতে পারছে না ছাত্রদল। আগামীর নেতৃত্বেও তাই ‘বড় ভাই’ বা ‘সিন্ডিকেটে’র নিয়ন্ত্রণের বাইরে না আসার আশঙ্কাই অনেকের।

ছাত্রদলের কাউন্সিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দৈনিক জাগরণকে বলেন, জাতীয়-উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকী পেশাজীবীদের নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অবাধ হচ্ছে না। আসলে দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন নেই। আমরা ছাত্রদলের নেতৃত্ব বাছাইয়ের নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।

‘ছাত্রদলের আগামী কমিটিও সিন্ডিকেটের কবলে কি না’ এমন প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় এই সভাপতি বলেন, আমরা এই নির্বাচনটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। তবে এটা ঠিক, এরইমধ্যে অবশ্য অনেকেই চেষ্টা করছেন নির্বাচনটা বিতর্কিত করতে। 

জানা গেছে, ছাত্রদলের কাউন্সিল স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতে হাইকমান্ডের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যে কারণে দলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেকটা সতর্ক অবস্থানে। তবে নেপথ্যে থেকে ‘বড় ভাই’ এবং ‘সিন্ডিকেটে’র সদস্যরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নেতা বানাতে মরিয়া। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর কাউন্সিল ও ভোটের মাধ্যমে ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতৃত্ব- সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার কথা।

ছাত্রদলের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন- কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, হাফিজুর রহমান, মাহমুদুল হাসান বাপ্পী, রিয়াদ মো. তানভীর রেজা রুবেল, মো. এরশাদ খান, মো. ফজলুর রহমান খোকন, এসএম সাজিদ হাসান বাবু ও এবিএম মাহমুদ আলম সরদার। এছাড়া, পরবর্তীতে আপিলের মাধ্যমে সভাপতি পদে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন মো. মামুন খান। 

এদিকে, ১৯ সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শাহ নেওয়াজ, জুয়েল হাওলাদার (সাইফ মাহমুদ জুয়েল), আমিনুর রহমান আমিন, তানজিল হাসান, শেখ আবু তাহের, জাকিরুল ইসলাম জাকির, মোহাম্মদ কারিমুল হাই (নাঈম), মাজেদুল ইসলাম রুমন, ডালিয়া রহমান, সাদিকুর রহমান, কেএম সাখাওয়াত হোসাইন, সিরাজুল ইসলাম, মো. ইকবাল হোসেন শ্যামল, মুন্সি আনিসুর রহমান, মো. মিজানুর রহমান শরিফ, শেখ মো. মশিউর রহমান রনি, মোস্তাফিজুর রহমান, সোহেল রানা ও কাজী মাজহারুল ইসলাম।

ছাত্রদলে সূত্রে জানা যায়, সভাপতি পদে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সমর্থিত প্রার্থী। হাফিজুর রহমান হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ সমর্থিত প্রার্থী। মো. ফজলুর রহমান খোকন বিতর্কিত ‘হাওয়া ভবন’ এর অন্যতম সহযোগী বগুড়ার আতিকুর রহমান রুম্মন ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমর্থিত প্রার্থী। মো. এরশাদ খান বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক তারেক রহমানের ব্যক্তিগত আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সমর্থিত প্রার্থী। তানভীর রেজা রুবেল বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার সমর্থিত প্রার্থী। এ ছাড়া বাকি প্রার্থীরাও কেউ কেউ না কেউ বিভিন্ন নেতার আশীর্বাদপুষ্ট বলে আলোচনা আছে। 

সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের মধ্যে শাহ নেওয়াজ ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ ও বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী সমর্থিত প্রার্থী বলে আলোচিত। জুয়েল হাওলাদার (সাইফ মাহমুদ জুয়েল) ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বর্তমানে যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন সমর্থিত প্রার্থী। তানজিল হাসান ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি হাসান মামুন ও ২০ দলীয় জোটের শরিক একটি দলের চেয়ারম্যান সমর্থিত প্রার্থী। মো. ইকবাল হোসেন শ্যামল হাওয়া ভবনের আরেক বিতর্কিত সহযোগী বেলায়েত হোসেন ও ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুর আশীর্বাদপুষ্ট। আমিনুর রহমান আমিন হাওয়া ভবনের বিতর্কিত সুবিধাভোগী রফিকুল ইসলাম বকুল ও আজিজুল বারী হেলাল সমর্থিত প্রার্থী। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব ও সদ্যবিলুপ্ত কমিটির সাবেক সভাপতি রাজীব আহসান সমর্থিত প্রার্থী জাকির হোসেন। এসব প্রার্থী ছাড়াও বাকি সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থীরাও কেউ কেউ বিএনপির হেভিওয়েট কোনো নেতার আশীর্বাদপুষ্ট বলে ছাত্রদলে আলোচনা আছে। 

সূত্রে জানা যায়, ভোটের মাধ্যমে সারাদেশের ছাত্রদলের ১১৭টি সাংগঠনিক জেলার/ইউনিটের সুপার ফাইভ ৫ জন নেতা (সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি, প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করবে। সারাদেশে সংগঠনটির কাউন্সিলর মোট ৫৮০ জন।

ছাত্রদল প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকে প্রত্যেক প্রার্থী দেশের আনাচে-কানাচে এসব কাউন্সিলর ও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছেন। প্রতিটি ভোটারকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করছেন। সেক্ষেত্রে অনেকে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। দেদারছে খরচও করছেন। আর এসব খরচের প্রায় শতভাগই সরবরাহ করছেন প্রত্যেক প্রার্থীর ‘বড়ভাই’ বা ‘সিন্ডিকেট’। প্রায় প্রত্যেক প্রার্থী একাধিক সফরসঙ্গী নিয়ে ভাড়া করা গাড়িতে কাউন্সিলরদের কাছে ঘুরছেন। 

ছাত্রদলের নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থীদের খরচ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন সাবেক ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবকদল নেত্রী মুন্নি চৌধুরী মেধা। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে ৮টা বিভাগ, ৬৪টি জেলা। যারা জেলায় জেলায় নেতাকর্মীদের কাছে ভোট চাইতে বা দেখা করতে যাচ্ছেন তাদের তো অনেক টাকা পয়সার দরকার। একটা জেলায় ৫ জন মানুষ যেতে জনপ্রতি ২,০০০ টাকা খরচ ধরলে ১০,০০০ টাকা লাগে। থাকা খাওয়া, গাড়ি ভাড়া, পোলা পাইনরে পেপসি খাওয়ান ইত্যাদি মিলায়া ৬৪x১০০০০= ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ। এটা মিনিমাম ধরলাম বাকিটা ইতিহাস —!  মুন্নি আরও লিখেছেন, ছাত্রদলের যারা নির্বাচনে প্রার্থী এবং যারা জেলায় জেলায় যাইতেছে তারা এত টাকা খরচ করে কীভাবে? তাদের এ টাকার উৎস কী? বয়সও নাকি ত্রিশের কম!!! টাকা পাইল কৈ —-!???? টাকা কি বলদের ‘,,,দি’ আসে—????? টাকা আমরাও খরচ করছি ছাত্রদলে থাকতে—! আমরা এক কাপ চা কিনা দুই জন খাইতাম, একটা রিক্সা ভাড়া করে চারজন ভাগ করে দলীয় কর্মসূচিতে যাইতাম। এখন নিজে কাজ করে টাকা কামাই। টাকা কামানো জিনিসটা তো অত সহজ না। জেলখানায় কত নেতাকর্মি মামলা চালাইতে পারে না। তাদের সাহায্য করার বেলায় লোক খুঁজে পাওয়া যায় না অথচ —-!

‘ছাত্রদলের আগামী কমিটিও সিন্ডিকেটের কবলে কী না’ এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বর্তমানে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘ছাত্রদলে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। ছাত্রদল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শে এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সরাসরি তত্ত্বাবধানের সংগঠন। ছাত্রদলে কোনো ‘ভাই বা সিন্ডিকেট’ হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগই নেই।
 
ড. রিপন বলেন, আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, সুন্দর কাউন্সিল অনুষ্ঠানের স্বার্থে আমাদের অবস্থান নির্মোহ ও পক্ষপাতহীন এবং কোনোক্রমেই কোনো বিশেষ প্রার্থীর প্রতি আমাদের কোনো অনুরাগ বা আনুকূল্য নেই। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার এ প্রক্রিয়ায় আমরা বিশ্বাস করি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের যোগ্য নেতৃত্ব কাউন্সিলরগণ বেছে নিতে তাদের বিবেক ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাবেন।

ছাত্রদলের কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচন কমিশানার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমাদের দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা একটা সফল কাউন্সিলের দিকে যাচ্ছি। তাতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাদের বিরোধীপক্ষ নানাভাবে ছাত্রদলের কাউন্সিলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ডাকসুর সাবেক জিএস খোকন আরও বলেন, আমরা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করবো, ইনশাল্লাহ।

টিএস/ এফসি

আরও পড়ুন