• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০১৯, ০৯:৩৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২১, ২০১৯, ০৯:৩৭ এএম

ধর্মের নামে অস্থিরতা তৈরিতে লিপ্ত একটি স্বার্থান্বেষী মহল

ধর্মের নামে অস্থিরতা তৈরিতে লিপ্ত একটি স্বার্থান্বেষী মহল
ভোলায় পুলিশের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ- ফাইল ছবি

গুজবে কান দিয়ে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা ঈদগাহ মাঠে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পুলিশসহ সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় কড়া প্রহরায় রয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সরকারি অফিস আদালত, ব্যাংক বীমা ও স্পর্শকাতর এলাকায় র‌্যাব, ডিবি ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন রাখা হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মের নামে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। 

এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (২১ অক্টোবর) সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে, পুরানা পল্টন মোড়, প্রেসক্লাবসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করতে পারে।এছাড়া দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিক্ষোভ করবে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে এ সতর্ক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।  

রোববার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেল রানা এ তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে দেশের প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের বরাবরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। যাতে করে এ অজুহাতে কোন মহল বা গোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করতে পারে। 

সোহেল রানা বলেন, সার্বিক ঘটনা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, পুলিশ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে শুরু থেকে তৎপর থাকা সত্ত্বেও আলেম সমাজ পুলিশ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে কর্মসূচি স্থগিত করেছে।কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মকে পুঁজি করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকায় আতঙ্ক রয়েছে। ঘটনাস্থলসহ সারাদেশে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, কোষ্টগার্ড সদস্য ও গোয়েন্দারা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
 
তিনি বলেন, ভোলার বোরহান উদ্দিনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, এসবি, পিবিআই এবং জেলা পুলিশের একজন করে মোট চারজন সদস্য রয়েছেন। কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে এ ঘটনার প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এঘটনার জন্য সমবেদনা জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। এ ঘটনা সংক্রান্ত যে কোনো বিভ্রান্তি এড়াতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স প্রকৃত ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছে।

এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গতকালের যুবলীগের মিটিং শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, মহানবীকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিলে কোন ছাড় নয়। তবে গুজবে কান না দিয়ে বুঝে শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে।  
এদিকে ভোলার বোরহান উদ্দিনের হতাহতের ঘটনার জেরে গতকাল রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় হেফাজতকর্মীরা সড়ক অবরোধ করে। তারা স্থানীয় থানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এতে করে দুজন সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। 

গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার প্রেক্ষিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য (২৫) নামে এক যুবক রাত ৮টা ৫ মিনিটে বোরহানউদ্দিন থানায় জিডি করেন। জিডি নং-৪৪০। জিডির সময় থানায় অবস্থানকালেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের নম্বরে একটি কল আসে এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সে ওসিকে জানায়। ওসি বিষয়টি ভোলার এসপিকে অবহিত করেন। 

এঘটনায় তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে সেদিন রাতেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে কলকারী শরীফ এবং ইমন নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বোরহানউদ্দিন থানায় নেয়া হয়।

এদিকে বিপ্লব বৈদ্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কথিত কমেন্টের জেরে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা উত্তেজিত হতে থাকেন। ফেসবুকে ধর্মীয় মন্তব্যের অভিযোগে মন্তব্যকারীর ফাঁসি দাবি করে স্থানীয় আলেম সমাজ।রোববার (২০ অক্টোবর) বেলা ১১টায় ঈদগাহ মাঠে তারা প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক, ইউএনও, থানার অফিসার ইনচার্জ ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিসহ আলেম সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বোরহানউদ্দিন থানায় দীর্ঘ সময় বিষয়টি আলোচনা হয়। আলেম সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যকে আটক দেখানো হয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আলেম সমাজ পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচি বাতিল করেন।

এ সমাবেশ বাতিল ঘোষণার পর পুলিশ  কর্মকর্তারা তাদের সভা মঞ্চ থেকে নেমে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান। এসময় পেছন থেকে কতিপয় ব্যক্তিরা পুলিশের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার দোতালায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। হামলাকারীরা সেখানে গিয়েও পুলিশের উপর হামলে পড়ে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। 

এদিকে গতকাল রোববার সকাল থেকেই কিছু লোক ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকে। ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে টাঙানো হয় মাইক। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সমবেত লোকজনকে সরিয়ে নিতে বললে উপস্থিত আলেমরা নিশ্চিত করেন, লোকজন কোনো রকম বিশৃঙ্খলা করবে না। ইতোমধ্যেই, এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এবং যে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা দিতে সকালেই বরিশাল থেকে রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ভোলায় আসেন। অতিরিক্ত ডিআইজি ও ইউএনওকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে তাদের বার বার আশ্বস্ত করেন। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সমবেত লোকজন ঈদগাহ ময়দান ত্যাগ করেন। উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শেষে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা মাদরাসার একটি কক্ষে অবস্থান নেন।

এরই মধ্যে অন্য একটি গ্রুপ ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশ করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকেন। তারপর একদল লোক বিনা উস্কানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীদের একদল আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও অন্য কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়। আক্রমণকারীদের গুলিতে বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিসহ পুলিশের দুই সদস্য আহত হন।

এমন পরিস্থিতিতে ইউএনও ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্টেটের নির্দেশে আত্মরক্ষার্থে, সরকারি জানমাল রক্ষার্থে ও উত্তেজিত লোকজনকে নিবৃত্ত করতে প্রথমে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও পরে শটগানের গুলি চালায় পুলিশ। পরবর্তীতে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। আক্রমণকারীদের গুলিতে মারাত্মক আহত পুলিশের এক সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ঘটনায় নিহত চারজনের মধ্যে অন্তত দুই জনের মাথা ভোতা অস্ত্র দ্বারা থ্যাতলানো বলে নিশ্চিত করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

সার্বিক ঘটনা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, পুলিশ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে শুরু থেকে তৎপর থাকা সত্ত্বেও এবং আলেম সমাজ পুলিশ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে কর্মসূচি স্থগিত করলেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মকে পুঁজি করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনাস্থল সারাদেশের বিভাগীয় এবং জেলা শহরে পুলিশসহ  আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে।

এইচএম/বিএস 
 

আরও পড়ুন