• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০১৯, ০৮:২৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১২, ২০১৯, ০৮:৩৫ পিএম

নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি, সংসদে রাঙ্গাকে তুলোধুনা 

নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি, সংসদে রাঙ্গাকে তুলোধুনা 
১০ নভেম্বর জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গা - ছবি : টিভি থেকে নেয়া

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহীদ নূর হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব ও সংসদের বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে পয়েন্ট অব অর্ডারে তুলাধুনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) জাতীয় সংসদের অধিবেশনে রাঙ্গাকে তুলাধুনা করে ক্ষমা চাইতে বলেন সংসদ সদস্যরা। একইসঙ্গে তাকে জাপা থেকে বহিষ্কার এবং তার এই ধরনের কটূক্তিতে জাপার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদে তার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সংসদ সদস্যরা।

অধিবেশন চলাকালীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি রাঙ্গার দল জাপার সিনিয়র সদস্যরাও তাকে তুলাধুনা করেন। পাশাপাশি রাঙ্গা কীভাবে সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ এবং জাপা মহাসচিব হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন জাপার এমপিরা।

মাগরিবের নামাজের বিরতির পর অধিবেশনে পর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এই প্রসঙ্গ টেনে তাহজীব আলম সিদ্দীকি বলেন, নূর হোসেন দিবসে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন জাপা মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। নূর হোসেনকে হত্যার পর সারাদেশের আনাচে-কানাচে স্বৈরারাচারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজারো নূর হোসেনের জন্ম হয়। সেই নূর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। একইসঙ্গে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।

এরপর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাঙ্গা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, যেটাতে বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার ঘটনার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় এবং মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি অবাক হলাম- রাঙ্গা বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নূর হোসেনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অথচ রাঙ্গা ভুলে গেছেন এরশাদও নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিল। রাঙ্গা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। তার এই বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। 

তিনি বলেন, এরশাদের বক্তব্যের জন্য আমরা প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু রাঙ্গার বক্তব্যের কারণে সারাদেশে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারণ হচ্ছে। রাঙ্গা যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকায় আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে না থাকলে নির্বাচিত হতে পারতেন কি না সেটা আমরা বলতে চাই না। রাঙ্গা খুবই খারাপ বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তার বক্তব্যে ঘৃণা প্রকাশ করি। সবাই এখন স্বৈরাচারী এরশাদ বলছে। একজন সুস্থ মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন, তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও নূর হোসেনকে নিয়ে এই বক্তব্য দেয়া সম্ভব না।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। রাঙ্গা সেই চেষ্টা করেছেন। নূর হোসেন হত্যা যখন হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল-ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু-এর কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু-এর মূলহোতা ছিল এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারে না। এরশাদের সময় রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্যাতন ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাদেশের মানুষ তাকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করেছে। বিশ্বে স্বৈরাচার বলে পরিচিতি পেয়েছে। রাঙ্গাকে অবশ্যই তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন রাঙ্গা। কথায় আছে ‘রতনে রতন চেনে...’। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নূর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি। তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে তিনি সংসদে এসে বসতে পারতেন না। একথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বৈরাচার-দালালদের চরিত্র পরিবর্তন হয় না। এর জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, রাঙ্গা যে কথা বলেছেন, এটা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে কথা বলার আগে তার চিন্তা করা দরকার ছিল। রাঙ্গার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত করেছে। তাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না, জাতীয় পার্টিতে তার এই বক্তব্যের ক্লারিফিকেশন দিতে হবে।

তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, মনে হয় রাঙ্গা শুধু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, দেশের স্বাধীনতা, সংসদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে অপমান করেছেন। তার এই বক্তব্যের জন্য যদি জাতীয় পার্টি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। রাঙ্গাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি ক্ষমা না চাইলে জাতীয় পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করতে হবে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বান্দরকে লাই দিলে গাছের মাথায় ওঠে। আমি যতদিন রাজনীতি করি ততদিন ওর (মসিউর রহমান রাঙ্গা) বয়সও না। ও এই ধৃষ্টতা দেখায় কীভাবে, এই দুঃসাহস কীভাবে পেল? এই সংসদই তাকে লাই দিয়েছে।

কাজী ফিরোজ রশীদ আরও বলেন, সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা সম্পর্কে বক্তব্য হয়েছে। তার বক্তব্য আমি শুনেছি, আমি সেদিন সভায় ছিলাম না। পরে এটা ভাইরাল হয়ে গেছে। এই বক্তব্য জাতীয় পার্টির বক্তব্য না। এটা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য হতে পারে না। এটা রাঙ্গার নিজস্ব বক্তব্য হতে পারে। এই বক্তব্যের জন্য জাতীয় পার্টি লজ্জিত। আমরা দুঃখিত এবং অপমানিত অনুভব করছি।

তিনি বলেন, নূর হোসেন ’৯০-তে তার জীবন দিয়ে গেছেন। যে যুবক গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতে পারেন, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারেন সেই সাহসী যুবকের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। আমরা কখনো এই ধরনের ধৃষ্টতা দেখাই নাই। এই ধরনের অপমানজনক কথা কখনো বলি নাই। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্য হতে পারে না।

ফিরোজ রশীদ বলেন, একটি কথা আছে- বান্দরকে লাই দিলে গাছের মাথায় ওঠে। এই লাই আমরা দেই নাই। এই লাই এই সংসদই দিয়েছে। যাদের অতীত নাই, বর্তমানে কিছুই ছিল না। হঠাৎ তাকে মন্ত্রী বানানো হলো, একটার পর একটা প্রমোশন দেয়া হলো। আমরা তো তাজ্জব হয়ে গেলাম! এগুলো আমরা দিইনি। এই সংসদে সে চিফ হুইপ। আমি একদিন বললাম- তাজুল ইসলাম চৌধুরী মারা গেছেন, তার বিষয়ে বক্তব্য রাখব। সে বলে- আপনি দেবেন, আমি কেন নাম পাঠাব। এই ধৃষ্টতা সে দেখাতে পারে!

তিনি বলেন, আমি যতদিন রাজনীতি করি ততদিন ওর বয়সও না। সে করেছে যুবদল। কোথায় আন্দোলন করেছে? কোথায় সংগ্রাম করেছে? শুধু তাই না, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কেও সে কথা বলেছে। সে গণতন্ত্রের ছবক দেয়। যে লেখাপড়া করে নাই, রাতারাতি কাগজের মালা গলায় দিয়ে পরিবহনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে হঠাৎ করে এখানে এসে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে গেছে। সে এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখায়। আর তার জবাব দিতে আজ সংসদে দাঁড়াতে হয়। আজকে খুব লজ্জিত। এটা সম্পূর্ণ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আমরা দুঃখিত। নূর হোসেনের গায়ে লেখাটা ছিল একটা পোস্টার। সারা বিশ্বের লোক দেখেছে। এটা ছিল তার মনের কথা।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমাদের যৌবনের ধর্মই হলো আন্দোলন-সংগ্রাম। কতজন পারে তার জীবন বিলিয়ে দিতে? সেই নূর হোসেন সম্পর্কে যে কথা বলেছে তাকে ‘ওউন’ (নিজের বলে স্বীকার) করি না। আমাদের দল এটাকে গ্রহণ করে না। আমরা চরম ঘৃণাভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা লজ্জিত। দুঃখ প্রকাশ করছি। এটা তার ব্যক্তিগত কথা। এ জন্য দল তার দায়িত্বে নেবে না। এ দেশের মানুষ মনে করে বঙ্গবন্ধুকন্যা আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আমি বিরোধী দল করতে পারি। প্রত্যেকটি মানুষ মনে করে, যতদিন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন ততদিন এই দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে। ততদিন এই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে এবং এই দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করেছি। আমাকে যদি প্রধানমন্ত্রী সেদিন পরিচয় করিয়ে না দিতেন, আমার জন্য যদি ভোট না চাইতেন আমি নির্বাচিত হয়ে এই সংসদে আসতে পারতাম না। মানুষ এত অকৃতজ্ঞ হয় কীভাবে? রাঙ্গা সাহেব পাস করেছেন, মনে করছেন তার নিজের জোরে। পিছে যদি আওয়ামী লীগ না থাকত, ওই রংপুরে নামতেও পারত না। কার কত ভোট আছে আমাদের জানা আছে। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমি জাতীয় পার্টি করি, আমার নেতা এরশাদ। রাঙ্গা যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে পরিষ্কার করতে চাই- আমাদের পার্টি চেয়ারম্যান রয়েছে। তার বক্তব্যটা দলীয়ভাবে ‘ওউন’ করে না; এটা বক্তব্য তার ব্যক্তিগত।

তিনি বলেন, শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে জাতীয় পার্টির কী দৃষ্টিভঙ্গি- তা তৎকালীন চেয়াম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে নূর হোসেনের বাড়ি গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন, পরিবারকে সাহায্য করেছেন। এটা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি।

এইচএস/ এফসি

আরও পড়ুন