• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০১৯, ০৯:৪৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৭, ২০১৯, ১০:১৫ এএম

ফিরে দেখা ’৯০ (এক)

এরশাদের গুণ্ডাবাহিনীর গুলিতে মিলনের মৃত্যু, সারাদেশে ক্ষোভ

এরশাদের গুণ্ডাবাহিনীর গুলিতে মিলনের মৃত্যু, সারাদেশে ক্ষোভ
স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলিবিদ্ধ ডা. শামসুল আলম খান মিলন - ছবি : ফেসবুক থেকে নেয়া
অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি অবস্থা জারি
হাসিনা গৃহবন্দি, সাংবাদিকদের ধর্মঘট পালনের ঘোষণা

সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর সারা দেশে বিক্ষোভ এবং গণআন্দোলন ক্রমান্বয়ে তীব্র হতে থাকে। ২৭ নভেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাবাহিনী মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে হত্যা করলে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন বারুদের মতো জ্বলে ওঠে। অবস্থা অবেগতিক দেখে এরশাদ সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। আর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করা হয়। 

অন্যদিকে ১৯৯০ সালের এই দিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সকল সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ জারি করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে সাংবাদিকদের লিখিত প্রতিবেদন দেখিয়ে ছাড়পত্র আনার বিধান করা হয়। এরই প্রতিবাদে বিএফইউজে ও ডিউজের ডাকে সাংবাদিকরা এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেয়। ফলে সারাদেশে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। এদিকে কারফিউ ভঙ্গ করে হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে মিছিল-সমাবেশ করে। এ সময় পুলিশ এবং বিডিআরের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকরা ধর্মঘট পালন করার আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে বাংলাদেশের মানুষ দেশের সঠিক চিত্র দেশের গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে জানতে পারেনি। এ সময় এদেশের মানুষের প্রধানতম ভরসা ছিল বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার থেকে সম্প্রচারিত বাংলা সংবাদ। এদিন বিবিসি- হাসিনা অন্তরীণ, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হুশিয়ারি এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারির ঘটনাসমূহ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। প্রতিবেদন দুটি হুবহু তুলে ধরা হলো- 

হাসিনা অন্তরীণ 
আজ বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গৃহান্তরীণ রাখা হয়েছে বলে তার দল থেকে খবর দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেছেন। দেশে কোনো জরুরি অবস্থা আরোপিত হলে লাগাতার ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হবে বলে আজ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এক ঘোষণায় জানিয়েছে। বিরোধী জোটসমূহ আগামীকাল ঢাকাতে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দিয়েছে এবং হত্যা, গ্রেফতার ও গৃহান্তরীণের প্রতিবাদে আগামী শনিবার হরতালেরও আহ্বান দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করা হলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বা বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। বিএনপির নেতারা বলেছেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে বেগম খালেদা জিয়া তার বাসভবন থেকে গাড়িতে করে চলে যান। তিনি এখন কোথায় আছেন তা জানা যায়নি। 

বিরোধীদলীয় ৩টি জোট প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে এবং এরশাদবিরোধী বর্তমান আন্দোলনের সময় যে সমস্ত খুনোখুনি হয়েছে তার প্রতিবাদে একগোছা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। মনে হচ্ছে যে জোট ৩টি এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। এই কর্মসূচি অনুযায়ী পহেলা ডিসেম্বর দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হবে। জোট ৩টি বলেছে, সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে, যদিও তার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন, যদি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় তবে যেন তার পর দিন থেকেই জনগণ অদির্নিষ্টকালের জন্য হরতাল শুরু করে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ত্রধারীদের আক্রমণ ও তার ফলে গতকাল দুজনের নিহত হবার ফলে এবং বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আজ সন্ধ্যায় ঢাকা শহরে অনেকগুলো বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হচ্ছিল। হাজার হাজার লোক রাস্তায় নামে এবং কোনো কোনো জায়গায় সহিংসতাও দেখা দেয়। 

এদিকে, পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টুকে ঢাকায় তার বাসভবনে গ্রেফতার করেছে। তাকে নিয়ে যাবার সময় জনতা পুলিশকে বাধা দিলে পুলিশ কাদুনে গ্যাস ছোড়ে এবং ঐ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষ শুরু হয়। 

এদিকে যে সকল অস্ত্রধারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েছিল তাদের এবং পুলিশের গুলিতে আজ সকালে কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছেন। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অস্ত্রধারীদের ধাওয়া করার সময় সরকারবিরোধী ছাত্ররা তাদের দিকে গুলি ছুড়লে পুলিশ গুলি করে। 
গত দুদিন ধরেই এই অস্ত্রধারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধী ছাত্রদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। এদের নেতৃত্বে ছিল অল্পকিছু যুবক, যাদেরকে বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ছাত্র সংগঠন থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে পুলিশ ও বিডিআরকে মোতায়েন করা হয়েছে কিন্তু গুলি করে যারা এসব খুন করেছে তাদের কাউকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। 
বিবিসি ২৭/১১/১৯৯০


অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি
আতাউস সামাদ আমাদের জানিয়েছেন যে, আজ স্থানীয় সময় রাত ৯টা থেকে কারফিউ বলবৎ করা হচ্ছে এবং জানা যায় যে শেখ হাসিনাকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সংক্ষিপ্ত করে সংবাদাতাদের বলেন যে, তার গমনাগমন বন্ধ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার থেকে তার কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। তিনি বলেন, আন্দোলন অব্যাহত থাকবে এবং আমরা আরো জানতে পেরেছি যে জরুরি অবস্থা বলবৎ হলে সাংবাদিকরা কাজ থেকে বিরত থাকবেন। 

ডা. শামসুল আলম খান মিলন

আজ ঢাকাতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশে মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের যুগ্মমহাসচিব বিক্ষোভ চলাকালে শরীরের পেছন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হন। 

সশস্ত্র ব্যক্তিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের গুলি ছোড়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সরকারি নীতির বিরুদ্ধে ডাক্তারদের এক প্রতিবাদ মিছিলে যোগদিতে তিনি বিএমএ-এর মহাসচিব মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সাথে একটি সাইকেল রিক্সায় করে পিজি হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন।
 
বিএমএ-এর আহ্বানে স্বাস্থ্যনীতির প্রতিবাদে ডাক্তাররাও আজ ২৪ ঘণ্টা ধরে ধর্মঘট করছিলেন। ডা. শামসুল আলম খান মিলন ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওলজি বিভাগের শিক্ষক। তাকে হত্যা করায় বিএমএ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক ফেডারেশন এবং ডাক্তারদের অন্যান্য পেশাদারী সংস্থা এখন থেকে দেশের সব হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালনের ঘোষণা করেছেন। 

আজ সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় ৩ জোট ডা. শামসুল আলম খানকে খুন করার প্রতিবাদে আগামীকাল ঢাকা শহরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয়। বিএমএ আগামীকাল দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতালের আহ্বান জানায়। 

এক সমাবেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ঘোষণা করেন তিনি ও কলেজের অন্যসব শিক্ষক সরকারের কাছে তাদের পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন।
বিবিসি ২৭/১১/১৯৯০

এফসি

আরও পড়ুন