• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০১৯, ১১:৫১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১, ২০১৯, ১২:০০ পিএম

ফিরে দেখা ৯০ (পাঁচ)

গণআন্দোলনে পদত্যাগের মুখে এরশাদ 

গণআন্দোলনে পদত্যাগের মুখে এরশাদ 

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে টানা ৫ দিন কারফিউ ও জরুরি বিধি অগ্রাহ্য করে তিন জোটের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মুখে এদিন (১ ডিসেম্বর) স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যাগ অনেকটা নিশ্চিত হয়। এই দিনে (১ ডিসেম্বর) দেশে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে হরতালে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে বহু লোক হতাহত হন।

একমাত্র মিরপুরেই বিডিআর-এর গুলীতে ছাত্র, গার্মেন্টস শ্রমিক ও ইটভাঙ্গা শ্রমিকসহ নিহত হয় ৮ জন। আর চট্টগ্রামে কালুরঘাট এলাকায় শ্রমিকদের মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১ জন। খুলনায় এরশাদের কুশপুত্তলিকা বহনের সময় নিহত হন রিকশাচালক মহারাজ (২০)।

সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমাবেশ। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে এদিন উত্তাল ছিল রাজধানী ঢাকা। গণআন্দোলন প্রতিহত করতে এদিন চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে স্থাপন করা হয় সেনাক্যাম্প। খুলনায় সকাল ১১টায় বুলেট বিদ্ধ হয় ৩ বিক্ষোভকারী। দৌলতপুর-খালিশপুরে ব্যারিকেড গড়ে তোলে জনতা। পুলিশি হামলায়  আহত হয় দেড় শতাধিক। গ্রেফতার করা হয় প্রায় ১শ জনকে।

২৭ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি এবং সংবাদ প্রকাশে কড়া সেন্সর আইন বলবৎ করায় এর বিরুদ্ধে ওই দিন থেকে সব পত্রপত্রিকা, এমনকি সরকারি সংবাদ সংস্থা (বিএসএসও) ধর্মঘট পালন শুরু করে। ফলে দেশে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধের বিষয়টি এদিনও অব্যাহত থাকে।

গণআন্দোলনের দিনগুলোতে তথ্য জানা বিষয়ে তখন এদেশের মানুষে প্রধানতম ভরসা ছিল বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদ। এদিন বিবিসি ‘বিরোধী আন্দোলনের ফলে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্রমেই পদত্যাগ করায় চাপের মুখে পড়েছেন’ এবং ‘জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে হরতাল: নিহত ১২’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। প্রতিবেদন দুটি তুলে ধরা হল- 

বিরোধী আন্দোলনের ফলে প্রেসিন্ডেন্ট এরশাদ 
ক্রমেই পদত্যাগ করার চাপের মুখে পড়ছেন

বাংলাদেশে এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ঘোষিত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল জুমার নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং লাঠি চার্জ করে। অধিকাংশ খবরে জানা গেছে এ সপ্তাহে অন্তত পক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন। সরকারি হিসেবে ৫ জন মারা গেছেন। বিরোধী নেতাদের হিসেবে এই সংখ্যা ৫০-এর বেশি। সংবাদদাতা বলেছেন, বিরোধীদলগুলো কারফিউ ও জরুরি বিধি অগ্রাহ্য করে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাবার ফলে প্রেসিডেন্ট এরশাদ কদ্ধমেই পদত্যাগ করা এবং অবাধ নির্বাচন দেবার ব্যাপারে চাপের মুখে পড়ছেন। 

জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে হরতাল: নিহত ১২

আজ বাংলাদেশে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যে হরতাল পালিত হয়েছে তাতে ব্যাপক সহিংসতা ঘেটেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্সের ফলে বহু লোক হতাহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। একমাত্র মিরপুরেই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে ৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ থেকে খবর পাওয়া এখন খুব শক্ত হয়ে পড়েছে। কারণ সেখানে কড়া সেন্সর আইন বলবৎ করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে সব পত্রপত্রিকা, এমনকি সরকারি সংবাদ সংস্থা বিএসএসও ধর্মঘট পালন করছে।

বিবিসি’র পূর্ব বিভাগের জন রেনার লন্ডনে সে সব খবর পৌঁছাচ্ছেন তার ভিত্তিতে জানিয়েছেন যে মিরপুরের বাসিন্দারা বলেছেন ১০ নম্বর এলাকার বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি করলে সেখানে ৭ ব্যক্তি নিহত এবং জনা পচিশেক আহত হন। আর এক নম্বর এলাকায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীর দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়লে সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহত হন ৯ জন। এছাড়া জরুরি অবস্থা অমান্য করায় ডেমরায় ৩জন এবং ইউসুফ মার্কেটে ১ জন নিহত হয়েছেন বলে অসমর্থিত খবরে জানা গেছে। জন রেনার আরো জানিয়েছেন যে: আজ ঢাকায় কয়েকটি বিক্ষোভ প্রদর্শন অনুষ্ঠিত হয়।  আলী যাকের, সারা যাকের, সুবর্ণা ফরিদী, ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার ও ফয়েজ আহমদসহ সুপরিচিত লেখক ও শিল্পীবৃন্দের এক গোষ্ঠী প্রেসক্লাবের বাইরে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত করেন। ঐ সভায় প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরোধীদের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতিজ্ঞাপক এক বিবৃতি পড়ে শোনানো হয় এবং রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনে অংশগ্রহন বর্জন করার জন্যও আহ্বাণ জানানো হয়। পুলিশ ঐ সমাবেশ ভেঙে দেবার চেষ্টা করে এবং কয়েকজনের ওপর মারপিট করে বলে প্রকাশ।

পেশাদার লোকেদের কাছ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে লেখকদের জমায়েত তার সর্বশেষ নিদর্শন। সাংবাদিক ইউনিয়নের কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন নেতা বলেছেন যে, তারা পুলিশের কাছে ধরা না দেবার জন্য আত্মগোপন করে আছেন।

ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সরকারের প্রতি কদ্ধমবর্ধমান প্রতিবাদ জ্ঞাপনে যোগ যোগ দিয়েছেন। দেশের অবনতিমূলক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যে আজ ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একদল ব্যাবসায়ী এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত করেন এবং বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন করতে হলে দেশের সরকার বদলাতে হবে। 

দেশের ৩টি প্রধান বিরোধী মৈত্রী সে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে সেটা ঢাকা ও সর্বত্র পালিত হয়েছে বলে মনে হয়। কিছু কিছু সরকারি চাকরিজীবী কাজে গিয়েছিলেন বটে তবে তারা শুধু তাদের মাইনের চেক ভাঙাতে গিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং রাস্তাঘাট প্রায় যানবাহনশূণ্য ছিল।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনার এক মুখপাত্র বলেন যে, শেখ হাসিনা এখন বাড়িতে অবাধে তার দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে পারলেও তাঁর টেলিফোন এখনো অকেজো রয়েছে এবং তার চলাফেরার ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।  বিরোধীদের অন্য প্রধান গোষ্ঠীর নেতা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বেগম খালেদা জিয়া এখনো আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে জানানো হয়। তারা দু’জনই প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগ করার এবং শাসনক্ষমতা নিরপেক্ষ অন্তবর্তী সরকারের হাতে তুলে দেবার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। ঢাকার বাইরের সে সব খবর পাওয়া যাচ্ছে তার যথার্থ্য যাচাই করা আরো বেশি কষ্টসাধ্য হলেও ঐ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক সারা দেশে পালিত হয়েছে এবং কয়েকটি বড় বড় শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বলেই মনে হয়।

জেডএইচ/একেএস   

আরও পড়ুন