• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯, ০৮:৩৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯, ০৮:৩৬ এএম

শুভ বড়দিন আজ

শুভ বড়দিন আজ

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ‘শুভ বড়দিন’ আজ। এই দিনে বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট। দিনটি তাই খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়। বাংলাদেশেও এ ধর্মের অনুসারীরা ব্যাপক উৎসাহ ও নানা আয়োজনে উৎসবটি পালন করে।

শুভ বড়দিন উপলক্ষে আজকের দিনটি বাংলাদেশে সরকারি ছুটির দিন।

যিশুখ্রিষ্টের জন্ম কবে হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমা চার্চ ২৫ ডিসেম্বর তার জন্মদিন পালন শুরু করে। পরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতেও এই প্রথা চালু হয়।

সময়ের দিক থেকে ২৫ ডিসেম্বর দিনটি বড় নয়, তবে বড় হিসেবে পরিচিত হয়েছে। যিশুখ্রিস্ট এদিন জগতে আসার মধ্য দিয়ে ২৫ ডিসেম্বরকে মহৎ করেছেন বা ‘বড়’ করেছেন। ‘বড়দিন’ তাই বিশ্বাস-ভালোবাসা ও ক্ষমার চেতনায় ‘বড়’ হওয়ার দিন বলে মনে করেন তার অনুসারীরা।

দিনটি উপলক্ষে অবস্থাপন্ন খ্রিস্টান পরিবারে ভালো খাবার রান্না হবে। দিনের বিশেষ অনুসঙ্গ হিসেবে নিশ্চিতভাবেই থাকবে ‘কেক’। ধর্মীয় গানের পাশাপাশি হবে প্রার্থনাসভা। খ্রিস্টানদের কবরস্থানগুলোতে স্বজনরা জ্বালাবেন মোমবাতি। এদিনে কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো, গির্জা ও বাড়ি সাজানো এবং প্রীতিভোজের আয়োজন করবেন তারা। আগের দিন রাতে শিশুরা সান্তাক্লজের কাছ থেকে পায় বিশেষ উপহার। ক্রিসমাস ট্রি সাজানো এ উৎসবের একটি বড় অনুষঙ্গ।

বড়দিন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। 

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সবধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম, আচার ও অনুষ্ঠানাদি স্বাধীনভাবে পালন করে আসছেন। বিদ্যমান সম্প্রীতির এই সুমহান ঐতিহ্যকে আরও সুদৃঢ় করতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে।

জাতির পিতা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন উল্লেখ করে তিনি একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়দিনে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীসহ সকল নাগরিকের শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহবান জানান।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সম অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সম্প্রীতির সুমহান ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখাই হোক শুভ বড়দিনের মূলমন্ত্র। 

বড়দিন উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব চার্চ ও তারকা হোটেলগুলোকে ক্রিসমাস ট্রি রঙিন বাতি, বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাশাপাশি হোটেল ও পরিবারগুলোতে নানা ধরনের কেক, পিঠা ও বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

রাজধানীর তেজগাঁও ক্যাথলিক গির্জায় বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। গির্জা ও এর আশপাশে রঙিন বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রচুর জরি লাগিয়ে গির্জার ভেতর সুসজ্জিত করা হয়েছে। ভেতরে সাজানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি।

বড়দিন উপলক্ষে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও মহাসচিব এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজনকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর তেজগাঁও ক্যাথলিক গির্জা, কাকরাইল সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রাল চার্চ, মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সেজেছে রঙিন সাজে। গির্জার প্রবেশপথে সাজানো হয়েছে ক্রস ও শুভেচ্ছা কার্ডসহ উপহারসামগ্রী বিক্রির দোকান।

বড়দিনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, হোটেল কন্টিনেন্টাল, দ্য ওয়েস্টিন ও ঢাকা রিজেন্সি হোটেল সাজানো হয়েছে রঙিন বাতি, বেলুন, ক্রিসমাস ট্রি আর ফুল দিয়ে। দিনভর হোটেলগুলোতে চলবে আনন্দ-উৎসব। রাতে কেক কাটা ও প্রার্থনার পর সকালে গির্জায় একত্রিত হবেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। সকালের প্রার্থনার পর বাড়িতে ফিরে ছোটরা বড়দের আশীর্বাদ নেবে এবং আনন্দে মেতে উঠবে। এভাবেই বড়দিনের আনন্দ সবাই ভাগাভাগি নেবেন ধনি-গরিব নির্বিশেষে।

খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি বাইবেলর ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত একাধিক ভবিষ্যদ বাণীতে বলা হয়েছে যে কুমারী মেরির গর্ভে তাদের মসিহা বা ত্রাণকর্তার জন্ম হবে। নূতন নিয়ম বা নূতন বাইবেলের মথিলিখিত সুসমাচার (মথি ১: ১৮ – ২: ১২) এবং লূকলিখিত সুসমাচার (লূক ১: ২৬ – ২: ৪০)-এ বর্ণিত যিশুর জন্মকাহিনী খ্রিস্টমাস উৎসবের মূলভিত্তি। এই উপাখ্যান অনুসারে, স্বামী জোসেফের সাহচর্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মেরি যিশুর জন্ম দেন। জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, একটি আস্তাবলে গবাদি পশু পরিবৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিশু। যদিও বাইবেলের উপাখ্যানে আস্তাবল বা গবাদি পশুর কোনো উল্লেখই নেই। যদিও লূকলিখিত সুসমাচারে (লূক ২: ৭) একটি যাবপাত্রের উল্লেখ আছে: ‘আর তিনি আপনার প্রথমজাত পুত্র প্রসব করিলেন, এবং তাঁহাকে কাপড়ে জড়াইয়া যাবপাত্রে শোয়াইয়া রাখিলেন, কারণ পান্থশালায় তাঁহাদের জন্য স্থান ছিল না।’ যিশুর জন্ম-সংক্রান্ত প্রথম দিকের চিত্রগুলিতে গবাদি পশু ও যাবপাত্র পরিবৃত একটি গুহায় যিশুর জন্মদৃশ্য দর্শানো হয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এটি বেথলেহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে। এক স্বর্গদূত বেথলেহেমের চারিপার্শ্বস্থ মাঠের মেষপালকদের যিশুর জন্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন। এই কারণে তাঁরাই সেই দিব্য শিশুকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

অনেক খ্রিস্টানই মনে করেন, যিশুর জন্ম আদি বাইবেলের ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত ভবিষ্যদবাণীগুলোকে পূর্ণতা দেয়। মথিলিখিত সুসমাচার অনুসারে, কয়েকজন ম্যাজাই (জ্যোতিষী) স্বর্ণ, গন্ধতৈল ও ধূপ নিয়ে শিশুটিকে দর্শন করতে যান। কথিত আছে, একটি রহস্যময় তারা তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সাধারণভাবে বেথলেহেমের তারা নামে পরিচিত এই তারাটি ছিল প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে ইহুদিদের রাজার জন্মবার্তার ঘোষক।

ম্যাজাইদের আগমনের স্মরণে পালিত হয় ৬ জানুয়ারির এপিফেনি উৎসব। কোনও কোনও চার্চে এই ৬ জানুয়ারিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে বড়দিন উৎসব সমাপ্ত হয়।

খ্রিস্টানরা নানাভাবে বড়দিন উদযাপন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে গির্জার উপাসনায় যোগ দেয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম জনপ্রিয় প্রথা বলে বিবেচিত হয়। রয়েছে অন্যান্য বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি ও জনপ্রিয় রীতিনীতি। বড়দিনের পূর্বে যিশুর জন্মোৎসব উপলক্ষে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ নেটিভিটি উপবাস পালন করে থাকে; অন্যদিকে পাশ্চাত্য খ্রিস্টধর্মে অধিকাংশ চার্চে অ্যাডভেন্ট পালন করা হয়। বড়দিনের সর্বশেষ প্রস্তুতিটি নেয়া হয় খ্রিস্টমাস পূর্বসন্ধ্যায়।

বড়দিন উৎসব পর্বের অন্যতম অঙ্গ হল গৃহসজ্জা ও উপহার আদান-প্রদান। কোনও কোনও খ্রিস্টীয় শাখাসম্প্রদায়ে ছোটো ছেলেমেয়েদের দ্বারা খ্রিস্টে জন্মসংক্রান্ত নাটক অভিনয় এবং ক্যারোল গাওয়ার প্রথা বিদ্যমান। আবার খ্রিস্টানদের কেউ কেউ তাদের গৃহে পুতুল সাজিয়ে খ্রিস্টের জন্মদৃশ্যের ছোটো প্রদর্শনী করে থাকেন। এই দৃশ্যকে নেটিভিটি দৃশ্য বা ক্রিব বলে। এই ধরনের প্রদর্শনী উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও লাইভ নেটিভিটি দৃশ্য ও ট্যাবলো ভাইভ্যান্টও অনুষ্ঠিত হয়; এই জাতীয় অনুষ্ঠানে অভিনেতা ও জন্তুজানোয়ারের সাহায্যে যিশুর জন্মদৃশ্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়।

চিত্রশিল্পে যিশুর জন্মদৃশ্য ফুটিয়ে তোলার ঐতিহ্যটি সুদীর্ঘ। এই সকল দৃশ্যে মেরি, জোসেফ, শিশু যিশু, স্বর্গদূত, মেষপালক এবং যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির চিত্র অঙ্কন করা হয়।

যে সকল দেশে খ্রিস্টান সংস্কার প্রবল, সেখানে দেশজ আঞ্চলিক ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলনের ফলে বড়দিন উদযাপনে নানা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। অনেক খ্রিষ্টানের কাছে ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নেয়া এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

অনেক ক্যাথলিক দেশে খ্রিস্টমাসের পূর্বদিন ধর্মীয় শোভাযাত্রা বা কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। অন্যান্য দেশে সান্টাক্লজ ও অন্যান্য মরসুমি চরিত্রদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই মরসুমের অন্যতম বহুলপ্রচলিত বৈশিষ্ট্য হল পারিবারিক সম্মেলন ও উপহার আদানপ্রদান। অধিকাংশ দেশেই বড়দিন উপলক্ষে উপহার আদানপ্রদান হয়; আবার কোনও কোনও দেশে এই প্রথাটির জন্য বেছে নেয়া হয় ৬ ডিসেম্বরের সেন্ট নিকোলাস ডে বা ৬ জানুয়ারির এপিফেনির দিনগুলি।

অনেক পরিবারেই বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ পারিবারিক ভোজসভা আয়োজিত হয়। ভোজসভার খাদ্যতালিকা অবশ্য এক এক দেশে এক এক রকমের হয়। সিসিলি প্রভৃতি কয়েকটি অঞ্চলে খ্রিষ্টমাসের পূর্বসন্ধ্যায় যে ভোজসভা আয়োজিত হয় তাতে পরিবেশিত হয় বারো রকমের মাছ। ইংল্যান্ড ও ইংরেজি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত দেশগুলিতে সাধারণ বড়দিন ভোজসভার পদে দেখা যায় টার্কি (উত্তর আমেরিকা থেকে আনীত), আলু, শাকসবজি, সসেজ ও গ্রেভি; এছাড়াও থাকে খ্রিষ্টমাস পুডিং, মিন্স পাই ও ফ্রুট কেক।

পোল্যান্ড, পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ভোজে মাছের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়; তবে এই সব অঞ্চলে ভেড়ার মাংসের মতো অত্যধিক-চর্বিওয়ালা মাংসের ব্যবহারও বাড়ছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ায় হাঁস ও শূকরের মাংস বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া প্রায় সারা বিশ্বেই গোমাংস, হ্যাম ও মুরগির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ফিলিপিনসের ভোজসভার প্রধান খাদ্য হল হ্যাম। বিশেষ ধরনের টার্ট ও কেকের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ ডেসার্টও তৈরি হয় খ্রিষ্টমাস উপলক্ষে। মিষ্টি আর চকোলেট সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়।

খ্রিস্টমাসের বিশেষ মিষ্টিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মান স্টোলেন, মারজিপান কেক বা ক্যান্ডি এবং জামাইকান রাম ফ্রুট কেক। উত্তর দেশগুলিতে শীতকালে যে অল্প কয়েকটি ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কমলালেবু খ্রিষ্টমাসের বিশেষ খাদ্য হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত।

এইচএস/এসএমএম