• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৬, ২০১৯, ০২:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৬, ২০১৯, ০২:৩৪ পিএম

ভেন্যু পরিচিতি

কার্ডিফ ওয়েলস স্টেডিয়াম : টাইগারদের রূপকথার বাস্তব সাক্ষী  

কার্ডিফ ওয়েলস স্টেডিয়াম : টাইগারদের রূপকথার বাস্তব সাক্ষী  

ভেন্যু : কার্ডিফ ওয়েলস স্টেডিয়াম 
অনুষ্ঠিতব্য ম্যাচ : ৪টি 
দর্শক ধারণক্ষমতা : ১৫,২০০

সূচি: 
নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কা (শনিবার, ১ জুন)
আফগানিস্তান বনাম শ্রীলঙ্কা (মঙ্গলবার, ৪ জুন)
বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ড (শনিবার, ৮ জুন)
দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম আফগানিস্তান (শনিবার, ১৫ জুন) 

২০০৫ সালের ১৬ জুন যখন ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের এক নম্বরে থাকা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল ১১ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ। কেনিয়ার থেকেও পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ আদৌ সম্মানজনক পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারবে কি না, তা নিয়েই ছিল সংশয়। তৎকালীন সময়ে রিকি পন্টিংয়ের বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়া ছিল অপ্রতিরোধ্য। হারার স্বাদই যেন তারা ভুলতে বসেছিল। অপরদিকে, কালেভদ্রে হাতে গোনা কয়েকটি জয় পাওয়া বাংলাদেশ তখন অজিদের চেয়ে এতটাই পিছিয়ে ছিল যে শক্তির বিচারে এই দুই দলকে গ্যালিভারের পাশে লিলিপুটের অবস্থানকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল! 

কিন্তু নিয়তি সেদিন অন্যকিছুই লিখে রেখেছিল। টাইগার বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে আগে ব্যাট করা অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে ২৪৯ রানেই থেমে যায়। এরপর গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পই, কাসপ্রাউজ, ব্রাড হগদের মত বোলারদের পিটিয়ে তুলোধুনো করে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আফতাবের জয়সূচক রান নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া বধের ইতিহাস রচনা করেছিল বাংলাদেশ। 

বছর দুয়েক আগে নিউজিল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হারানোর ঘটনার স্মৃতি এখনো টাটকা। কার্ডিফ তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাছে যেন এক পয়মন্ত ভেন্যু হয়ে গেছে।  ২০১৭ সালের ৯ জুন নিউজিল্যান্ডকে বধ করে টাইগাররা উঠেছিল সেমিফাইনালে। ২৬৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা টাইগাররা ৩৩ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বড় পরাজয় বরণ করবে বলেই সবাই যখন ধরে নিয়েছিল, তখন সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ২২৪ রানের মহাকাব্যিক জুটি দলকে রোমাঞ্চকর জয়ের বন্দরে নোঙর করিয়ে ছাড়ে। অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকের মতে সেটি ছিল বিপর্যয়ে পড়ার পর ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা লক্ষ্য তাড়া করে জয়ের ঘটনা! 

ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব গ্লামারগনের ঘরের মাঠ হিসেবে পরিচিত কার্ডিফের মাঠ। আদি নাম সোফিয়া গার্ডেন নামে এখনো পরিচিত কার্ডিফ স্টেডিয়ামে ১৯৬৭ সালের ২৪ মে থেকে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন শুরু হয়। ভারতের একটি সফরকারী দলের বিপক্ষে গ্লামরগ্যানের ম্যাচ দিয়ে স্টেডিয়ামটির যাত্রা।

১৯৯৫ সালে জায়গা পরিবর্তন করে স্টেডিয়ামটি আনা হয় কার্ডিফ আর্ম পার্কে। এখানে চারপাশে ১২৫ বছরের জন্য জমি লিজ নেয়া হয়। জায়গাটি ছিল ফুটবল ক্লাব কার্ডিফ করিন্তিয়ান্স এফসির। ২০০৭ সালের জুলাইতে গ্লামরগ্যান ক্রিকেটার মাইক পাওয়েলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার শরীরের পাঁজরের একটি হার স্টেডিয়ামের মাটির নিচে পুতে রাখা হয়। 

১৯৯৯ সালের মে মাস থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন করে আসছে সোফিয়া গার্ডেন। ৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটিও হয় সেখানে। ২০০১-২০১২ সাল পর্যন্ত স্টেডিয়ামটি প্রায়ই ওয়ানডে ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার হতো। ১২ বছরে মাত্র ৯টি ম্যাচ আয়োজন করলেও, ইংল্যান্ড প্রথম ম্যাচ আয়োজন করে ২০০৬ সালে।

ওয়ানডেতে অনেক আগে থেকে খেলা হলেও স্টেডিয়ামটি প্রথম টেস্টের স্বাদ পায় ২০০৯ সালে। সেবার এশেজ সিরিজের প্রথম টেস্ট হয় কার্ডিফে। যেটি সোফিয়া গার্ডেনকে দেয় ১০০তম টেস্ট স্টেডিয়াম হওয়ার গৌরব। ২০১৫ সালের এশেজের প্রথম ম্যাচটিও হয়েছিল ওই স্টেডিয়ামে।  

কার্ডিফ স্টেডিয়ামে এখন পর্যন্ত  মোট ২৪টি ওয়ানডে ম্যাচ হয়েছে। যেখানে ইংল্যান্ড সর্বোচ্চ ১৩টি ম্যাচ খেলেছে এবং জয় পেয়েছে সর্বোচ্চ ৭টিতে। ওই স্টেডিয়ামে দুটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। দুটিতেই জয় লাভ করে যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। 

কার্ডিফ শহরটিতে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। বৈরী ও মনখারাপ করা আবহাওয়ার মধ্যে কার্ডিফের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুবিশাল আধুনিক এক একটি ভবন ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আপনার মন ভালো করে দেয়ার টনিক হিসেবে কাজ করে। কেননা শহরের যেদিকেই আপনি তাকাবেন সেদিকেই দেখা যায় ঘন সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা। তারই মাঝে শহর ভেদ করে বয়ে গেছে টাফ নদী। মাথার ওপরে সারাক্ষণ অ্যালবাট্রোসের উড়াউড়ি ও ডাকাডাকি চলতেই থাকে।

স্থাপনার দিক থেকে কার্ডিফে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। কার্ডিফ ক্যাসেল, মিলেনিয়াম স্টেডিয়াম, কার্ডিফ সিটি সেন্টার, ক্লক টাওয়ার অব সিটি হল এবং ওয়েলশ ন্যাশনাল মেমোরিয়াল পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়াও অত্যাধুনিক শপিং মলের চাকচিক্য এবং কার্ডিফ সমুদ্রতটের মনোমুগ্ধকর রূপ আসলেই দেখার মতো।

কার্ডিফ নগরীর জন্ম ১৯০৫ সালে। এরপর ১৯৫৫ সালে এটি ওয়েলশের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আয়তনের দিক থেকে কার্ডিফ যুক্তরাজ্যের ১১তম বৃহত্তম নগরী হলেও গোটা গ্রেট বিটেনের বাণিজ্য এবং শিল্পের প্রধান নগরী বলে বিবেচিত।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে ইউরোপে ষষ্ঠ পর্যটন শহরের খেতাব পেয়েছে এই কার্ডিফ। শহরের খাবার দোকানগুলো প্রায় ২৪ ঘণ্টাই থাকে খোলা। নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে হয়না কোনো পর্যটককে। কার্ডিফে শুক্র ও শনিবারের রাত যেন মোহনীয় রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন কঠোর পরিশ্রম করার পর এই দুই রাত প্রাণ ভরে আনন্দ করে কার্ডিফবাসী। ইউরোপের অন্যান্য শহরের চেয়ে কার্ডিফবাসীর উইকেন্ড সেলিব্রেশনের ধরন খানিকটা ভিন্ন।

শহরের বিখ্যাত নাইট ক্লাবগুলো খুলেই দেওয়া হয় রাত ১০টার পর। প্রতিটি ক্লাবেই থাকে লম্বা লাইন। তা ছাড়া শহরের আনাচে-কানাচেও চলে পার্টি। ছোট ছোট রাস্তাও লোকে লোকারন্য হয়ে যায়। রাস্তার কয়েকশ গজ পর পর লাউড স্পিকারে লাইফ কনসার্ট চলে। উইকেন্ডে পুরো কার্ডিফ হয়ে যায় এক উন্মত্ত নগরী। স্থানীয়দের সঙ্গে এই আনন্দ উৎসবে সমান তালে যোগ দেন পর্যটকরাও। 

ক্রীড়া ক্ষেত্রে ওয়েলসের ইতিহাস বর্ণাঢ্য। ক্রিকেটে তারা ইংল্যান্ডের সঙ্গে এক দল হয়ে খেলে। কিন্তু ফুটবলে ওয়েলস জাতীয় দল আলাদা। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়েও রয়েছে তাদের দাপট। এখন ওয়েলসের অবস্থান ১৯তম। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এখানকার এক নম্বর ক্রীড়া কিন্তু ফুটবল নয়, রাগবি। টাফ নদীর পাড়ে অবস্থিত অপূর্ব সুন্দর মিলেনিয়াম স্টেডিয়ামকে ঘিরেই কার্ডিফের রাগবি চলে। এই স্টেডিয়াম হচ্ছে ওয়েলস জাতীয় রাগবি ইউনিয়ন দলের হোম ভেন্যু। তবে এই মিলেনিয়াম স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতো এখানেও ফুটবলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের সেরা তারকা গ্যারেথ বেলের শহর কিন্তু এই কার্ডিফ। ২০১৭ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই মিলেনিয়াম স্টেডিয়ামে। যে ম্যাচে বেলের জুভেন্টাসকে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা  জেতে রিয়াল মাদ্রিদ। 

ওয়েলসের ফুটবল ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯২৭ সালে আর্সেনালকে হারিয়ে প্রথম নন-ইংলিশ দল হিসেবে এফএ কাপের শিরোপা জিতেছিল কার্ডিফ সিটি ফুটবল ক্লাব। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের সময়ও কার্ডিফে ফুটবলের ১২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ক্রিকেট সোফিয়া গার্ডেন কেন্দ্রিক। 

কার্ডিফ শহরে রাগবি ও ফুটবল যতটা জনপ্রিয় ক্রিকেট তার ধারে কাছেও নেই। ক্রিকেট নিয়ে এখানকার মানুষের মনে কোনো অনুভূতিও নেই যেন। বিশ্বকাপ হচ্ছে, শহরের অনেকে জানেই না। কিংবা অভিমান করে ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। দুই যুগ আগেও ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয় ছিল এই ওয়েলসে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দেখতে টিকিটের জন্য রেকর্ডসংখ্যক মানুষ আবেদন করেছিল। কিন্তু ২০০৫ সালে বদলে যায় চিত্র। ইসিবি (ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড) মিডিয়া রাইটস বিক্রি করে দেয় বিস্কাইবি-র কাছে। স্থানীয় টিভিগুলো ক্রিকেট সম্প্রচার করার অধিকার হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকে স্থানীয়দের মধ্যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে তরুণ প্রজন্ম ক্রিকেটের নামই যেন ভুলতে বসেছে। এখানে ক্রিকেট যেন এক ‘অচেনা’ খেলা! 

লন্ডন থেকে কার্ডিফের দূরত্ব ২৪৪ কিলোমিটার। বাসে তিন ঘণ্টার পথ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। নানা রকম গাছ। আর ঘাসে ভর্তি সবুজ পতিত জমি। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে গবাদি পশুর খামার। মনের আনন্দ ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। এখানে খামার করা সহজ। কারণ বিনা পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে পর্যাপ্ত খাবার। ভেড়া এবং গাভী বহরের জন্য কোনো রকম বাড়তি টাকা খরচের দরকার পড়ে না খামার মালিকদের। 

কার্ডিফের আবার আরেক আবেদন। ওয়েলসের রাজধানী শহরটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন। রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে নির্মিত বাড়িঘর। শহরের কোল ঘেঁষে রয়েছে সমুদ্র। সমুদ্রের কোল শেষে বাড়িঘর। 

কার্ডিফ ক্রিকেট স্টেডিয়ামটাও বেশ মায়াবী। অন্য যে কোনো স্টেডিয়াম থেকে আলাদা। একদম নিরিবিলি। চারপাশে শত শত বড় বড় গাছ। একেবারে পার্কের মধ্যে অবস্থিত এ স্টেডিয়ামটি পুরানো হলেও টেস্ট ভেন্যু হিসেবে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। এখানে অ্যাশেজ সিরিজের টেস্ট ম্যাচও হয়েছে কয়েকটা। স্টেডিয়ামের সিট গ্যালারি, সিট প্ল্যান- সব কিছুই অন্যরকম। প্রেসবক্সটাও বেশ বড়। 

আগামী ৮ জুন কার্ডিফে বিশ্বকাপের ম্যাচে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে এক নম্বরে থাকা স্বাগতিক ইংল্যান্ড। এবার খোদ ইংলিশদের হারিয়ে আরেকটি কার্ডিফ রূপকথার জন্ম দেয়ার অপেক্ষায় লাল-সবুজের দল। 

আরআইএস