• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১, ০২:২৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১, ০২:৫৮ পিএম

ভ্রমণগদ্য

বুদাপেস্টের সাতকাহন

বুদাপেস্টের সাতকাহন

মধ্য ইউরোপের ছোট দেশ হাঙ্গেরির রাজধানীর নাম কী—এই প্রশ্নের উত্তর ছোটবেলায় মুখস্থ করেনি এমন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া প্রায় বিরল। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের জন্য কোন দেশের রাজধানীর নাম কী, কোন নদীর তীরে কোন দেশের রাজধানী অবস্থিত—এগুলো ‘সাধারণ জ্ঞান’ নামক বস্তুর অংশ হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে অন্য দেশের তুলনায় সাধারণ জ্ঞান নিয়ে মনে হয় একটু বাড়াবাড়িই হয়! কেননা, বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরি পেতে, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে এবং সর্বোপরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতায় যেভাবে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের স্মরণীয়, বরণীয় ব্যক্তির নাম বা তাদের সুকীর্তির সঙ্গে সেই অঞ্চল বা স্থানের নাম আসে, হাঙ্গেরির রাজধানীর নাম সেখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বুদা ও পেস্ট মূলত দুটি পৃথক শহরের নাম। অবস্থান হিসেবে বুদা দানিউবের পশ্চিমে এবং পূর্ব দিকে পেস্ট শহর অবস্থিত। জোড়া শব্দ একত্রে বুদাপেস্ট নামকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুইটি শহরকে বিখ্যাত দানিউব নদী পরস্পর থেকে আলাদা করে এক দেশের রাজধানী বানিয়েছে। উচ্চশিক্ষা নিতে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে আছি আজ প্রায় চার মাস হতে চলল।

বুদাপেস্ট শহরে ভাস্কর্যের সামনে লেখক

গত বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ইউরোপ যাচ্ছি। উদ্দেশ্য মধ্য ইউরোপের স্থলবেষ্টিত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হাঙ্গেরিতে পিএইচডি করা। সরকারি পর্যায়ে বৃত্তি পেয়ে এবং ঢাকায় বসে ভিসা পাওয়ার আনন্দে একরকম করোনাভাইরাস মাথায় নিয়েই অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহে বুদাপেস্ট এসে পৌঁছালাম। সে মাসের শেষ দশ দিন কোরান্টিন-ব্রত পালন করে ৩১ অক্টোবর থেকে বুদাপেস্ট শহরের বুকে বিচরণ শুরু করলাম। বাসে, ট্রামে, রেলওয়ে চড়ে বুদাপেস্টকে ঢাকার সঙ্গে কারণ-অকারণে তুলনা করতে থাকলাম। ঢাকায় কী নেই, বুদাপেস্টে কী আছে; বুদাপেস্টে কী নেই, ঢাকায় কী আছে—এসব আলোচনা বাংলাদেশি কারো সঙ্গে দেখা হলেই শুরু করে দিতাম। পরে নিজেকে নিজেও এই সব প্রশ্ন করেছি। অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চেয়েছি উন্নত দেশের রাজধানী হিসেবে বুদাপেস্ট কেমন! একই সঙ্গে বুঝতে চেয়েছি বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে কীভাবে পেয়েছি! এই প্রশ্নের উত্তর দিতে লম্বা করে লিখতে হবে।

হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে এসে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি পরিবহন ব্যবস্থাপনা দেখে। সারা দেশের পরিবহনব্যবস্থা এককথায় অনবদ্য। বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিবহন থাকলেও এই দেশে সরকারি পরিবহনই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য অধিকাংশ এলাকাতেই একসঙ্গে বাস, ট্রাম বা মেট্রো সেবা রয়েছে। একই সড়কে পাশাপাশি চলছে বাস, ট্রাম এবং মাটির তলায় মেট্রো। ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের রাস্তায় মাঝেমধ্যে যানজটের দেখা মিললেও সরকারি বাস চলাচলের রাস্তা সব সময়ে থাকে যানজটমুক্ত। রাতের গভীর কিংবা দিনের অলস দুপুরের সময় যা-ই হোক না কেন, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যথেষ্ট ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলার রীতি আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, যে যে পথে ঘর থেকে বের হয়ে বাসে, ট্রামে বা মেট্রোতে চড়ে বসুক না কেন, সব পরিবহন ঠিক কোথাও না কোথাও এক পথে এসে মিলে গেছে। ফলে বাস ছেড়ে ট্রামে বা ট্রাম ছেড়ে মেট্রোতে চড়তে কারো কোনো ক্লান্তি নেই।

সব দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বুদাপেস্টে রয়েছে অনবদ্য গণপরিবহন ব্যবহারের সুযোগ। সামান্য পথ (৫০০ মিটার বা ১ কিলোমিটার) বাসে, ট্রামে, মেট্রোতে চড়ে কোথাও গেলে প্রতি একক টিকিটের জন্য পকেট থেকে দিতে হয় হাঙ্গেরির মুদ্রায় ৩৫০ ফরিন্ট (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০০)। এই মোটা অঙ্কের খরচ থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক খরচে গণপরিবহন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ সারা দেশের গণপরিবহনের জন্য প্রযোজ্য। শিক্ষার্থী হিসেবে হাঙ্গেরির মুদ্রায় ৩৪৫০ ফরিন্টে (বাংলাদেশি প্রায় এক হাজার) সারা মাসের জন্য পুরো শহরের অভ্যন্তরে গণপরিবহনে চলাচলের সুবিধা পাওয়া যায়। শহরের বাইরে গেলেও সব শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে ৫০ শতাংশ ছাড়।

এখানে ঢাকা শহরের প্রসঙ্গ আনলে কেউ কেউ রাগ করতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঢাকায় বসবাস করেছি ১৮ বছর। শৈশবের আদুল গায়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে যখন ঢাকায় এসে পদার্পণ করি তখন গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর ছিল আমার বিচরণক্ষেত্র। গুলিস্তান নেমে প্রথমে ৬ নম্বর বাসে কমলাপুর যাত্রা। তারপর সেখান থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকের ফুটওভারব্রিজ আর সবজিবাগান দেখে দেখে মুগদা-মান্ডায় বড় আপার বাসায় যেতাম। শৈশবের সেই ঢাকাকে এখনো আগের মতোই মনে হয়। বিশেষ করে ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবহনব্যবস্থার চিত্র দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ছোট দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর গণপরিবহন চাহিদা মেটাতে সরকারি ব্যবস্থার আয়োজন অতি নগণ্য। একই সঙ্গে সরকারি পরিবহনসেবার অপ্রতুলতা; অন্যদিকে সারা দেশের পরিবহনব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের উপস্থিতিই বলে দেয় সারা দেশের গণপরিবহন মূলত মুনাফাখোরদের হাতে জিম্মি। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকেই বাণিজ্যিক পরিবহন সেবার মধ্যে আস্থা রাখতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। তার সুযোগে জনগণের পকেট হচ্ছে ফাঁকা। ঢাকার পরিবর্তন বলতে যা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে গগনচুম্বী কয়েক হাজার ভবন, গোটা দশেক ফ্লাইওভার, হাজার হাজার বাস-প্রাইভেট কারের যানজট এবং মানুষের কর্মঘণ্টার অপচয়।

শুনেছি হাঙ্গেরিতে একসময় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। দেশটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সোভিয়েত শাসনের অনুকরণে দেশ চলতে থাকে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পর সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও পুরো দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব, তাদের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ তেমন কমেনি। সবচেয়ে কম খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেমিস্টারপ্রতি শিক্ষা ব্যয়ের দিক থেকে হাঙ্গেরি সবার তলানিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফান্ড থেকে হাঙ্গেরি সরকার বৃত্তি দিয়ে প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে সেই দেশে বিনা খরচে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।

বুদাপেস্টের সন্ধ্যা বেশ মনোমুগ্ধকর। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলে একে একে সব ভবন, সেতুর বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। কর্ভিনাস ইউনিভার্সিটির সামনে বুদা শহরের পাহাড়কে মনে হয় ত্রিকোনাকার আয়না। রাতে পাহাড়ের বুকে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই সন্ধ্যায় নদীর তীর ঘেঁষে চলা শত শত গাড়ির আলো দানিউব নদীর পানিকে উজ্জ্বল করে তোলে। কিছু দূরে হাঙ্গেরির সংসদ ভবনকে দেখা যায়। তার বিপরীতে রয়েছে বুদা ক্যাসেল। বুদা ক্যাসেলের সামনে নদীর পাড়ে বসে কেউ যদি এক সন্ধ্যা সময় কাটায়, তার কাছে সেই স্মৃতি চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। এ কথা বলতে বারণ নেই যে কোনো এক সুন্দর আবহাওয়ায়, রাতের আকাশে তারাদের দেখা না মিললেও সংসদ ভবনের আলো সেই এলাকা ভ্রমণকারী কাউকে হতাশ করবে না। নদীর দুই পাশকে মোহনীয় করে তোলার জন্য সংসদ ভবন এলাকার এক সন্ধ্যা সত্যিই অনন্য।

এই লেখা যখন লিখছি তার কয়েক ঘণ্টা আগে দানিউব নদীর তীরে আমার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলাম। বেলা ২টার পর থেকে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। তার এক ঘণ্টা আগে আকাশ ছিল সূর্যের রক্তিম আভায় পূর্ণ। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আবহাওয়া ছিল প্রায় ১ ডিগ্রির কাছাকাছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে নদীর তীরে চলে এলাম। দানিউব নদীর তীর ঘেঁষে হলুদ ট্রাম রয়েছে। সেই ট্রামে চড়ে দানিউব নদীর দিকে চোখ রাখি। আর চেয়ে দেখি  নদীর ওপর কয়েক জোড়া সেতু চলতি পথে একবার সকালে, আরেকবার বিকেলে আমার পেছনে পড়ে থাকে। এরই মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে আসে। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর চেইন ব্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো ব্রিজটি আগের চেয়ে আরো বেশি আলোকোজ্জ্বল লাগছে।

 

লেখক: পিএইচডি গবেষক, কর্ভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরি।