• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০১৯, ০২:০৪ পিএম

আবার ‘পল্টি’ মাহবুব তালুকদারের

আবার ‘পল্টি’ মাহবুব তালুকদারের
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার

 

নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে ‘আমার বক্তব্য’ শিরোনামে আবারও লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এবার তিনি গত ৩ জানুয়ারি দেয়া নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা হাজির করে দাবি করলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমার অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি’।

মঙ্গলবার (০৮ জানুয়ারি) আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে নতুন লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বিগত ৩ জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত 'ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে' আমি যে বক্তব্য রাখি তাতে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আমি আমার অবস্থান পরিবর্তন করেছি কি না! এ সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

ইসি মাহবুব বলেন, আমি বক্তব্যে বলেছি 'অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়েছি’। ইতোপূর্বে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের বক্তব্যে আমি বলেছিলাম, ‘সব দল অংশগ্রহণ করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া একটি প্রাথমিক প্রাপ্তি। আসল কথা হচ্ছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কিনা এবং বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কিনা? নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য না হলে অংশগ্রহণমূলক হলেও কোনো লাভ নেই।’

নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে আমি কোনো কথা বলিনি। কেমন নির্বাচন হয়েছে, সাংবাদিকদের এহেন প্রশ্নের জবাবে আমি আগে বলেছি, ‘নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, তাহলে এ প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।’ এখনও আমি সেই কথাই বলি। আমার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এ সময় ইসি মাহবুব আরো বলেন, বিগত ৩ জানুয়ারির অনুষ্ঠানটি ছিল ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠান। কাউকে প্রশংসা সূচক কথা বলে ধন্যবাদ জানাতে হয় এবং সেটাই সৌজন্যের প্রকাশ। আমার ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যকে রাজনৈতিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না।

প্রসঙ্গত, কমিশন বৈঠকে অনেকবার নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়ে আলোচনায় আসা মাহবুব তালুকদার সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তব্য দেন গত ৩ জানুয়ারি। ওইদিন তিনি নির্বাচন কমিশনে কাজ করার সুযোগকে তার জীবনে গৌরব-গাথা হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

বলেন, আগের নির্বাচন অংশীদারমূলক হয়নি। এই প্রথম একটা অংশীদারমূলক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা জাতিকে উপহার দিতে পেরেছি। আমি মনে করি এই নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে। এই নির্বাচন ধরেই পরবর্তী ইতিহাসে যে নির্বাচনের ধারা সেটা পরবর্তী সময়ে হয়তো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।

নির্বাচন ভবনে ফোয়ারা চত্বরে ‘সফল’ নির্বাচনের  উপলক্ষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও নতুন বছর বরণ উৎসব আয়োজনে এ কথা বলেন তিনি। এসময় নির্বাচন কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিতি ছিলেন।

মাহবুব তালুকদার তার বক্তব্য শুরু করেন এভাবে, মনোরম পরিবেশে আপনাদেরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আমি খুব ভাগ্যবান, নিজে নিজেই বললাম। তার কারণ হলো, আমি আমার জীবন প্রারম্ভে যখন সরকারের চাকরিতে আসি, তখন বঙ্গবভবনে আমি, পাঁচ বছর সময় কাটিয়েছিলাম। চারজন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। আর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চারজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমার আবার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সম্ভবত পাঁচ বছরব্যাপী। সেজন্য আমি মনে করি, জীবনের প্রথম আমলা হিসেবে কাজ করা এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই পাঁচ বছর- এগুলো আমার জীবনে গৌরব গাঁথা হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, আপনার জানেন, আমাদের নির্বাচনের কোনো ধারাবাহিকতা নেই কিংবা ছিল না। আমরা কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছি, কখনো সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছি। কখনো নির্বাচন করেছি দলীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু তা অংশীদারমূলক হয়নি। এই প্রথম একটা অংশীদারমূলক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা জাতিকে উপহার দিতে পেরেছি। আমি মনে করি এই নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে। এই নির্বাচন ধরেই পরবর্তী ইতিহাসে যে নির্বাচনের ধারা সেটা পরবর্তী সময়ে হয়তো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, নির্বাচন যে এত বিশাল কর্মযজ্ঞ, এ বিষয়ে সত্যি আমার ধারণা ছিল না। কারণ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করার কোনো সুযোগ কিংবা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাজ করার কোনো সুযোগ আমার আমলা জীবনে কখনো হয়নি। এখানে এসে এই বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে আমার জীবনের একটা বিশাল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি। কী নিরলস প্রচেষ্টায় আপনারা এই নির্বাচনটা সফলদায়ক করেছেন, সর্বাঙ্গীনভাবে সফল করেছেন, এটা আমি যদি প্রত্যক্ষভাবে না থাকতাম, তাহলে আমি দেখতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না। বিশেষ করে আমি লক্ষ করেছি- এই বিশাল কর্মযজ্ঞের যিনি কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের নির্বাচন কমিশনের সচিব মহোদয় এবং তার সঙ্গে এখানে যারা নির্বাচন-সৈনিক ছিলেন, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব এবং অন্য যারা ছিলেন, তারা কী নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই নির্বাচনকে সফল করেছেন, এই অভিজ্ঞতাও আমার জন্য অনেক বিশাল এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং যোদ্ধার মতোই তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সবাইকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার যাদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন দেখা হয় এবং আমি বলবো অপরিসীম অনুগ্রহ আমি যাদের সঙ্গে দুই বছরের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেছি, আরো তিন বছর অতিবাহিত করতে পারব আশা করি এবং তাদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, এ সম্পর্ক এতো নিবিড়, এটি কর্মক্ষেত্রে কখনো হয়নি। হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য কর্মক্ষেত্রে এ সুদীর্ঘ সময়ে কখনো কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমি মনে করি এটা আমরা পরম সৌভাগ্য যে তাদের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আপনজনের মতো আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেই সম্পর্ক কেবল নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ না, মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গেও আমার একটা অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক রয়েছে। যেটার জন্য আমি আনন্দিত এবং গর্বিত। আপনারদের সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন এবং আমি একটা জিনিস সবার কাছে প্রত্যাশা করি- আমি মনে করি আমার মতো বয়স্ক আর কেউ এখানে নেই। আপনাদের সবার দোয়া কামনা করি। আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনাদের সবাইকে দোয়া করি।

উল্লেখ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার না করা, প্রশাসনকে ইসির অধীনে নিয়ে আসাসহ বেশ কিছু দাবিতে কমিশন বৈঠকে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভা বর্জন করেছিলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি কমিশন বৈঠকে দুবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বৈঠক বর্জন করেন। এছাড়া ভোটের কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমে বলেন, নির্বাচনে লেভেলে প্লেয়িং ফিল্ড বলতে কিছু নেই। তার সেই বক্তব্যের পর সিইসি বলেছিলেন যে গণমাধ্যমে মাহবুব তালুকদার অসত্য কথা বলেছেন। সেসময় জ্যেষ্ঠ এ নির্বাচন কমিশনার গণমাধ্যমকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে লিখিত আকারে জানান, সিইসির এ বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ এ কথা বলে তিনি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, সিইসিসহ সকল নির্বাচন কমিশনার সমান।

গত ১২ ডিসেম্বর লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিনও ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণের পর গণমাধ্যমে বলেন, বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীর এজেন্টকে ভোটকেন্দ্রে দেখতে পাননি। এভাবে বারবার নিজের বক্তব্য পাল্টে বার বারই নিজেকে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত করে চলেছেন এই কমিশনার।

হাশা/বিএস