• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯, ০১:০২ পিএম

কে এই জুয়ান গুয়াইদো?

কে এই জুয়ান গুয়াইদো?
মহসীন হাবিব

 

ভেনিজুয়েলা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের একটি দেশ। কিন্তু বিশ্ব এখন একটি গ্রাম। তাই বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের কোথায় কী হচ্ছে, কার উত্থান ঘটছে, কার পতন ঘটছে- সেসব খবর রাখার প্রয়োজন তৈরি হয়েছে। ভেনিজুয়েলায় যে সংকট এখন দানা বেঁধেছে, তা নিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে এর পেছনের মানুষগুলো এবং তাদের রাজনীতি সম্পর্কে সংবাদের আড়ালেও তাকিয়ে দেখা দরকার। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং বিরোধী দলের নেতা জুয়ান গুয়াইদো রয়েছেন বর্তমান রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। কে এই গুয়াইদো, সেটা পরিষ্কার করতেই এ লেখা।

জুয়ান গেরার্দো গুয়াইদো মার্কেজ, যাকে সবাই জুয়ান গুয়াইদো নামে চেনে। তিনি এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত একটি নাম। মাত্র কিছুদিন আগেও বাইরের পৃথিবী তো দূরের কথা, ভেনিজুয়েলার বেশির ভাগ মানুষ তাকে চিনত না। এখন ভেনিজুয়েলার পার্লামেন্টের বিরোধী দলের সদস্যদের এবং আন্তর্জাতিক মহলের পশ্চিমা ঘরানার সমর্থন নিয়ে তিনি নিজেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট! তিনি গত ৫ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ভেনিজুয়েলার এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট বা স্পিকার। এটি একটি সাংবিধানিক পদ। ভেনিজুয়েলার দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট ভেঙে ১৯৯৯ সালের পর এক কক্ষবিশিষ্ট করা হয়। তখন থেকে এ পদটির সৃষ্টি। আমরা সে ইতিহাসে নাই-বা গেলাম।
 
বেশ কিছুদিন ধরেই দেশটিতে চলছে অর্থনৈতিক সংকট। চলছে ভয়াবহ খাদ্যাভাব। মুদ্রাস্ফীতি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে প্রেসিডেন্ট মাদুরোবিরোধী শিবির শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেশটির বিরোধী দলের নেতারা প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ২০১৮ সালের নির্বাচনকে প্রহসনমূলক বলে তার পদত্যাগ চাইছেন। রাস্তায় নেমেছিলেন জুয়ান গুয়াইদোও। ৩৫ বছর বয়সী পেশায় প্রকৌশলী জুয়ান ২০১৫ সালেই মাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও তাকে সেভাবে কেউ চিনত না। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তো একেবারেই না। কিন্তু একটা সময় তাকে সামনে নিয়ে আসার জন্য টার্গেট করেন যুক্তরাষ্ট্র বলয়ের গোয়েন্দারা।

গত জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখ তিনি রাজধানী কারাকাসের একটি মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখোশ পরা একদল লোক অস্ত্র হাতে তার ফোর্ড গাড়ির দরোজা খুলে তাকে দ্রুত টেনে বের করে আনে এবং একটি সাদা পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তায় তার সমর্থকরা ‘অপহরণ! অপহরণ!’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এরই মধ্যে তার সমর্থকরা টুইট করে সেই অপহরণের দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়। রহস্যজনক বিষয় হলো, খুব সামান্য সময় পরই গুয়াইদোকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি ফিরে এসে তার সমর্থকদের বলেন, ‘এমন অপহরণে আমরা ভীত নই!’

কিন্তু কে গুয়াইদোকে অপহরণ করেছিল, কেনই-বা করেছিল? মোটিভ কী? পশ্চিমারা এবং গুইদোর সমর্থকরা বলেছে, মাদুরোর গোয়েন্দা বাহিনী এই অপহরণ করেছিল। কিন্তু সেটা কতটা সত্য, তা কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কারা এই অপহরণ করেছিল? এটা কি মাদুরোর বিরুদ্ধে একজন নতুন নায়ক দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা? এমন ধারণার পেছনে যুক্তি আছে। ধরে নিয়ে গিয়ে ভেনিজুয়েলার জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়ে একজন নেতা বানানোর প্রয়োজন ছিল। কারণ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো ক্যারিশমেটিক নেতা নেই এই মুহূর্তে, যারা জনগণকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করবেন। যারা আছেন তারা মেধাবী হলেও দীর্ঘদিনের পরিচিত।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভেনিজুয়েলার ব্যাপারে ট্রাম্প শ্যেন দৃষ্টি ফেলেন। ট্রাম্প তার জাতীয় নিরাপত্তা দলকে ডেকে নিয়ে তেলসমৃদ্ধ ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাতে জাতীয় নিরাপত্তা দলও অবাক হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সময় থেকে চরম বৈরিতা রয়েছে। শ্যাভেজ ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাই মাদুরোর রাজনৈতিক গুরু। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এই নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পর হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।

গুয়াইদো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন ৪ জানুয়ারি। ১০ জানুয়ারি মাদুরোর দ্বিতীয় দফা শপথকে সামনে রেখে কানাডা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিকোলাই মাদুরোকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। এ গ্রুপটিকে ডাকা হয় লিমা গ্রুপ নামে। এটি ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট পেরুর রাজধানী লিমায় গঠিত হয়।

গুয়াইদো সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। বাবা ছিলেন কমার্শিয়াল পাইলট এবং শিক্ষক। তার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন আচমকা বন্যায় তার নিকটাত্মীয় এবং বেশ কয়েকজন বন্ধু মারা যায়। তখন থেকেই তিনি স্থির চরিত্রের মানুষ বনে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে ২০০৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণকারী কারাকাসের মেয়র লিওপোল্ড লোপেজের গঠিত পপুলার উইল মুভমেন্টে যোগ দেন। লোপেজকে সহিংসতার দায়ে কারান্তরীণ করা হয় এবং ২০১৭ সালে মুক্তি পান তিনি।

১০ জানুয়ারি মাদুরো শপথ নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলে লোপেজ, বোর্গেসসহ একদল রাজনীতিকের সঙ্গে বসে তাকে অস্বীকার করার পরিকল্পনা আঁটেন গুয়াইদো।

এদিকে ২০১৯ সালের শুরুতেই ভেনিজুয়েলায় খাদ্যাভাব, ওষুধের অপ্রতুলতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে যায়। (কেউ কেউ মনে করেন, এ অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোর অসহযোগিতার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।) আমেরিকা ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ মাদুরোর বিরুদ্ধে একজন নেতা খুঁজতে থাকে। এ সুযোগে গুয়াইদোকে বেছে নেয় ভেনিজুয়েলার মাদুরোবিরোধীরা। তারা বেশকিছু দেশের কাছে বার্তা পাঠায়, তোমার আমাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন দাও।

এরপর গুয়াইদো এবং অন্যান্য মাদুরোবিরোধী নেতা মিলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের প্রতিনিধি পাঠায় লবিং করতে। আর এ দেশগুলো, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো বসেই ছিলেন এ অপেক্ষায়। অবশেষে ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমাদের ইশারায় নিজেকে জনসম্মুখে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেন গুয়াইদো। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করে গুয়াইদোকে নিজেদের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর একে একে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গুয়েতেমালাসহ ৫০টি দেশ স্বীকৃতি ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও জাতিসংঘ এ ঝুঁকি নেয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গুয়াইদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। অবশ্য রাশিয়া, চীন, কিউবা এবং ইরান গুয়াইদোকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে জোর সমালোচনা করেছে।

এই মুহূর্তে ভেনিজুয়েলার ওপর একটি অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে। সরকার মানবিক সাহায্য ঢুকতে দিচ্ছে না দেশটিতে এই বলে যে, মাদুরোর দেশে এমন কোনো সংকট নেই। অন্যদিকে ভেনিজুয়েলার বিরোধী দল দেশটির কংগ্রেসে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা তেলের  রাজস্ব আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, যে কোনো সময় গুয়াইদোকে গ্রেফতার করা হতে পারে। কিন্তু মাদুরো আন্তর্জাতিক মহলের ফাঁদে পা না দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে গুয়াইদোকে মোকাবেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।  

এই মুহূর্তে গুয়াইদো আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও সে বিবেচনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। কিন্তু তার ফল কী হবে? অস্থির হয়ে উঠবে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও সঙ্গীন হয়ে পড়বে। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন মেক্সিকো দেয়াল নিয়ে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। তাই মনে হয় না যে যুক্তরাষ্ট্র তথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বোকামি এখন করতে যাবেন।


সাইসে