• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯, ০৯:৫১ পিএম

গর্ভাবস্থায় যেসব খাবার গ্রহণ করা জরুরি

গর্ভাবস্থায় যেসব খাবার গ্রহণ করা জরুরি

 

গর্ভাবস্থায় মা যেসব খাবার গ্রহণ করেন বা পান করেন, সেসব খাবারই গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টির মূল উৎস। তাই, গর্ভাবস্থায় এমন সব খাবার খেতে হবে, যেন তা সঠিকভাবে গর্ভস্থ শিশুর গঠন, বিকাশ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পাশাপাশি, গর্ভবতী মা ও শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।

আবার, কিছু খাবার আছে যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর। সেসব খাবার গ্রহণের ব্যাপারে মায়েদেরকে অবশ্যই সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে। তবে, গর্ভবতী মায়েদের খাবার নিয়ে সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে যা অবশ্যই বর্জনীয়।

নিচের খাবারগুলো একজন গর্ভবতী মায়ের সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত 


প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার

গর্ভবস্থায় ফিটাল ডেভেল্পমেন্ট অনেক খানি নির্ভর করে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন প্রাপ্যতার উপর। গর্ভকালীন সময়ে প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদা যদি ঠিকভাবে পূরণ না হয় তবে ফিটাল ডেভেল্পমেন্ট ব্যাহত হয়। 

গর্ভধারণের পূর্বে একজন মায়ের প্রতি কেজি বডি ওয়েটের জন্য প্রোটিনের চাহিদা থাকে ০.৮ গ্রাম করে। তবে গর্ভবস্থায় দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা কিছুটা বাড়ে, এসময় গর্ভবতী মায়েদের প্রতি কেজি বডি ওয়েটের জন্য ১.১ গ্রাম করে প্রোটিন গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। অথবা গর্ভধারণের পূর্বের চাহিদার সঙ্গে অতিরিক্ত ২৫ গ্রাম প্রোটিন দৈনিক গ্রহণ করা উচিত। সেই হিসাবে কোনো গর্ভবতী মায়ের ওজন যদি ৬০ কেজি হয় তবে তার দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা হবে ৬৬ গ্রাম।

আর হ্যাঁ, ৬৬ গ্রাম প্রোটিন মানে কিন্তু ৬৬ গ্রাম মাছ বা মাংস বা দুধ নয়। প্রতি, ৩০ গ্রাম কাঁটা ছাড়া মাছ, হাড় ছাড়া গরু, খাসী বা মুরগীর মাংস, কলিজা, ডাল বা একটি ডিম থেকে পাবেন প্রায় ৭ থেকে ৭.৫ গ্রাম প্রোটিন।

সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, গর্ভবস্থায় প্রতিদিন প্রতিবেলার খাবারে আপনাকে কিছু না কিছু প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, সিমের বীচি রাখতে হবে। তা না হলে আমিষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।


শাকসবজি, ফলমূল বা ফাইবার জাতীয় খাবার

গর্ভকালীন সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় প্রায় সব মায়েরাই ভুগে থাকেন। সাধারণত গর্ভকালীন সময়ে নানা কারণে প্রতিদিন যতটুকু শাকসবজি বা ফলমূল খাওয়ার কথা সেই পরিমানে খাওয়া হয় না। ফলে, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিয়মিতভাবে হতে থাকে। তাই প্রতিদিন, নিয়ম করে শাক, সবজি এবং ফলমূল খেতে হবে।

গর্ভকালীন সময়ে প্রতিদিন ২০-৩৫ গ্রাম ফাইবার বা খাদ্যআঁশ গ্রহণ করা উচিত। আর এই চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন রঙের শাক, সবজি এবং টক ও মিষ্টি উভয় ধরনের ফল রাখুন আপনার খাদ্য তালিকায়।


শর্করা জাতীয় খাবার

গর্ভকালীন সময়ে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মতোই শর্করার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়, তবে গর্ভকালীন সময়ে এমন শর্করা গ্রহণ করতে হবে যেন এর সঠিক পুষ্টিমূল্য বজায় থাকে। অর্থাৎ, সাদা চাল এবং আটার পরিবর্তে লাল আটা এবং লাল চালের ভাত এবং রুটি বেছে নিতে হবে।

এসময়, শর্করার চাহিদা পূরণের জন্য শুধু ভাত বা রুটি না খেয়ে ওটস বা ঘরে তৈরি হোল হুয়িট পাস্তা বা বাদামি চিড়া খাওয়া যেতে পারে।

যদি কোনো মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তাকে অবশ্যই সঠিক পরিমাণে শর্করা গ্রহণের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।

অনেক মায়েরাই এসময় ভাতের প্রতি বেশি পরিমাণে আসক্ত হয়ে পড়েন, অর্থাৎ খুব বেশি পরিমাণে ভাত খেয়ে থাকেন যা গর্ভস্থ শিশুর সঠিক পুষ্টি প্রাপ্তিতে সমস্যা সৃষ্টি করে।

সেক্ষেত্রে, ভাতের পরিমাণ কমিয়ে প্লেটে শাক এবং সবজি বেশি করে নিন। শাক এবং সব্জি দিয়ে ভাত খাবেন, ভাত দিয়ে শাক এবং সবজি নয়।


ফ্যাট জাতীয় খাবার

গর্ভকালীন সময়ে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মতো ফ্যাটের চাহিদাও বেড়ে যায়। এসময় ফ্যাটের চাহিদা মোট ক্যালরির ২০-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

ফ্যাট গর্ভস্থ শিশুর চোখ এবং ব্রেন ডেভেলপমেন্ট, সেল মেমব্রেনের গঠন এবং হরমোনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফ্যাটের চাহিদা পূরণের জন্য এমন উৎসের ফ্যাট গ্রহণ করা উচিত যা অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড এবং কোলিনের মতো উপাদান সরবরাহ করতে পারে।

এই উপাদানগুলো গর্ভস্থ শিশুর ব্রেন ডেভেলপমেন্টের জন্য জরুরি। বিভিন্ন রকমের বাদাম, অলিভ অয়েল, ডিমের কুসুম, অ্যাভোকাডো, তৈলাক্ত মাছ, মাছের তেল ফ্যাট জাতীয় খাবারের ভালো উৎস।

তবে অবশ্যই অতিরিক্ত তেলে রান্না করা খাবার এবং বাইরে তৈরি যেকোনো ফ্রাইড ফুড আইটেম পরিহার করবেন।


ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার

গর্ভস্থ শিশুর জন্য ফলিক এসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন। কেননা, এই ভিটামিনের অভাব হলে শিশুদের ব্রেন এবং মেরুদণ্ডে ত্রুটি দেখা দেয় যা নিউরাল টিউব ডিফেক্টস নামে পরিচিত।

এই পুষ্টি উপাদানটি গর্ভধারণের ১ম দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি। কেননা এই সময়েই অধিকাংশ নিউরাল টিউব ডিফেক্টসগুলো ঘটে। এছাড়া পুরো গর্ভকালীন সময়ে ফলিক এসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই গর্ভধারণের ৩ মাস আগে থেকেই ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়।

এছাড়া, ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণের জন্য নিয়মিত সবুজ শাক যেমন পালংশাক, ডিম, ব্রকলি, বাদাম সাইট্রাস ফল, কুমড়ার বীচি প্রভৃতি রাখুন খাদ্য তালিকায়। 


আয়রন সমৃদ্ধ খাবার

একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন দরকার হয় যা সাধারণ অবস্থার চেয়ে প্রায় ২ গুণ। এই অতিরিক্ত পরিমাণ আয়রন এজন্য দরকার যেন গর্ভবতী মায়ের দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকে এবং আয়রনের অভাবে যেন কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি না হয়।

যেসব মায়ের দেহে আয়রনের অভাব আছে তারা নিয়মিত আয়রনযুক্ত খাবার যেমন- পরিমিত পরিমাণে কলিজা এবং রেড মিট, শুকনো খেজুর, কিশমিশ, পালংশাক, শাক, ডিম, বেদানা, কলা প্রভৃতি খাবার নিয়মিত খাবেন।

আর হ্যাঁ, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পাশাপাশি টক ফল খাবেন। কেননা, টক ফলে থাকা ভিটামিন-সি এর অভাব হলে আমাদের দেহ পুরোপুরি মাত্রায় আয়রন গ্রহণ করতে পারে না।

এরপরও যদি দেহে আয়রনের অভাব থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করবেন।  
    

পানি

নিজের এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য, গর্ভবতী মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। কেননা, কম পানি পান করলে মূত্রথলির প্রদাহ এবং হজমে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া, গর্ভস্থ শিশুর শরীরে পুষ্টি সরবরাহের জন্যও পানির প্রয়োজন। তাই পানির চাহিদা পূরণের জন্য বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি ডাবের পানি, চিনি ছাড়া ফলের রস খেতে পারেন। প্রতিদিন অন্তত ১২-১৩ গ্লাস পানি পান করবেন।

প্রতিটি গর্ভবতী মায়ের উচিত অন্যান্য সময়ের চেয়ে গর্ভকালীন সময়ে নিজের প্রতি একটু বেশি যত্নশীল হওয়া।

সময় মতো সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার খাওয়া, বিশ্রাম নেয়া- প্রতিটি কাজই গর্ভকালীন সময়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে যেকোনো একটিও যদি বাদ পড়ে যায় তবে তা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

আর এই জটিল ও কঠিন সময়ে একজন গর্ভবতী মায়ের একার পক্ষে নিজের যত্ন নেয়া সম্ভব নয়। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত হবু মাকে সহায়তা করা। 

লেখক : পুষ্টিবিদ, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড।

এফসি