• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯, ০৯:৫৩ পিএম

নিমতলী থেকে চুড়ি হাট্টা

নিমতলী থেকে চুড়ি হাট্টা
চলছে উদ্ধার কার্যক্রম -ছবি : কাশেম হারুন


২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ১২৪ জনের প্রাণহানির কথা এখনও মন থেকে মুছে যায়নি। তারই মধ্যে আরও একটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেলো সেই পুরান ঢাকায়। এবার ঘটনাস্থল চকবাজারের চুড়ি হাট্টায়। ২০১০ সালের ৩ জুনের পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজার ট্র্যাজেডি আবারও নাড়িয়ে দিয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত। এই দুই অগ্নিকাণ্ডে এতো হতাহতে ঘটনা ঘটেছে শুধু কেমিক্যালের কারণে। আর এ কারণে নিমতলীর পর চকবাজারের চুড়ি হাট্টার আগুনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকাবাসী। পাশাপাশি উদ্বিগ্ন সরকারের উচ্চমহলও। 

ঘটনাস্থল : চকবাজার চুড়ি হাট্টা

বুধবারের আগুনের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক টুইট বার্তায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও গুরুত্বসহকারে আগুনের খবরটি প্রকাশ পেয়েছে। 

ঘটনাস্থল : চকবাজার চুড়ি হাট্টা

সরকারি হিসেবে ৬৭ জন মৃতের কথা বলা হলেও মানুষের মুখে মুখে রটে গেছে প্রায় ৮০ জনের।  অগ্নিকাণ্ড তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিস বিভাগ একটি করে কমিটি গঠন করেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল হককে প্রধান করে বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।

হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয় আগুন নেভানোর কাজে -ছবি : জাগরণ

বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের চুড়ি হাট্টায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সারা রাত ছিল সেই আগুনের তাণ্ডব। আগুনের লেলিহান শিখা কাউকে রেহাই দেয়নি। না ঘুমন্ত, না পথে চলা মানুষকে। যেখানে যেভাবে পেয়েছে সেভাবেই আগুন গ্রাস করে পথচারী, দোকান কিংবা বাসায় বিশ্রামরত বা বিশ্রামের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোকেও। দোকানপাটে অবস্থানরত দোকান মালিক, কর্মচারি, ক্রেতারাও রেহাই পাননি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আরও অনেকে।

ঘটনাস্থল : চকবাজার চুড়ি হাট্টা

দগ্ধদের মধ্যে ১৮ জনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসা দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ৯ জনকে। বাকি ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ভর্তি ৯ জনের কারও অবস্থাই ভাল নয়। প্রায় সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এই ৯জনের মধ্যে ৮জনকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে এবং একজন আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

আইসিউতে ভর্তি থাকা সোহাগের শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। পোস্ট অপারেটিভে ভর্তি ৮জনের মধ্যে রেজাউল করিমের শরীর ৫৭ শতাংশ, জাকির হোসেনের ৩৮ শতাংশ, মুজাফফর আহমদের ৩০ শতাংশ, আনোয়ার হোসেনের ২৮ শতাংশ, হেলাল উদ্দিনের ১৬ শতাংশ, সেলিমের ১৪ শতাংশ, মাহমুদের ১৩ শতাংশ এবং সালাউদ্দিনের শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট অবিরাম পরিশ্রম আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। তবে আগুন পুরোপুরি নিভে যায়নি, গোটা এলাকায় আগুনের উত্তপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস ঘুরছে-ফিরছে। ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অন্ধকারে গোটা এলাকা রূপ নিয়েছে শ্মশানের মতো। চারদিকে শুধু আগুনের থাবার দাগ ও পোড়া গন্ধ। ফায়ার সার্ভিসের একাধিব ইউনিট ঘটনাস্থলে থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত।

ঘটনাস্থল : চকবাজার চুড়ি হাট্টা

শনাক্ত হওয়া এবং না হওয়া সব মিলিয়ে ৪২টি মরদেহ ঢাকার চারটি সরকারি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল চারটি হচ্ছে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল।

মোট ৬৮টি মরদেহ উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। আগুনে পুড়ে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে এমন ২৬টি মরদেহ তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত সম্ভব হয়নি। আর চেহারা দেখে শনাক্ত করা ৪২টি মরদেহের মধ্যে ২৬টি হস্তান্তর করা হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার মধ্যে। বাকি ১৬টি এবং শনাক্ত করতে না পারা ২৬টিসহ মোট ৪২টি মরদেহ ওই চার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে।

ঘটনাস্থল : চকবাজার চুড়ি হাট্টা

৪২টি মরদেহ ঢামেক হাসপাতালের হিমঘরে রাখার জায়গা নেই। সে জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২টি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের হিমঘরে ১০টি মরদেহ রাখা হয়েছে। বাকি ১৭টি মরদেহ ঢামেক হাসপাতালে হিমঘরে রাখা হয়েছে। 

আগুনে পুড়ে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে এক লাখ এবং আহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তিনি এ ঘোষণা দেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশ প্রধান জাবেদ আলী পাটোয়ারীসহ আরও অনেকে।

আতঙ্ক কাটেনি নিমতলীবাসীর 
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন প্রাণ হারান। ঘটনাস্থলে বিভিন্ন গুদামে রক্ষিত মারাত্মক দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণেই ভয়াবহ এ ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার আতঙ্ক এখনো কাটেনি পুরান ঢাকাবাসীর মন থেকে। রাসায়নিকের গুদামগুলো পুরোপুরি না সরানোয় আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করছেন তারা।

ঘটনাস্থল : নিমতলী- ফাইল ছবি

নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো আরও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযানের জন্য ৪০০ অবৈধ গুদামের তালিকা করে ফায়ার সার্ভিস।

নিমতলী ট্রাজেডির খণ্ডচিত্র

২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এ জন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে আরও একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই কমিটিগুলো কাজই শুরু করতে পারেনি। তারই মধ্যে ঘটে গেলো আরেক ট্রাজেডি।

আরএম/এসএমএম