• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০১৯, ১০:৪৭ পিএম

ফাঁসির আসামি খোকন রাজাকারের ছেলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ বিএনপিও

ফাঁসির আসামি খোকন রাজাকারের ছেলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ বিএনপিও
একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন এবং সুইডেন প্রবাসী তার দুই সন্তান -ছবি : জাগরণ

 

একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন পলাতক অবস্থায় সুইডেনে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন সুইডেন প্রবাসী এক প্রবাসী যিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। ২০১২ সালে এ রাজাকারের নামে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শুরু হলে দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। ওই সময় তিনি বিএনপির সমর্থনে নগরকান্দা পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য জানিয়ে তিনি জানান, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত রাজাকার খোকন সুইডেনের স্টকহোমে তার বড় ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে বসবাস করছেন। একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক এ মেয়রকে তার যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 

বিগত ২৬ বছর ধরে সুইডেনে বসবাসকারী প্রবাসী এক বাংলাদেশি জানান, রাজাকার খোকন আগে এখানে তার মেয়ে ও তার মেয়ের জামাইয়ে সঙ্গে থাকতেন। জামাইয়ের নাম বদিউজ্জামান বদি। কিন্তু ২০১৮ সালে খোকন রাজাকারের বড় ছেলে খায়রুজ্জামান লিংকন সুইডেন যাওয়ার পর এখন ছেলে-মেয়ে দুজনের কাছেই বহাল তবিয়তে তার দিন কাটছে। একাত্তরের কুখ্যাত এ রাজাকারের ছেলে সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলেও নিজেকে সুইডেন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন। নির্বাচন কমিশনের আরপিও অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা থাকা যাবে না। সেই অনুযায়ী সুইডেনে কেন্দ্রীয় যুবদল অনুমোদিত কোনো কমিটি না থাকলেও মাত্র হাজার বিশেক সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে বিএনপির মোট ৪টি গ্রুপ-উপগ্রুপ সেখানে সক্রিয়। যার একটির সভাপতি দাবিদার বাংলাদেশে এক সময়ের আরেক ফাঁসির আসামি মহিউদ্দিন ঝিন্টু। লিংকন ঝিন্টু গ্রুপের যুবদল সভাপতি দাবি করে থাকে। 

খোকন রাজাকারের স্ত্রীর নাম আম্বিয়া বেগম। তাদের মোট তিন ছেলে। এর মধ্যে দুই ছেলে বর্তমানে সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। মেজ ছেলের নাম লেলিন ও ছোট ছেলের নাম পলিন। 

সুইডেন প্রবাসী এক বিএনপি নেতা জানান, কুখ্যাত খোকন রাজাকারের ছেলে লিংকন স্টকহোমে আসার পর সুইডেন সরকারের দুই প্রভাবশালী এমপি উল্লে তোররেল ও আনদেশ অস্টেবাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার করা শুরু করে। আর ওই এমপিদের ভুল বুঝিয়ে ‘বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপি নেতাকর্মী’ দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে আসে। যারা আদৌ মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নয়। 
মূলত, মানুষ পাচারের উদ্দেশ্যে লিংকন এ ধরনের ভুয়া মানবাধিকার সংক্রান্ত সভা-সেমিনার আয়োজন করে। এসব লোকজন সুইডেনে এসে আর দেশে না ফিরে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। আর তাদের কাছ থেকে লিংকনের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা আদায় করে থাকে। 

সুইডেন বিএনপি সূত্র জানায়, যেহেতু স্ক্যান্ডিনেভিয়ার (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড) দেশগুলো মানবাধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তাই বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে হামলা-মামলার যেকোনো ডকুমেন্ট দাখিল করলেই এসব দেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে থাকে। আর এসব দেশের রাজনৈতিক নেতাদের এসব বিষয়ে বিশ্বাস করানোও খুব সহজ। কারণ তারা যেকোনো মানুষকেই বিশ্বাস করে থাকে। আর সাপোর্ট হিসেবে যদি কোনো ডকুমেন্ট থাকে তাহলে কোনো কথাই নেই। 

সূত্র জানায়, লিংকন সিন্ডিকেট প্রথমে বাংলাদেশ থেকে নেপালে লোক নিয়ে সেখান থেকে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে এসব দেশের ভিসা জোগাড় করে থাকে। আর আসার পর তারা দেশে না ফিরেই ওইসব ভুয়া কাগজ দেখিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। বিনিময়ে ওই সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা লাভবান হলেও ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের ইমেজ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বয়ং বিএনপি। কারণ বিলম্বে হলেও এসব দেশের সরকার জেনে যাচ্ছে এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যেসব লোকজন আসছে তারা আদৌ প্রকৃত বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মী যেমন নয়, তেমনি তাদের নামেও নেই মামলা-হামলা ও জীবন হারানোর ভয়। এসব তথ্য ফাঁস হওয়ার পর সুইডেন সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যু করতে বেশ কড়াকড়ি করছে। যা সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য ক্ষতিকর। দেশের ইমেজের জন্যও ক্ষতিকর।
 
জানা যায়, লিংকন সিন্ডিকেটের সঙ্গে নরওয়ে, ইতালি, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডেও মানুষ পাচার চক্র জড়িত। নরওয়েতে মাহদি হোসেন নামের একজন মাত্র ৫ বছর ধরে এসে একটি ল্যাবে সামান্য কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এরইমধ্যে তিনি নরওয়েতে ৫টি বাড়ির মালিক বনে গেছে। যার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। 

নরওয়ের সরকারি দল লেবার পার্টির বাংলাদেশি নেতা ও দেশটির প্রাদেশিক ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাদল ভূঁইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজাকারপুত্র লিংকনদের মতো সিন্ডিকেটের অবৈধ ব্যবসার কারণে আমাদের বাংলাদেশের ইমেজের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। কারণ এরা এসব দেশের কর্তৃপক্ষের সরলতার সুযোগ নিয়ে সরাসরি মানুষ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এসব জানাজানির পর প্রকৃত ও উপযুক্ত বাংলাদেশিরা এসব দেশে আসতে চাইলে বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়ছেন। যা মোটেই কাম্য না।

নরওয়ে বিএনপির সভাপতি বাদল ভূঁইয়া আরও বলেন, লিংকনের অপকর্মের বিরুদ্ধে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তার কারণে বাংলাদেশের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের এখন এসব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এটা শুধু বিএনপির নয়, বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

তিনি জানান, গত ১৭ জানুয়ারি এই মানুষ পাচার চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছি। বৈঠকে কার্ডিফ ইউনির্ভাসিটির প্রফেসর এমএ মালেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য নাসিরুল্লাহ জুনায়েদও অংশ নেন। বৈঠকে আমরা ওই পাচার চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়েছি। এসব দেখে নরওয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা আমাদের বলেছেন, আমরা তোমাদের দেশ বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু কিছু দুষ্টু ও অসৎ লোকের কারণে আমাদের মহৎ উদ্যোগ নষ্ট হয়। আমরা এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।  

টিএস/ এফসি