• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৩:২১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৩:২১ পিএম

একুশ এবং অষ্টাদশ

একুশ এবং অষ্টাদশ

গার্লস স্কুলটিতে ছুটির ঘণ্টা বাজতেই চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে ছেলেটি। এলোমেলো কোঁকড়া চুল, লম্বাটে মুখ, তিন দিন ধরে গায়ে জড়িয়ে রাখা কোঁচকানো একই নীল শার্ট আর শেভ করতে ভুলে যাওয়া গাল দুটি। পকেট থেকে দুমড়ে থাকা পাঁচ টাকার নোটটি ছুড়ে দেয় দোকানদারের দিকে।
—‘সৌরভদা, বাকিটা লিখে রেখো।’ 
সৌরভ সবই বুঝে। মাথা গুঁজে চায়ের কাপ ধোঁয়ায় মন দেয়। এমন রোডসাইড রোমিওরা কাস্টমার হিসেবে মন্দ হয় না। সময়ে-অসময়ে এদের পছন্দ বদলায় হয়তো, তবু রাস্তা বদলায় না। কখনো শিস বাজিয়ে, কখনো একটি লাল গোলাপ হাতে নিয়ে কিংবা বেসুরো গলায় একটু-আধটু গান। এভাবেই তাদের প্রেম চলে। এরা এক রকম বাঁধা কাস্টমার বলা যায়। এদের অপেক্ষা কাটে বিস্বাদের চায়ের কাপে। এদের কানে ছুটির ঘণ্টাগুলো জগতের যেকোনো সংগীতের চেয়ে শ্রুতিমধুর। একেকজনের একেক গল্প। বখাটেদের কাছে ‘এই বুঝি মালটা বেরোল। আজ যা খাসা লাগছে না!’
খুব সিরিয়াস কিংবা সুসময়ের কোকিলসম প্রেমিকগণের কাছে, ‘এই তো, ও বেরিয়েছে। আজ খুব বকব। কতক্ষণ ধরে দাঁড়া করিয়ে রাখল।’
আর অক্ষরের মতো ছেলেদের কাছে গল্পটা একতরফা প্রেমের, আবার সস্তা বখাটেপনারও। 
‘ও এখনো বের হচ্ছে না কেন? আচ্ছা, ও কি একবার তাকাবে ফিরে আজ আমার দিকে? রেগে যাবে না তো আবার? রাগলে বড্ড সুন্দর লাগে অবশ্য।’ 
নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচল এদের প্রধান বস্তু। অক্ষর আজ নীল শার্ট পরেছে। পকেটে থাকা শেষ পাঁচ টাকার নোটটিও চায়ের দোকানে দিয়ে এসেছে। বাড়ি হেঁটেই ফিরে যেতে হবে। অবশ্য হাঁটতে দোষ নেই। হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। ঠিক তখনই নিরু বের হলো স্কুলের গেট থেকে। দুই বেণি দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করছিল বান্ধবীদের সঙ্গে। ক্লাসের রাগী স্যারের বাজে একটি নামকরণই হচ্ছে আজ তাদের হাসির বিষয়বস্তু। এরা অল্পতেই হাসে, অল্পতেই কাঁদে। বয়সটাই এমন। অক্ষরের মতো এলোমেলো ছেলেরা সত্যিকারভাবেই এলোমেলো হয় এদের মতো কারো একজনের জন্য। অক্ষর নিরুকে দেখে গাইতে শুরু করল বেসুরে,
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়।’ 
তখনই কানে আসে একটি বাক্যμ
‘জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেব। রোজ রোজ এক ক্যাচাল। বাড়িতে যেন মা বোন নেই।’
নিরু তাকিয়ে রইল অক্ষরের দিকে ভয়ার্ত চাহনিতে। নিরুর বান্ধবী সীমা বকেই যাচ্ছিল। আসলেই তো! রোজ রোজ কেন যায় অক্ষর এভাবে? নিরুরা চলে যাওয়ার পর অক্ষর সিগারেট ধরায়। শেষ সম্বল সিগারেটটা! 
তখন ঝুম বৃষ্টি আকাশ ভেঙে। নীল শার্ট লেপ্টে রইল গায়ে। শালার সিগারেট! এটাও গেল। এর চেয়ে বাজে বর্ষা যেন কোনোকালে আসেনি আর। অক্ষর তাকিয়ে রইল পথের দিকে শূন্য চোখে। 
কানাঘুষায় শোনা যায়, এর কিছুদিন বাদেই নিরুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। এক রাতে নিরুকে বধূবেশে চলে যেতে দেখে অক্ষর দূর থেকে তাকিয়ে থেকেছিল। নিরু অস্থির চোখে এদিক-ওদিক কী খুঁজছিল? নীল শার্ট পরা এলোমেলো এক যুবককে? নিরুর কানে ভিড়ের সব ধ্বনি ছাড়িয়ে একটি সুরই বাজছিল।
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়...’
অক্ষর মনে মনে একটি কথাই বলেছিল শেষ মুহূর্তে, 
‘নিরুপমা, আমার আর কখনো এই গানটি গাওয়া হবে না। তোমার আমার এই ব্যর্থ প্রেমের ধ্বংসস্তূপ এখানেই আটকে থাকুক, পচে মরুক।
স্মৃতিরা বড্ড খারাপ। অনেক ভোগাবে আমায়...’

দুই.
সকাল দশটা বাজে। বিছানায় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে নীল। জ্যানেট আয়নার সামনে তখন খুব যত্নের সঙ্গে কাজল পরছিল চোখে। প্রতিদিন সকালে পরিপাটি হয়েই জ্যানেট নীলের ঘুম ভাঙায়। নীল আবার একটু বেশিই ঘুমকাতুরে। মাঝে মাঝে রেগেও যায় জ্যানেট ওকে বেশি ডাকাডাকি করলে। জ্যানেট তখন ছবি আঁকতে বসে পড়ে। সে রান্নাবান্না কিচ্ছু জানে না। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু শাশুড়ির কাছে শিখতে যায়। তিনি একটা কথাই বলেন, ‘আগে পড়াশোনাটা, তারপর এসব হবে। যাও এবার, ওপরে যাও।’
জ্যানেট এখানে এসে মেয়ে হয়েই রইল। বাড়ির বউ হয়ে ওঠা আর হলো না এই মায়ের আদরেও। আর নীল! সে বন্ধুর মতো, প্রেমিকের মতো, কখনোবা একজন বিজ্ঞ গার্ডিয়ানের মতো। জ্যানেট ভলিউম কমিয়ে গানটা ছেড়ে দেয়। কিন্নর কণ্ঠে ক্যাসেট বাজতে থাকে, 
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়...’ 
কাগজে পেনসিল ঘষতে থাকে ক্রমাগত। স্মৃতিতে অতীতেরা আবার ডালপালা মেলতে শুরু করে দেয়। নীল গিটারে এই একটি গানই শোনাত জ্যানেটকে। জ্যানেট তখন সত্যিই অষ্টাদশীর ঘরে। কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হতো নীলের সঙ্গে ঘোরাঘুরির অজুহাতে। সময় পেলেই নীল অফিসের ফাঁকে জ্যানেটের সঙ্গে গল্পে ডুবে যেত। অপেক্ষা থাকত রোজ সন্ধ্যার। সন্ধ্যা হলেই গিটারে সুর উঠত। ফোনের ওপ্রান্তে জ্যানেট বিরক্ত হয়ে বলত মাঝেমধ্যে, ‘কী পেয়েছ এই এক গানে বলো তো!’ 
নীল দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলত, ‘আঠারো আর একুশ! সুন্দর কিছু বয়স। আমি আগেই পেরিয়েছি এই বয়সের কোটা। তাই তোমাকে দেখতে চাই এই বয়সটা পার করতে খুব নিপুণভাবে। নিজেকে খুঁজে পেতে চাই নতুন করে তোমার মাঝে।’ বলেই গান ধরতো উঁচু গলায়, 
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়।’ 
দিনগুলো বড্ড সুন্দর ছিল! 
ঘুমন্ত নীলের দিকে তাকিয়ে জ্যানেট ভাবে, সত্যিই কি এভাবে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছিল নীল নিজেকে জ্যানেটের মাঝে? ব্যস্ত, সময়হীন এই মানুষটার মতো?
সামনের ১৩ ডিসেম্বর জ্যানেটের বাইশতম জন্মদিন। জ্যানেট খুব অভিমানী, নীল জানে। নীল কি এখন মনে মনে হাসে জ্যানেটের ছেলেমানুষিতে? জ্যানেট সেদিন বাইশে পা রাখবে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পেনসিল ঘষতে থাকে ক্রমাগত স্কেচবুকে সব ভুলে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায়। অথচ একবার মুখ তুলে তাকালে জ্যানেট হয়তো সদ্য জেগে যাওয়া নীলের মায়াভরা চাহনি দেখতে পেত। নীলের ঠোঁটে মৃদু হাসি এই সুন্দর সকালে!
১৩ ডিসেম্বর এসেই গেল দেখতে দেখতে। জ্যানেট সারাটা দিন বাগানে, ছাদে আলতো পায়চারিতেই কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যাবেলাতেই ঘটল যত বিপত্তি! বাসায় ফিরে দেখে নীল সাজিয়ে রেখেছে গোটা টেবিল ফুলে ফুলে, মোমবাতি আর বিশাল এক কেক রেডি করে। সবাই সেজেগুজে উপস্থিত। মোমবাতিগুলো নেভানো হলো, কেক কাটা হলো। এক লহমায় সময়গুলো ফিরে এলো যেন। গিটার হাতে শেষবারের মতো গাইল নীল, 
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়,
লজ্জা জড়ানো ছন্দে কেঁপেছি
ধরা পড়ি ছিল ভয়।
তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়।’
ঘড়িতে ঢংঢং শব্দ তখন বারোটা বাজার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নীল হেসে বলল, ‘এখন আর কেউই একুশে আটকে নেই আমরা। আমার আর কখনো এই গানটি গাওয়া হবে না। আমাদের সুন্দর স্মৃতিগুলো আটকে থাক এই বয়সটুকুতেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি জ্যানেট, ভালোবেসে যেতে চাই বাকি জীবনের জন্য আরো স্মৃতি কুড়াতে।
কারণ...
স্মৃতিরা খুব সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর বলেই এদের বারবার ফিরে না আসাটা কাঁদাবে আমাদের। বড্ড ভোগাবে...’ 
গল্পগুলো এভাবেই চক্রাকারে ঘুরবে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কিছু দিক নিয়ে। প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলি, স্মৃতিপট এক হলেও শেষটা আলাদা এবং সব সময়ই অন্য রকম।