• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০১৯, ০৮:৩৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২, ২০১৯, ০২:৩৫ পিএম

খালেদার দুর্নীতির পাঁচ মামলার কি অবস্থা?

খালেদার দুর্নীতির পাঁচ মামলার কি অবস্থা?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মিলে মোট ৩৫টি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে করা হয় পাঁচটি মামলা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাগুলো করা হয়। মামলাগুলো হলো জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, নাইকো দুর্নীতির মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতির মামলা ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা।

৩৫টি মামলার মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে এই পাঁচটি মামলা। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে প্রথম দুইটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে কারাভোগ করছেন খালেদা জিয়া।

সর্বশেষ গত রোববার খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ও দলীয় নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন প্যারোলে মুক্তি প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। কারাভোগরত খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সামনে আসায় তার মামলাগুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক তথা আইন-আদালত অঙ্গণে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের সদস্য ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা। মামলাগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথমে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার। এই মামলায় ২০১৮ সালের  ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। পরবর্তীতে হাইকোর্ট দুর্নীতির এই মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ড বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। পরে গত ১৪ মার্চ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হাইকোর্টের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন। এ ছাড়া এই আপিল আবেদনের সঙ্গে তার জামিনও চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও বিচারিক আদালতে দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন খালেদা জিয়া। গত বছর ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী নওশাদ জমির। গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে নওশাদ জমির বলেছেন, আপিলে সাজার রায় বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়াকে খালাসের আরজি জানানো হয়েছে। এতে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করতে, অর্থদণ্ড স্থগিত ও খালেদার জিয়ার জামিনের আরজিও রয়েছে। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ওই মামলায় রায় ঘোষণা করে বিচারিক আদালত।

এদিকে নাইকো দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ শুনানির জন্য সোমবার (১ এপ্রিল) দিন ধার্য ছিল। তবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে আদালতে হাজির না করায় তার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়ে আগামী ১০ এপ্রিল ধার্য করেছেন ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান।

তাছাড়া খালেদা জিয়ার গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৭ এপ্রিল দিন ধার্য আছে।অসুস্থতার কারণে কারাকর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির না করায় গত ১৮ মার্চ তারিখ পিছিয়ে নতুন এই দিন ধার্য করেন আদালত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা কয়লাখনি দুর্নীতি মামলার চার্জশুনানিও পিছিয়ে আগামী ৯ এপ্রিল ধার্য করেছেন আদালত। গত ১৩ মার্চ খালেদা জিয়ার সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজধানীর পুরান ঢাকার বকশিবাজারস্থ অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ এএইচএম রুহুল ইমরান নতুন এই তারিখ ঠিক করেন।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া অন্য ৩০টি মামলা ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। মূলত রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে এসব মামলা হয়। পুলিশ, সরকারি দলের নেতাকর্মী ও আইনজীবীরা এসব মামলা করেছেন। এর মধ্যে ২৫টি মামলা হয়েছে ঢাকায়। কুমিল্লায় তিনটি এবং পঞ্চগড় ও নড়াইলে একটি করে মামলা রয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানচিত্র ও জাতীয় পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে ঢাকার আদালতে ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর মানহানির মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।
১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট সাংবাদিক গাজী জহিরুল ইসলাম মামলাটি দায়ের করেন। 

এদিকে ব্যাংকঋণ খেলাপের অভিযোগে সোনালী ব্যাংক খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে। আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর ওই মামলায় খালেদা জিয়াকে পক্ষভুক্ত করা হয়।

এছাড়া হত্যা ও নাশকতার ১৩ মামলা রয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপিসহ ২০ দলের ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় বাসে আগুন, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মানুষ হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ঢাকায় করা ১০টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এসব মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় ২টি ও দারুস সালাম থানায় ৮টি মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া ২০১৫ সালে বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি বাসে পেট্রলবোমা ছোঁড়া হয়। বাসে আগুন ধরে আটজন যাত্রী পুড়ে মারা যান। এ ঘটনায় ২টি মামলা হয়। ২টিতে খালেদা জিয়া হুকুমের আসামি।

২০১৫ সালে গুলশানে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে পেট্রলবোমা হামলার অভিযোগে করা ১টি মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া এসব মামলাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলছেন বিএনপির আইনজীবীরা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সব মামলাতেই বেগম জিয়ার সংশ্লিষ্টতা আছে।


কারাগারে খালেদা জিয়ার ৪১২ দিন : গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সেই থেকে টানা ৪১২ দিন ধরে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে দিনযাপন করছেন। কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ডিভিশন পান খালেদা জিয়া। সেখানে বন্দিদের সন্তান রাখার ডে-কেয়ার সেন্টারে আছেন তিনি। পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে খালেদা জিয়ার খাবার রান্না করা হয়।

কারাগারে বন্দি হিসেবে দেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) দেখে, পত্রিকা পড়ে এবং নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগি করে সময় কাটান। রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কারাগার সূত্র বলেছে, খালেদা জিয়াকে প্রথমে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে রাখা হয়। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার ১৫ দিন আগে থেকে কারা বিধি অনুসারে ভিআইপি বন্দি রাখার জন্য পুরাতন কারাগারের ‘ডে-কেয়ার’ সেন্টারের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির ডান পাশের দুটি কক্ষ থাকার উপযোগী করে তোলা হয়। আগে এখানে বন্দিদের সন্তানদের রাখা হত। এর মধ্যে একটি কক্ষে লাগানো হয় নতুন টাইলস, সিলিং ফ্যান। বসানো হয় খাট, চেয়ার ও টেবিল। বিটিভি সংযোগ দেয়া হয় সেখানে। ১১ ফেব্রুয়ারি ডিভিশন (প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে বিশেষ সুবিধা) পাওয়ার পর সেখান থেকে খালেদা জিয়াকে বন্দিদের সন্তান রাখার স্থান ডে-কেয়ার সেন্টারে নেয়া হয়। এরপর থেকে তাকে পড়ার জন্য একটি দৈনিক পত্রিকা দেয়া হয়।

কারা সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়া ঘুম থেকে উঠে সকালের নাশতা হিসেবে রুটি ও সবজি খান। কারাগারে প্রতিদিন তাকে একটি দৈনিক পত্রিকা দেয়া হয়। এরপর গোসল করেন। এরপর কিছু সময় বিশ্রামের পর দুপুরে জোহরের নামাজ পড়েন। জোহরের নামাজ শেষে তিনি দোয়া-দরুদ পড়েন। মাঝে মাঝে বারান্দায় পায়চারী করেন, চেয়ারে বসেন।

দুপুরের খাবার খান একটু দেরিতে, সচারচার বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার দিকে। দুপুরে তাকে ভাত, সবজি, রুই বা আইড় মাছ খেতে দেয়া হয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর বিটিভি দেখেন। এরপর রাতের খাবার খান। রাতে সবজি ও রুটি, মুগ ডাল খেতে দেয়া হয়। কোনো কোনো দিন রাতে ভাত খেতে দেয়া হয়। খাবার শেষে আবার খালেদা জিয়া বিটিভি দেখেন।

কারাগারে তার খাবার রান্না করা হয়। রান্না করা এ খাবার কারাগারের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে উপকারাধ্যক্ষ ও কারাধ্যক্ষ খান। পরে চিকিৎসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়। তিন বেলাই এসব নিয়ম মানা হয়।

দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানের জন্য আদালতের আদেশে গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তার বিশ্বস্ত গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম তার সঙ্গে কারাগারে আছেন। তিনি দিনে কর্তব্যরত নারী কারারক্ষীর কাছে থাকেন। ডাকা হলে তিনি খালেদা জিয়াকে ওষুধ দেয়াসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেন। রাতে ঘুমান খালেদা জিয়ার পাশের কক্ষে। খালেদা জিয়ার সেবায় কারাগারের ভেতরে সার্বক্ষণিক একজন নারী ফার্মাসিস্ট, প্রয়োজন হলে একজন চিকিৎসক থাকেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় খালেদা জিয়ার কক্ষ ঘিরে একজন নারী উপকারাধ্যক্ষের নেতৃত্বে সার্বক্ষণিক ৪ জন নারী কারারক্ষী থাকেন। কারাগারের বাইরে আছেন একজন উপকারাধ্যক্ষের নেতৃত্বে একদল কারারক্ষী। আরও আছেন পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া প্রায় সময় শান্ত ও চুপচাপ থাকেন। কারা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি কোনো চাহিদার কথা জানান না। কিছু লাগবে কি না- কারা কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় খোঁজ নিতে গেলে খালেদা জিয়া বলেন, প্রয়োজন হলে তিনিই জানাবেন।

টিএস/মাআ/বিএস