• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০২০, ০৪:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৮, ২০২০, ০৪:১৯ পিএম

স্মৃতির শহর রাজশাহী-চার

স্মৃতির শহর রাজশাহী-চার
জাকির হোসেন

......

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্তনিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ 
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥

                         – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(পূর্ব প্রকাশের পর) 

রাজশাহীর মাটিতে একটা অদ্ভুত মায়া আছে, মমতা আছে, দুঃখ আছে, কান্না আছে, দ্রোহ আছে, বিদ্রোহ আছে, প্রতীক্ষা আছে, দীর্ঘশ্বাস আছে। রাজশাহীর মাটির মায়া দূর থেকে সবাইকে নিরন্তর স্পর্শ করে, অবিরাম কাছে টানে এবং একটি স্থায়ী সম্পর্কের মধ্যে ধরে রাখে। এই মাটির গহীনে লুকিয়ে থাকা দুঃখ, কষ্ট ও কান্না জীবনবোধকে আরো জাগ্রত করে, ব্যর্থতার বোধকে দূরে সরিয়ে দেয়, মনে সাহস আনে, সাহসী মানুষ হিসেবে জ্বলে ওঠার অনুপ্রেরণা দেয়, শাসন শোষণ নির্যাতন ও নিপিড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানায়। এই মাটিতে মিশে থাকা দীর্ঘশ্বাস জীবন তৃষ্ণাকে বিস্তৃত করে, জীবনবোধকে গভীর করে। তাই দূর থেকে বিস্মৃতির বেদনা দিয়ে এই মাটির মমতাকে ঢেকে রাখা যায় না, বৈরাগ্যের উদাসীনতা দিয়ে উপেক্ষা করা যায়, মনের আড়াল করা যায় না।

রাজশাহীর কথা মনে হতেই বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ ভেসে আসে। পদ্মার বিশুদ্ধ বাতাস ভেসে আসে। হারমোনিকার সুমধুর সুর ভেসে আসে। কানে নয়, মনের গহীনে। মনটা শ‍ূন্যতায় ভরে ওঠে, দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে, অকস্মা‍ৎ মনটা এলোমেলো হয়ে যায়। কোনো কাজে মন বসাতে পারি না। যেন শহরজুড়ে হেমন্ত এসেছে। মনের মধ্যে বাঁশীর সুর বাজছে, আর বাইরে ঝরে পড়ছে হলুদ বিবর্ণ পাতারা। তখন নাসিম ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। এই নাসিম ভাইকে ছাড়া রাজশাহীর কথা ভাবতেই পারি না। রাজশাহীর স্মৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন তিনি। নাসিম ভাই আমার কয়েক বছরের বড়। আমাদের পাবনার মানুষ, অতিশয় স্বচ্ছ সুন্দর ভদ্র বিনয়ী মানুষ। তবে তার প্রধান পরিচয় তিনি একজন বিরল প্রজাতির বোহেমিয়ান-“অঙ্গহারা, সঙ্গছাড়া, হতচ্ছাড়া মন”। কেননা কৈশোরে তিনি মাকে হারান। তখন তার বয়স চৌদ্দ। পড়েন ক্লাস নাইনে। তখন তার মায়ের হার্টের একটি ভাল্ব নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকার ডাক্তাররা এক পর্যায়ে জানিয়ে দেন তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। ফলে তাকে গ্রামের বাড়িতে নেয়া হয়। গ্রাম বলতে পাবনার সুজানগর থানার ‘সাতানি’ গ্রাম। সেখানে তার চিকিৎসার ব্যাপারে গ্রামের সাধারণ মানুষ নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দেন। গ্রামবাসীদের একজন জানান, নিকটবর্তী ‘বাদাই’ গ্রামে একজন কবিরাজ আছেন। তার বশে আছে এক অতিলৌকিক দানব। এই দানবের নাম ‘নিকুন্টে’। তার মাথা নেই, বুকের উপর বড় বড় দুটি চোখ। এই দানবের মাধ্যমে সেই কবিরাজ সর্বরোগের চিকিৎসা করেন। নাসিম ভাই তার নানার পারমর্শে একদিন বিকেলে সাইকেল যোগে সেই কবিরাজের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। রাস্তায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। চারিদিকে জন-মানবহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তর, নির্জন ভূতুরে রাস্তা, একটা গা ছমছমে পরিবেশ। দূরে থেকে ভেসে আসে আজানের সুর, মন্দিরের ঘন্টার ধ্বণি, আর শাখের শব্দ। সামনে মরা নদী, হাটু পানি। সাইকেল কাঁধে নিয়ে নদী পার হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে সেই কবিরাজের বাড়িতে পৌঁছান। এযেন মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের জন্য এক কিশোরের  দুঃসাহসিক অভিযান! সেই রাতে ওই কবিরাজের বাড়িতেই তিনি থাকেন। এরপর ভোররাতে তাবিজ-কবজ ও পানিপড়া নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। না! সেই অলৌকিক দানব বশে রাখা কবিরাজের ওষুধ কোনো কাজে আসেনি।

১৯৮২ সাল। সেদিন ছিল অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ, পবিত্র সবেবরাত। কয়েক ঘন্টা পর এই গ্রহের মানুষের ভাগ্যরজনী! এমন দিনে মা তার হতভাগ্য চার সন্তানকে রেখে মৃত্যু নামে এক ভয়ঙ্কর রহস্যময় জায়গায় চলে গেলেন। এমন নিষ্ঠুর কাজ তিনি জীবনে আর কখনো করেননি...

মায়ের মৃত্যুকে নাসিম ভাই নিদারুন অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করেন। এই স্মৃতি তাকে এক মুহুর্তের জন্যও ছুটি দেয় না, স্বস্তি দেয় না। নিষ্ঠুর নিয়তি তার জীবনের সবচেয়ে আপনজনকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়। নাসিম ভাই  জানেন, জীবনের সব আশা, সব প্রত্যাশা, সব দু:খ, সব বিষাদ একদিন মৃত্যুর মহাসমুদ্রে শান্ত হয়ে যায়। তবু মায়ের মৃত্যুতে তিনি জীবনকে নতুন রূপে উপলব্দি করেন, জীবনকে তিনি নতুন রূপে দেখতে পান। সেরূপ সুন্দর নয়-নি:সঙ্গতায়, হতাশায়, ব্যর্থতায় বড়ই মর্মান্তিক!

মায়ের মৃত্যুর পর নাসিম ভাইয়েরা রাজশাহীতে বসবাস শুরু করেন। হেতেমখা কাস্টমস অফিসের পাশে একটি বাসায় থাকতেন তারা। প্রথমে ছিলেন নিচতলায়, কিছুদিন পর উঠলেন ওই বাসার দোতলায়। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় আমি মাঝে মধ্যে তাদের বাস‍ায় যেতাম। বাবা, বড় বোন জেসমিন, ছোটবোন লাইজু আর ছোট ভাই রাজুকে নিয়ে ছিলো নাসিম ভাইদের সংসার। তারা সবাই এই বাড়িতে থাকতেন। তবুও বাড়িটা সব সময় একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন থাকতো। এ যেন অন্তহীন শূন্যতায় এক বিরামহীন শোক সভা!

আমি শরৎ পূর্ণিমায় গভীর রাতে সমুদ্রের নিঃসঙ্গতা দেখেছি, শুনেছি তার গগন বিদারি নীরব হাহাকার। হেমন্তের বিষন্ন বিকেলে পাহাড়ের একাকীত্ব দেখেছি, তার বুকের গহীনে জমাটবাঁধা দুঃখ দেখেছি। শীতের সোনালী সকালে তেপান্তর দেখেছি, ধু ধু শূন্যতা দেখেছি, সর্বগ্রাসী হাহাকার দেখেছি। কিন্তু নাসিম ভাইদের বাসার মতো এমন অদ্ভুত স্তব্ধতা, এমন অদ্ভুত শূন্যতা কোথাও দেখিনি। অথচ বাসার দরজা পার হলেই এক প্রাণচঞ্চল ব্যস্ত শহর। চারিদিকে মানুষের সরব উপস্থিতি, কারখানার আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, রিকশার টুংটাং শব্দ, কাকের কাকা ডাক, চড়ুইয়ের কিচির মিচির, দলবেঁধে ছুটে চলা শিশু-কিশোরদের হৈ হল্লা, আরো কত কি?

নাসিম ভাইদের বাসায় গেলে প্রথমেই দেখা হতো জেসমিন আপার সঙ্গে। বাসার দোতলায় ঝুল  বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। চোখ মেলে রাখতেন আকাশের দিকে। মন যেন তার মেঘেদের সঙ্গী। কবি হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। স্থানীয় পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। প্রকাশিত কবিতাগুলো যত্ম করে সংগ্রহ করতেন। আমি তার কবিতা পড়েছি। তার কবিতার দুঃখগুলো আকাশ চেনে, আর আকাশও সহানুভূতি জানায়, নীল আকাশ কখনো মানুষের সুখ-দুঃখে উদাসীন থাকে না। জেসমিন আপা নিজেও উদাসীন ছিলেন না। লিখেছেন গভীর সহানুভূতির সঙ্গে। তার লেখায় কোথাও কোনো ফাঁক বা ফাঁকি ছিল না। লিখতেন গভীর মমতায়। বড্ড সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন তিনি।

আমি গিয়ে বসতাম নাসিম ভাইয়ের রুমে, সঙ্গে থাকতো রাজু। আমরা তিনজন মুখোমুখি বসে টুকিটাকি কথা বলতাম। নাসিম ভাই নানারকম স্মৃতিচারণ করতেন। তিনি বরাবরই একটু স্মৃতিকাতর মানুষ ছিলেন। কৈশোরে মা-বাবা হারা মানুষগুলো এমনই হয়। বয়স যতই বাড়ে তাদের স্মৃতিকাতরতা ততই বাড়ে।

মায়ের মৃত্যুতে নাসিম ভাই নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। কেননা মা-বাবা হারানো দুঃখটা এক রহস্যময় দুঃখ, যাকে শুধু অনুভব করা যায়, কিন্তু সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না, ব্যাখা করা যায় না। নাসিম ভাই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে নিজেকে খুজে পাওয়ার চেষ্টা করতেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতার মধ্যে নিজের দুঃখ খুজতেন। আর বাজাতেন শখের হারমোনিকা। চলতি পথে তিনি যখন হারমোনিকা বাজাতেন তখন তার বাঁশির সুর শুনে পথচারীরা মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়াতো। ব্যস্ত শহরের সব কোলাহল যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যেতো। ক্রমশ স্পষ্ট হতো হারমোনিকার সুর,- “আপনা দিল আওয়ারা”। এই স‍ুর ছড়িয়ে যেত শহরময়। এযেন পাখি ডাকা ভোর, অরুণ আলোয় জীবনের হাতছানি, হৃদয় খুঁড়ে তোলা এক অলৌকিক পরশ পাথর। মা হারানোর দুঃখের গভীরেই ছিলো তার এই সৃজনশীলতার চেতনার শেকড়। তিনি নিমগ্ন ছিলেন সুরের সাধনায়। মা হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা আড়াল করতে তিনি বিশুদ্ধ সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে দিতেন শহরময়। তিরিশ বছর আগের সেই সুর আজও আমাদের হৃদয়ে বাজে, সেই সুর আজও আমার হৃদয় থেকে মুছে যায়নি, সেই সুর আজও ভুলিনি,  কিছুই ভুলিনি।

কলেজ হোস্টেলে উঠার আগে আমি কয়েকদিন ছিলাম তালাইমারি কে-ফিফটি ফাইভ মেসে। এরপর সিপাইপাড়া একটি মেসে, ঘোষপাড়া মোড়ের কাছে স্বাধীনদের বাড়িতে। এখানে নাসিম ভাই প্রায়ই আসতেন। রাস্তা থেকে ভেসে আসা হারমোনিকার সুর আমাকে পৌছে দিতো তার আগমনী বার্তা। তিনি সাধারণত বিকেলের দিকে আসতেন। তারপর আমরা দুজন যেতাম পদ্মার ধারে, অথবা কোনো নির্জন রাস্তায়। নিঃসঙ্গতা এবং নির্জনতাকে আমরা দুজন খুব ভালো বাসতাম, খুব উপভোগ করতাম। নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ খুব ভালো সময় কাটতো আমার। আমরা প্রায়শই সন্ধ্যায় অলকার মোড়ে গিয়ে জিলেপি খেতাম, আর সোনাদিঘির মোড়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খেতাম গরুর দুধের ঘন চা। এরপর ধরাতাম সিগারেট। তখন আমরা দুজনই ধূমপায়ী ছিলাম। আমার ব্র্যান্ড ছিল ‘বেনসন এন্ড হেজেজ’, আর নাসিম ভাই খেতেন সুগন্ধি তামাক ‘অ্যারিনমোর’। হল্যান্ডের তৈরি এই অ্যারিনমোর নব্বইয়ের দশকে তরুণদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। আমি কিছু দিনের জন্য বেনসন ছেড়ে অ্যারিনমোর ধরেছিলাম। এখন চলতি পথে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় যখনই অ্যারিনমোর বিক্রি করতে দেখি তখন রাজশাহীর কথা খুব মনে পড়ে। আর তখনই অকস্মা‍ৎ আমার হাত ধরে টান দেয় রাজশাহীর সোনালী বিকেলের ক্লান্ত শহর, দল বেধে ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষের দীর্ঘ ছায়া, শ্রমজীবী নির্বিকার মানুষের বুক থেকে ‍উঠে আসা হাপরের শব্দ, বুকের ইঞ্জিনের কান্নার শব্দ। আমার হাত ধরে টান দেয় কুমার পাড়ার শাখের আওয়াজ, কাসরের শব্দ, ধুপের গন্ধ, আর পদাবলী কীর্তন। আমার হাত ধরে টান দেয় ব্যাস্ত শহরে ছুটে চলা ঘোড়ার গাড়ি, কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন, শান্ত পুকুর, শান বাধানো ঘাট, গরম জিলেপি, কালাইয়ের রুটি, গরুর দুধের চা, আর বেনসন সিগারেট। আমার হাত ধরে টান দেয় টি বাঁধ, শরতের সূর্যান্ত, শ্বেতশুভ্র কাশফুল, রূপালী চাঁদ, জ্যোৎস্নার হাসি, স্নিগ্ধ বাতাস, ঝাল মাখানো পেয়ারা, জলপাই ও চ‍ালতার আচার।    

ব্যস্ত শহরের কোলাহল ছেড়ে আমি ছুটে যাই পদ্মার আঘ্রাণ নিতে। ছুটে যাই পদ্মার ধারে। যেখানে রাত নেই, যেখানে দিন নেই, সময় যেখানে স্থীর-বান্ধবীর ঠোটে ঠোট রাখার সময় যেমন থমকে যায় মহাকাল। আমি ছুটে যাই টি-বাধের দিকে। যেখানে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে অগণিত অশরীরী অপ্সরা। যেখ‍ানে বাতাসের গন্ধ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রকে জাগ্রত করে, জীবন্ত করে, প্রাণবন্ত করে। যেখানে আমার সমস্ত ব্যাকুলতা অবিরাম ঢেউয়ের তালে দোলে। যেখানে মহাকাল এক নগ্ন রাজার বেশে আমাদের মুখোমুখী এসে দাঁড়ায়, আমাকে উপহাস করে, আর আমি তাকে তুচ্ছ জ্ঞানে অবহেলা করি, থোরাই পড়োয়া করি। 

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে, রাত্রি গভীর হয়। পদ্মার বুকে নামে ঘোর অন্ধকার। মোচার খোলার মতো যত্রতত্র ভাসতে থাকে ডিঙি নৌকা। হারিকেনের মৃদু আলো ক্রমেই উজ্জ্বল হয়, যেন জোনাকি ফুটেছে নদীর গায়। নাসিম ভাই যেন সেই আগের মতো আপন মনে বাঁশী বাজাতে শুরু করেন। আমি ধীরে ধীরে নেমে যাই নদীর কাছে, সেখানে কেউ নেই, এক‍া একা শুয়ে আছে নদীর কায়া। আমি তার শীতল শরীর স্পর্শ করি। পানিতে পা ডুবিয়ে দিই। এক‍া একা বসে থাকি। হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসে উৎকট গন্ধ, সন্নিকটে শিবের শিষ্যদের উপস্থিতি অন‍ুভব করি। দেবদারু পাতার সরসর শব্দ চারপাশের স্তব্ধতাকে আরো ঘনীভূত করে। কৃষ্ণ গহ্বরের মতো ঘোর কালো নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে দলবেধে বুনো হাতির মতো উঠে আসে আমার পরাজয়, আমার দুঃখ, আমার নিঃসঙ্গতা, আমার ব্যর্থতার বোধ। অকস্মাৎ ভেসে আসে জলের শব্দ, অন্ধকারের বুক চিরে লন্ঠন দুলিয়ে দুলিয়ে ছুটে চলে একটি মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকা। পদ্মার বুকে মাছের আকাল, নদীর দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে যায় দুঃখী ধীবরদের। তাদের বুকের গহীন থেকে উঠে আসা হাহাকারে শূন্যতায় ভরে ওঠে চারপাশ। আর তখনই অবিকল শিশুর মতো পদ্মার জলে ঝাপ দেয় আমার উদাস করা মন-খারাপের দল। আমার দুঃখরা নদীর জলে পরম আনন্দে ঝাপাঝাপি করে, ডুব সাতারে মেতে ওঠে। নাসিম ভাই নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়ান, হাত রাখেন আমার কাঁধে। সংবীত ফিরে এলে আমি উঠে দাঁড়াই, অতপর পা বাড়িয়ে দেই ঘুমন্ত শহরের দিকে...  

রাজশাহী ছাড়ার পর নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে পারিনি। নাসিম ভাইয়ের কথা মনে হতেই স্মৃতির জানালায় মুখ গুঁজে দেয় জেসমিন আপা ও রাজু। কেমন আছেন জেসমিন আপা! এখনো কি তিনি ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন! এখনো কি কবিতা লিখেন! নিজের দুঃখ আর শূন্যতা শব্দের বুননে বিস্তৃত করেন! এতদিন হয়তো জেসমিন আপার কবিতার ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে, একাধিক কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে, সুধী সমাজে তার অনেক নাম, বিভিন্ন সাহিত্য সভায় সমকালীন কবিতা নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন। এতদিনে অবশ্যই তার বিয়ে হয়েছে, সংসারী হয়েছেন তিনি, জেসমিন আপার বর নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ। তাদের হয়তো ফুটফুটে দুটি বাচ্চা আছে। স্বামী, সন্তান, সংসার এসব নিয়ে তিনি ভালোই আছেন। সকালে উঠে স্বামী অফিসে যান, আর জেসমিন আপা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যান, স্কুল থেকে বাসায় ফিরে কবিতা পড়েন, কবিতা লিখেন, বেশ পরিপাটি সুখের জীবন তার!

এরপর মনে পড়ে রাজুর কথা। রাজু নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক বড় হয়েছে, লেখাপড়া শেষ করেছে, চাকরি করছে, বিয়েও করেছে, তবে এখনো তাদের বাচ্চা হয়নি, বউ নিয়ে তারা দুজন জেসমিন আপার বাসায় থাকে। তারা আলাদা বাসা নিয়েছে থাকতে পারে, কিন্তু জেসমিন আপা তাদের আলাদা থাকতে দেয় না, তাকে চোখে চোখে রাখতে চায়, মনের কাছে রাখতে চান, ভাই বোনের দূরত্ব বাড়াতে চান না।

আর নাসিম ভাই হয়তো আজও বোহেমিয়ানই রয়ে গেছেন। অনেক নস্টালজিয়া বুকে চেপে, অনেক দুঃখ, অনেক  বঞ্চনা, অনেক অভিমান বুকে চেপে তিনি হয়তো আজও হারমোনিকায় বিশুদ্ধ সুরের চর্চা করে যাচ্ছেন। শহরময় ছড়িয়ে দিচ্ছেন হারমোনিকার সুর, তার বাঁশীর সুরে এখনও থমকে দাঁড়ায় পথচারী ব্যস্ত মানুষ...

কারো সাথে যোগাযোগ নেই বলেই সবাইকে নিয়ে প্রায়শই এমন আকাশ-পাতাল কল্পনা করি। আসল সত্যকে জানার চেষ্টা করিনি। কেননা আমি নিজেই তখন এক ঘোরতর বহেমিয়ান। ঢাকায় থাকি, দিন রাত্রির ব্যবধান দিয়েছি ঘুচিয়ে। মাঝে মধ্যে কবিতা লিখি। আর সারাক্ষণ কবি সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। দিক ভুল করা পাখির মতো আমরা দুজন অবিরাম উড়ে বেড়াই শহরময়। যেন আমাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, কোনো ঠিকানা নেই। বিকেল হলেই ছুটে যাই শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে, আড্ডা দেই জাতীয় কবিতা পরিষদের ‍অফিসে, গভীর রাতে ক্লান্ত, অবসন্ন, বিষন্ন মনে ফিরি ঘরহীন ঘরে। আমি  নিজেই তখন নিরুদ্দিষ্ট বাবা মা ভাই বোনদের কাছে, বন্ধু পরিচিতজনদের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও। আমি নিজেই তখন নামহীন গোত্রহীন এক পলাতক মানুষ। একদিন বিকেলে আজিজ সুপার মার্কেটের দোতালায় উত্থান পর্ব একাত্তরের অফিসে আহমদ ছফা আমাকে বললেন, “তুই কবিতা লেখা বাদ দে। কবিতা লিখলে তুই বাঁচতে পারবি না। মারা যাবি। তুই বরং সাংবাদিকতায় মনোযোগ দে, এতে প্রাণে বেঁচে যাবি।” ছফা ভাইয়ের পরমর্শে কবিতা ছাড়লাম। মনোযোগ দিলাম সাংবাদিকতায়। শুরু হলো আমার অন্যজীব্ন। দেখতে দেখতে কেটে গেলো বিশটি বছর।

দু’বছর আগের কথা। সেদিন ছিলো রোববার, বর্ষাকাল। সকাল থেকেই বৃষ্টির বিরাম নেই, দুপুরে শুরু হয়েছে ভারী বৃষ্টি, দুপুর না গড়াতেই শহর জুড়ে নেমেছে ঘোর অন্ধকার। সন্ধ্যায় অফিসের জানালায় চোখ রাখতেই দেখি বাইরে তুমুল বৃষ্টি। চারপাশে শুধুই বৃষ্টির ঝুপ ঝুপ ঝুপ ঝুপ শব্দ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে গোটা শহর ঝলসে উঠছে। অফিসের পাশেই মহাসড়ক, রাস্তার ধারে এলেমেলো কয়েকটি গাছ অন্ধকারে ভিজছে। গাছের নিচে ছিন্নমূল মানুষের কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। এই ঘোরতর দুর্যোগে সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। ওই দিকে তাকালেই  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটি মনে পড়ে। নীলমনির কথা মনে পড়ে, সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মুখোমুখী হতে আমার ইচ্ছে করে না। তাই দ্রুত ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিই। কফিতে চুমুক দিয়ে কম্পিউটার অন করতে ফেসবুক থেকে নোটিশ এল- “পিপল ইউ মে নো”। প্রোফাইল ছবিটা দেখে বিস্ময় আর আনন্দে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। ধূসর বিবর্ণ সন্ধ্যাটা মুহুর্তেই রঙিন হয়ে উঠলো। প্রোফাইল পিকচারে দেখি নাসিম ভাই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে তার তিন কন্যা ও স্ত্রী। নাসিম ভাই রোমান্টিক মানুষ, তাই তার সঙ্গে আরো কয়েকটা ছেলে মেয়ে থাকলেও আমি বিস্মিত হতাম না। নাসিম ভাইয়ের প্রোফাইল চোখে পড়তেই তিরিশ বছর আগের সব স্মৃতি আবার ফিরে এলো, মুহুতেই তারা জীবন্ত হয়ে উঠলো, ডালপালা মেলে বিস্তৃত হতে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভেজা কাকের মতো পাখা মেলে উড়তে শুরু করলো।  তৎক্ষণাৎ তাকে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠালাম। মেসেঞ্জারে ফোন করে কথা বললাম। শুরুতেই জানতে চাইলাম জেসমিন আপা আর রাজু কেমন আছে। কথাটা শুনেই তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভেজা ভেজা হয়ে উঠলো তার চোখ দুটো। আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। নাসিম ভাই কয়েকটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের পেছন দিয়ে চোখ দুটি মুছলেন। অতপর নিরবতা ভাঙলেন। বললেন, “জেসমিন আপা নেই। উনি মারা গেছেন সেই উননব্বই সালে। ক্যান্সার হয়েছিল তার। প্রথমে ক্যান্সার ধরা পড়েনি। খাদ্য নালীতে টিউমার হয়েছিলো। অপারেশন করার পর সুস্থ হয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর ইনফেকশন হয়। পরে বোঝা যায় ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে। এ থেকে তাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় ছিলো না।” 

কথাটা শুনে মনটা বিষাদে ভরে উঠলো। তারপর বললেন, কয়েক বছর আগে রাজু আত্মহত্যা করেছে। তখন অশ্রু সংবরণ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না, চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করল, আর রাজুর স্মৃতি ক্রমশ উজ্জ্বল হতে লাগল, মনের মধ্যে শুরু হলো ভাঙচুর আর তোলপাড়। রাজু বড্ড অভিমানী ছিল, মায়ের মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিলো সাত-আট বছর। জন্ম আর মৃত্যুর পার্থক্য তখনো সে বোঝে না। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত রাজু প্রথম যৌবনে প্রেম ভালোবাসার মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জগৎ সংসারে প্রেম ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না। হতভাগ্য রাজুর কপালেও জোটেনি। হতাশা, দুঃখ, বঞ্চনা আর পুঞ্জিভূত কষ্টে জীবনটা তার কাছে বোঝা হয়ে ওঠে। প্রেমিকার ছলনা সইতে না পেরে সে একবার ঘুমের অষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলো। দ্রুত হাসপাতালে নেয়ায় সেই যাত্রায় তাকে বাঁচানো গিয়েছিলো। রাজু নতুন জীবন পেলেও জীবনের প্রতি তার কোনো মায়া ছিলো না, কোনো আগ্রহ ছিলো না, কোনো টান ছিলো না। সে আর কখনই আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

২০১২ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের বিষন্নতা শেষে অদ্ভুত এক বসন্ত এসেছে শহরে। চারিদিকে ফুল ফুটেছে, পাখি ডাকছে, রঙ লেগেছে বির্বণ দেয়ালে। রাতের শেষ প্রহরে কোকিলের ডাক ভেঙে দেয় সব স্তব্ধতা। ভোর সকালে সোনালী রোদ্দুর ছড়িয়ে পরে শহরময়। আউলা বাতাস ঘুরে বেড়ায় শহরময়। মানুষের মনে বইয়ে দেয় প্রাণের জোয়ার। মানুষের মনে জাগে নতুন প্রেম, নতুন আশা, নতুন ভালোবাসা। কিন্তু রাজুর মনে নেই কোনো আনন্দ। তার মনের গহীনে বইছে বৈরী বসন্তের বিষন্ন হাওয়া। সুখ এখানে নেই, শান্তি এখানে নির্বাসিন, আনন্দ এখানে পলাতক। জীব্নটা তার কাছে যেন শুধুই নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, দুঃখ, কষ্ট আর প্রবঞ্চনার বোঝা। তাই আত্মহনের পথ বেছে নেয় সে। আমাদের সবাইকে ছেড়ে সে অনন্তলোকে চলে যায়। সে এখন আমাদের সবার ধরা ছোয়ার বাইরে। আমাদের জাগতিক চোখের বাইরে। জাগতিক হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থ, সংকীর্ণতা ও জটিলতা থেকে মুক্ত। চিরকালের মতো সে নিজের ভালোবাসার জায়গায় চলে গেছে।  দৃষ্টির সীমানা পেড়িয়ে সে মায়ের কাছে চলে গেছে। মায়ের পরম আদরে ভালোই আছে সে। ইহজাগতিক প্রেম ভালোবাসার জন্য এখন তার মনে কোনো ব্যর্থতার বোধ নেই, কোনো বঞ্চনা নেই, কোনো হাহাকার নেই, কোনো দুঃখ নেই, কোনো কষ্ট নেই...  

এবার নাসিম ভাইয়ের কথা আরেকটু বলি। মায়ের অসুখের সময় ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে দৌড়াতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল তার। সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। কিন্তু নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তার কোনো ব্যর্থতার বোধ নেই। কেননা তিনি বাস্তববাদী মানুষ। আর বাস্তববাদী বলেই তিনি বুঝতে পেরেছেন স্বপ্নকে রাখতে হয় স্বপ্নের জায়গায়, বাস্তবকে বাস্তবের। দুটোকে মিলিয়ে ফেলতে নেই। এতে দুঃখ বাড়ে, কষ্ট বাড়ে, যন্ত্রণা বাড়ে। তাই স্বপ্নকে বাস্তব করতে গিয়ে জীবনের ছদ্ম হারাননি তিনি। এখন তিনি নিজ গ্রামের কলেজে অধ্যাপনা করেন। নাগরিক জীবনে অভ্যন্ত নাসিম ভাই এখন গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে অনায়াসে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। গ্রামে বসবাস তার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। এটা তিনি কোনোদিন স্বপ্নেও চিন্তা করেননি। কিন্তু সময় এক অদ্ভুত জাদুকর। সময় তার নিজের প্রয়োজনে মানুষের সব কিছু পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় মানুষের চিন্তা, চেতনা, আকাঙ্খা, উদ্যোগ, প্রতিশ্রুতি, সম্ভাবনা, যাপিত জীবন সবকিছু। এক সময় যে হারমনিকায় সুর তোলাটা ছিল নাসিম ভাইয়ের ধ্যান। যে সুরের সঙ্গে তিনি ভাগ করে নিতেন তার সমস্ত নিঃসঙ্গতায়, সমস্ত মনোবেদনা, যে সুর তার ভিতরের তাড়না, চোখের জল, মনের জিজ্ঞাসা আর দ্বন্দ্ব ও মিনতিকে ব্যক্ত করতো, যে গান আর সুর নিয়ে তিনি দ্বীপান্তরে যেতেও রাজি ছিলেন, সেই মানুষটি এখন হারমোনিকায় সুর তোলা ছেড়েছেন। মানুষের দুঃখ যখন গভীর হয় তখন সে অনুভূতিহীন হয়ে যায়, স্থবির পাথর হয়ে যায়, তখন তার বেঁচে থাকার জন্য কোনো বিশেষ অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না। দুঃখ, কষ্ট ও বঞ্চনার বোধই তার বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হয়ে যায়। 

বড় বিচিত্র এই পৃথিবী। বড় বিচিত্র আমাদের জীবন। আমাদের জীব্নটা যেন জন্ম-মৃত্যুর এক প্রগাঢ় কৌতুক। হাসি ও কান্নার এক নিদারুন প্রহসন। জেসমিন আপা আর রাজুকে নিয়ে আমি ভেবেছিলাম এক। হলো আরেক। এটাকে নিষ্ঠুর নিয়তির এক ভয়ঙ্কর উৎপাত ছাড়া আর কিই বা বলা যায়!  মনের মধ্যে হাটাহাটি করতে শুরু করলো সিগমন্ড ফ্রয়েড। বার বার ঘুরে ফিরে মনে এলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র সেই স্মরণীয় উক্তি-“সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।” সত্যিই এক অদৃশ্য সুতোর তারেই হয়তো বাঁধা আমাদের জীবন। এই সত্যই মিলে মিশে যায় আমাদের অনেকেরই যাপিত জীবনে। দিন যায়, সময় অতিবাহিত হয়, রাজশাহীর আকাশে প্রতিদিন নতুন সূর্য ওঠে, পদ্মার বুকে জেগে ওঠে নতুন চর, বর্ষায় সেই চর আবার বিলিন হয়ে যায়, যাপিত জীবনে প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা আসে, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের অভ্যাস বদলায়, সমাজ বদলায়, পুরনো মূল্যবোধেরও বদল ঘটে, কিন্তু আমাদের অন্তর্গত দুঃখ, কষ্ট ও বঞ্চনার কোনো বদল হয় না, আমাদের সম্পর্কের মূল সুর কিংবা অন্তগর্ত টানাপড়েনের কোনো বদল ঘটে না...

লেখক ● সাংবাদিক

আরও পড়ুন