‘পেটে মরি গেছিরে বাপ, মেলা দিন নাড়ে ভালা কিছু পড়ে না’

পীর জুবায়ের, সুনামগঞ্জ প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১, ০১:০২ পিএম ‘পেটে মরি গেছিরে বাপ, মেলা দিন নাড়ে ভালা কিছু পড়ে না’

‘কি রে বাপ কিছু লাগবো। দাঁত ব্যাথা করছে না বাঁথ জমছে? আনফর বাপরা আসছে টুল দে আমি শিঙ্গা আনি। তরা আইছিস বাপ ভালা অইছে। মেলা দিন ভালা কিছু নাড়ে পড়েনা। এই ঈদে একটু গোশতের লাগি বহুজনের কাছে গেলাম। কেউ দেয় নাই। নাতিডা গোশত খাওনের লাগি কাঁদছিলো। পরে ছেলে কোত্থেকে গিয়া খাল, চামড়া নিয়া আইছে। কেউ আয়ও না বাপ বুঝলি। পেটে মরি গেছি রে বাপ। খালি জানডি যাওনের বাকি।’ নাকে বড় নাক ফুল, কানে দুল, গলায় বড় মালা ও হাতে রং বেরংয়ের বড় চুড়ি পড়া ষাটোর্ধ জুলেখা বিবি এভাবেই কথা গুলো বলছিলেন ।

হাওরের বাতাসের সাথে বোকা নদীর পানির ঢেউ খেলা সেই ঢেউয়ের উপর দিয়ে মাঝি গান গেয়ে নৌকা বেয়ে যাওয়ায় দৃশ্য, সাথে জেলেদের মাছ ধরা এসব উপভোগ করতে নদীর উপর থাকা সেতুতে প্রতিদিনই বিকালে হাজির হয়ে থাকেন নানান পেশার মানুষ। এসব দৃশ্য দেখে সবার মুখে ভালো লাগার হাসি ফুটলেও নদীর ঐ তীরে যাযাবরের মত কয়েকটি পরিবার তাদের কাছে নদীর এই সৌন্দর্য্য দেখা অহেতুক আর বিলাসিতা।

সবাই যখন এসব দেখে হাসে আর আনন্দ করে তারা তখন পেটের জ্বালায় হাহাকার করে। করোনা আর লকডাউনের জন্য রুজি রুটিহীন হয়ে জেলার জাউয়াবাজার বোকা নদীর তীরে অবস্থিত ৬টি বেঁদে পরিবারের ঠিক এভাবে দিন যাচ্ছে।

সরেজমিন দেখা যায়, বোকা নদীর তীরে আবর্জনা ছড়ানো ছিঁটানো জায়গায় পলিথিন দিয়ে বানানো ছোট ছোট হুড়া রয়েছে। দূর থেকে মুরগী রাখার ঘর মনে হলেও এখানে পরিবার নিয়ে বাস করছে প্রায় ২০জন মানুষ। আর এসব হুড়ার ভিতরেই রান্না করা, খাওয়া, ঘুমানোসহ চলছে জীবন যাপন।

স্থায়ি বাসিন্দা বা ভোটার না হওয়ায় সরকারি ত্রাণ, অনুদানসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বাহিরে থাকতে হচ্ছে তাদের। ফলে করোনায় এই পরিবারগুলোর মানবেতর জীবনের যেন শেষ নেই। বেঁদে মহিলারা বেশির ভাগ সিঙগা লাগানো, দাঁতের পোঁকা ফালানো এসব করে জীবিকা নির্বাহ করাসহ কিছু মহিলা মেয়েদের চুড়ি, ফিতা বিক্রি করে থাকেন। আর বেঁদে পুরুষরা সাপের খেলা দেখানো ও কড়ি বিক্রি করেন। এভাবেই বেদে পরিবাররা কোনো রকমভাবে জীবন-যাপন করে আসছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে তাদের রোজগার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। মিলছে না কোনো সরকারি ত্রাণ বা অনুদান।

করোনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সুশীলরা অসহায়দের ত্রাণ দিলেও তা জুটেনি এসকল বেঁদে পরিবারের কপালে।

বেঁদে নূর বানু বলেন, আমাগো ছবি তুইল্লা কি হবে, মোরা গেরামে যাইতে পারি না। কোনো কাজ কাম নাই। হাটবাজারে গেলে সবাই খেদাইয়া (তাড়াইয়া) দেয়। বাল বাচ্চা লইয়া এহন কি খামু? করুনার (করোনা) ভয়ে মোগো সব রুটি রুজি বন্ধ। ছবি তুইল্লা নেন ভালা কথা সরকারকে কইয়েন মোগো লইগা কিছু চাউল ডাইল (ত্রাণ) ব্যবস্থা কইরা দিতে।

পরিবারগুলো জানান, বেঁদে তো আর সমাজ বঞ্চিত না। জীবিকার তাগিদে বাপ-দাদার এ পেশায় যুক্ত তারা দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ান খাবারের সন্ধানে। এক সময় জীবন ছিল জলপথে নৌকায় নৌকায়। তাবিজ, ওষুধি গাছ-গাছড়া বিক্রি, সাপের খেলা, শিঙ্গালাগা, পরিমালা করে চলে তাদের সংসার। স্থলপথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের। ওই সব গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় আহার যোগে। তাই তাদের দাবি প্রশাসনসহ সমাজের বিত্তশীলরা যেন তাদের একটু খোঁজ খবর রাখেন।

জাউয়াবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আছাদুর রহমান জানান, বেঁদে সম্প্রাদয় তাদের কর্ম দিয়ে দেশের অনেক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। নির্দিষ্ট ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ায় তারা সরকারি অনুদান, ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত থাকেন। তাই সবার উচিত সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশীলরা তাদের প্রতি এগিয়ে আসা।

এ ব্যাপারে জাউয়াবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুরাদ হোসেন জানান, বিষয়টি আপনার কাছ থেকে জানলাম। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে রাখবো। সরকারি কোন ত্রাণ আসলে আমরা অবশ্যই তাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিব।

জাগরণ/এমআর