ভারতে 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগানকে যেভাবে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার আড়াল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খোলা চিঠি লিখেছেন দেশের ৪৯জন বিশিষ্ট নাগরিক। অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগাল, রামচন্দ্র গুহ, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, অনুরাগ কাশ্যপের মতো ভারতের বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-অ্যাক্টিভিস্ট বা চিত্রনির্মাতা ওই চিঠিতে দাবি জানিয়েছেন লিঞ্চিংকে যাতে একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকারের তরফে এদিন পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে কোনও জবাব দেয়া হয়নি।
তবে বিজেপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন এই শিল্পী-সাহিত্যিকরা বেছে বেছে কেন শুধু কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসেন? ভারতে সম্প্রতি মুসলিম বা দলিত সম্প্রদায়ের লোকজনকে সংঘবদ্ধ মারধর বা গণপিটুনির যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার অনেকগুলোতেই আক্রান্তদের জোর করে 'জয় শ্রীরাম' বলতে বাধ্য করা হয়।
হিন্দু দেবতা শ্রীরামচন্দ্রের জয়ধ্বনি কীভাবে ‘মার্ডার ক্রাই’ বা ‘হত্যাকান্ডের হুঙ্কার’ হয়ে উঠল, তা নিয়ে ভারতেও বহু সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও। এখন ভারতের প্রায় জনাপঞ্চাশেক প্রথম সারির শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী এটা ঠেকানোর জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপ দাবি করলেন।
বলিউডের বর্ষীয়ান পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ - যেমন মুসলিম, দলিত বা সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা - হঠাৎ করেই খুব বেড়ে গেছে। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে এটা একটা অশনি সংকেত, এবং আরও খারাপ ব্যাপার হল এগুলো করা হচ্ছে ভগবান রামচন্দ্রের নামে। এর চেয়ে ঘৃণ্য হেইট ক্রাইম আর কিছুই হতে পারে না, বিশেষ করে যে দেশে শান্তিপূর্ণভাবে সহিষ্ণুতা আর সৌভ্রাতৃত্ব নিয়ে আমরা এতকাল কাটিয়েছি।’
শ্যাম বেনেগালের মতোই ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তার সতীর্থ পরিচালক মণিরত্নম, অনুরাগ কাশ্যপ, আদুর গোপালকৃষ্ণন, গৌতম ঘোষ, কেতন মেহতা বা অঞ্জন দত্তরা। অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি, কৌশিক সেন, পরমব্রত চ্যাটার্জি কিংবা কঙ্কনা সেনশর্মা, রেবতীর মতো অভিনেত্রীদের নামও আছে ওই তালিকায়। আছেন সঙ্গীতশিল্পী শুভা মুদগালও। চিঠির বক্তব্যে সায় দিয়েছেন সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী, লেখক অমিত চৌধুরী, ঐতিহাসিক রাম গুহ, পার্থ চ্যাটার্জি, সুশোভন ও তনিকা সরকার-সহ আরও অনেকে।
চিঠিটি লেখার উদ্যোগে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন অভিনেত্রী ও চিত্রনির্মাতা অপর্ণা সেন। তিনি বলেন, ‘রোজ টেলিভিশনে দেখছি জয় শ্রীরাম বলে মানুষকে মারা হচ্ছে, গরু পাচার করা হচ্ছে বলে লিঞ্চিং চলছে। তো এই সব লিঞ্চিং তো চলতেই থাকবে যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। উনি পার্লামেন্টে এ সব ঘটনার সমালোচনা করেছেন, সে জন্য ওনাকে খুবই ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু শুধু সমালোচনাই তো যথেষ্ঠ নয়, ঘটনাগুলোকে থামাতে হবে। আর থামানোর জন্য এই অপরাধগুলোকে নন-বেইলেবেল (জামিন অযোগ্য) অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। তারপর শাস্তিটাও খুব কঠোর হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এগুলো কেউ করার সাহস না-পায়।
বুদ্ধিজীবীদের এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে এদিন পার্লামেন্টেও ঠিক এই বিষয়টিই উত্থাপন করেছিলেন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ, কিন্তু সরকারের দিক থেকে তার কোনো জবাব আসেনি।
তবে ভারতের শিল্পী-মহলে যারা বিজেপি সমর্থক বা নরেন্দ্র মোদীর অনুগামী বলে পরিচিত তারাও পাল্টা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন এই চিঠির লেখকরা অনেকেই তথাকথিত ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি গ্যাং’ বা অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার চক্রেও ছিলেন - অতএব এদের কথাকে গুরুত্ব না-দিলেও চলবে। এই বিরোধী শিবিরের অন্যতম মুখ চিত্রপরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী।
তিনি বলেছেন, ‘বেরেলি বা মোরাদাবাদের একজন আম আদমি যদি এই চিঠি লিখতেন তাহলে আমায় সেটা ভাবাত। মুশকিল হল এই চিঠিটা যারা লিখেছেন তাদের কখনও রাস্তায় পা পড়ে না। আম আদমি কেমন দেখতে সেটাই তারা জানেন না, ইন্টেলেকচুয়ালিজমের বুদবুদের ভেতরেই তারা বাস করেন। এখন কেউ যদি জোর করে কাউকে দিয়ে জয় শ্রীরাম বলায় বা কেউ যদি মন্দিরে পাথর ছোড়ে সে সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে তো জাতীয় স্তরে বিতর্ক হতে পারে না। আর তারা এত সিলেক্টিভই বা কেন? শিখরা কেন দাঙ্গায় মরেছেন বা কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিতরা কেন ঘরছাড়া তা নিয়ে তো কই তাদের চিঠি লিখতে দেখি না!’
ভারতে এবারের নতুন পার্লামেন্টে মুসলিম সদস্যরা যখনই শপথ নিয়েছেন, বিজেপি এমপি-রা একটানা জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে গিয়েছেন। এই পুরনো স্লোগানটিকে বিজেপি যে এখন নতুন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে তাতে কোনো সংশয় নেই। সেই পটভূমিতে ‘জয় শ্রীরাম’ নিয়ে দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর উদ্বেগ সরকারের কাছে আদৌ কতটা আমল পায় সেটাই দেখার বিষয়।
সূত্র : বিবিসি
এসজেড