রোজা-ঈদে জানা যাচ্ছে না ক্ষতিকর দুধের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ১৫, ২০১৯, ১০:০০ পিএম রোজা-ঈদে জানা যাচ্ছে না ক্ষতিকর দুধের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম

সারাদিন উপোস থেকে রোজা রেখে ইফতারে অনেকেই দুধের তৈরি মুখরোচক খাবার মুখে নেন। আবার কেউ সারাদিন উপোস থাকার আগে সাহ্‌রিতে দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খেয়ে থাকেন। এদিকে রোজার শেষে আসছে ঈদ। সপ্তাহখানেক পরই অনেকে ঈদকে সামনে রেখে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার কেনাকাটা করবেন। এসব দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার কতটা নিরাপদ- এই প্রশ্ন সামনে রেখেই প্রতিবারের মতো এবারও সাধারণ মানুষ এসব খাবার খেয়ে আসছে। কারণ, শংকা থাকলেও সামনে ছিল না কোনো পরিসংখ্যান।

এরইমধ্যে চলতি রমজানেই হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল হয়। এতে বলা হয়েছে, বাজারের তরল দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ওই প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছিল, দুধ ও দইয়ে ভেজাল বা রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা দাখিল করার জন্য। আগে ৯৬ নমুনার বিষয়ে প্রতিবেদন দিলেও কোন কোন কোম্পানির দুধে এসব ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট না করায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নাম আদালতে উপস্থাপন করতে বলে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এর সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানাও দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। আজকের (১৫ মে) মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে এই তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।

তবে আজ এই প্রতিবেদন দাখিল করেনি কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরও এক মাস সময় বাড়িয়ে নিয়েছে আদালত থেকে। যার ফলে চলতি রোজা বা ঈদুল ফিতরের আগে ক্ষতিকর দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার প্রস্তুতকারী এসব প্রতিষ্ঠানের নাম আর জানা যাচ্ছে না।

আদালত আজ আদেশে বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সিসা মেশানো রয়েছে, তা নিরূপণ করে একটি তালিকা তৈরি ও জড়িতদের বিরুদ্ধে গৃহীত আইনি পদক্ষেপ প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে পুনরায় নির্দেশ দিয়েছে।

আদালতের শুনানিতে বিএসটিআইয়ের আইনজীবী বলেন, আমরা দুধ এবং দই বাজারজাতের জন্য অনুমতি দিয়েছি। আমরা এ বিষয়টি তদারকি করি। তবে, পুরোপুরি প্রতিবেদন জমা দিতে সময় দরকার।

আদালত বলেছে, কোন কোন কোম্পানির তরল দুধে ভেজাল ও ক্ষতিকর পদার্থ আছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চাই। এটা এলার্মিং ইস্যু বলেও মন্তব্য করে হাইকোর্ট।

আদালত শুনানির সময় বিএসটিআইয়ের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলে, বিএসটিআইয়ের বিবেকে কি দংশন করে না? কীভাবে ভেজাল দুধগুলো বাজার সয়লাব করছে!

এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইকে ২৩ জুন ওই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) করা গবেষণার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে ল্যাবটির প্রধান অধ্যাপক শাহনিলা ফেরদৌসীকে ২১ মে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।

প্রতিবেদন দাখিলে সময় আবেদনের পর আজ বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।

আদালতে আজ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম। বিএসটিআইয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সরকার এম আর হাসান। দুদকের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হেলেনা বেগম চায়না।

এর আগে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও সিসা দিয়ে দুধ ও দই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম দাখিল করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইকে প্রতিবেদন ও তার ওপর শুনানির জন্য আজ দিন নির্ধারণ রেখেছিল হাইকোর্ট।

তবে এদিন (১৫ মে) প্রতিষ্ঠানগুলোর নামসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চাওয়া হয়। এসময় দুদকের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই জড়িত কোম্পানির নাম না দেয়ায় দুদক কাজ শুরু করতে পারছে না বলে আদালতকে অবহিত করেন।

আদালত শুনানিকালে বলে, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক অনুজীবসহ দুধ-দই উৎপাদনকারীদের শাস্তি পেতে হবে। সাধারণ মানুষকেও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। গবেষণা রিপোর্ট ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করতে হবে।

এরপর ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রধান শাহনিলা ফেরদৌসীকে দুধ ও দইয়ের ওপর করা গবেষণা রিপোর্টটি ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। একইসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই’কে ক্ষতিকারক দুধ ও দইয়ের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নামসহ তাদের গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন ২৩ জুন আদালতে দাখিল করতে আদেশ দেয়।

প্রসঙ্গত, এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘দেশে পুষ্টির অন্যতম প্রধান যোগান হিসেবে বিবেচিত গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যে এবার মিলেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান। ১০ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রতিবেদনে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে।’

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গরুর খোলা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭.৬৬ পর্যন্ত।’ এরপর সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মামুন মাহবুব।

পরে আদালত দুধে সিসা মিশ্রণকারীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যর্থতা কেন বেআইনি হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল আদালত। এ ছাড়াও রুলে দুগ্ধজাত খাবারে ভেজাল প্রতিরোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির (মৃত্যুদণ্ড) কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য পণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সিসা মেশানো রয়েছে, তা নিরূপণ করে একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেয় আদালত। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

এর ধারাবাহিকতায় হাইকোর্টের নির্দেশের পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. মাহবুব কবিরকে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। এরপর ওই কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।

এমএ/ এফসি