কালরাতেই জ্বলে মুক্তির অনির্বান শিখা

রাজারবাগ প্রতিরোধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে পুলিশ বাহিনী

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২০, ০৮:১৪ এএম রাজারবাগ প্রতিরোধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে পুলিশ বাহিনী
রণাঙ্গনে এক দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা- ছবি: এপি

 

বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যদিয়ে আজ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রগতি, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাংলাদেশ। এর মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। তবে বাঙালির অর্জনের তালিকায় আজো শ্রেষ্ঠতম স্থানটি দখল করে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও লাখো বাঙালির অতুলনীয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সার্থকতা।

নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মূলত দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের সূচনা ঘটে বাংলার মাটিতে। আর সে সময় সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসি প্রতিরোধ গড়ার প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থানকারী বাহিনীটির অকুতোভয় বীর যোদ্ধারা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সে রাতে নিশ্চিত মৃত্যুর কথা যেনেও পিছিয়ে যাননি। তাদের সেই দুঃসাহসি প্রতিরোধের বার্তাই স্ফূলিঙ্গের মত বিচ্ছুরিত হয়েছিল সারা বাংলার বুকে, যার তেজোদ্দীপ্ত অনুপ্রেরণায় বীর বাঙালির রক্তে জেগেছিল প্রলয়ের অগ্নিবাণ।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে শহীদ পুলিশ সদস্যদের সেই অনন্য অবদানের খুব অল্পই উঠে এসেছে নতুন প্রজন্মের সামনে। এখনও পরিপূর্ণভাবে নিজেদের প্রাপ্তি বুঝে নিতে পারেননি সেই বীরদের অনেকের উত্তরসূরীরাই। এমনকি গঠিত হয়নি সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও।  যার প্রেক্ষিতে পুলিশের কেন্দ্রীয় পর্যায়সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত পুলিশ প্রশাসনের কার্যালয়সমূহ থেকে তথ্য অনুসন্ধানে, ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস-সহ অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে শহীদ পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা চালায় দৈনিক জাগরণ। 

মূলত এ কাজের উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সেই গৌরবময় আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি দেশবাসীকে পুলিশের এই অনন্য সাধারণ অবদান সম্পর্কে অবগত করা। এ যাবত বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুসারে সন্নিবেশিত শহীদ পুলিশ সদস্যদের নামের একটি তালিকা এই প্রতিবেদনে পিডিএফ ফাইল আকারে দুইখণ্ডে সংযুক্ত করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে মোট ৭৫১ জন পুলিস সদস্য শহীদ হন বলে জানা গেছে।

২৫ মার্চের সে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকায় প্রথম গণহত্যা শুরু করে৷ আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ওই রাতেই প্রথম শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ৷ অর্থাৎ হানাদার শত্রুর বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার তরে- বাঙালির মহান নেতার সেই আদেশ বাস্তবায়নে প্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সদস্যরাই। অপ্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টাব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলে শত্রুর বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে সেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে নির্বিচার  হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। সে রাতে বর্বর দখলদার বাহিনীর তপ্ত বুলেট বুক পেতে নিয়ে জন্মভূমির তরে হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই সাহসী যোদ্ধারা। বাংলার এই বীর সন্তানেরা আজ বাংলার ইতিহাসে, বাঙালির হৃদয়ে চির অমরত্বের কালচিত্র রুপে লালিত রয়েছেন।

নিবন্ধিত সূত্রের তথ্য মতে, এই বীর শহীদ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, শহীদ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ডেপুটি পুলিশ সুপার (ডিএসপি), একজন সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও), ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক ও ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শক রয়েছেন। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন ছয় পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয় বাংলাদেশ পুলিশকে।

এছাড়া রয়েছেন খেতাবপ্রাপ্ত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ, শহীদ আবদুল মান্নান, শহীদ তৌহিদ আলী, মমিন উল্লাহ পাটোয়োরী, কাজী জয়নাল আবেদীন ও মো. সোলায়মান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহুকুমায় এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয় তাকে।

শহীদ আবদুল মান্নান পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙামাটি পুলিশ লাইনে কর্মরত থাকাকালে ২৬ মার্চ যুদ্ধে যোগ দেন। পরে ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে কালুরঘাট যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধরত অবস্থায় রাউজান থানার মদিনাঘাট এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন আবদুল মান্নান। ১৯৯৭ সালে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয় তাকে।

শহীদ তৌহিদ আলী রাজশাহী জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২৩ এপ্রিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অভয়নগর ব্রিজ এলাকায় যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। তাকেও বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী, কাজী জয়নাল আবেদীন ও মো. সোলায়মান বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাক-হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় সারাদেশে ২৪ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন। এর মধ্যে ২২ জন রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে, একজন সিলেট জেলায় এবং একজন রাজশাহীতে শহীদ হন।

সূত্র- এপি

ঢাকা জেলা: কং/৩৫৫৮ আবুল কাশেম, কং/২৩১৪ খলিল মিয়া, কং/৪৩৪০ শেখ আহামদ মিয়া, কং/২৮০৩ নায়েক আলী মিয়া, কং/ ১৫৭৫ বীরেন্দ্র কুমার রড়ুয়া, কং/৫০৬৬ সিরাজুল ইসলাম, কং/ ৫৩৯৯ হাছেন আলী খান, হাবিলদার/১১৫২ জারদাদ খান, কং/১৯৯৭ তোবারক আলী, কং/৪৮২ বিমলেন্দু নাগ, কং/৩২৪৪ আব্দুল আজিজ মিয়া, কং/৫০২৩ আব্দুর রাজ্জাক, কং/৭৬ আবদুস ছালাম, কং/১৩৪ মোফাজ্জল হোসেন, কং/১২১১ হাবিবুর রহমান, কং/১৬২ জাহাঙ্গীর আলম, কং/৯২৭ হাসেম আলী, কং/৯৯৮আ: ছামাদ, কং/২১০৬ মোজাম্মেল হক, কং/২১১৩ তোফায়েল আহমেদ, সিলেট জেলায়: কং/১৩৮৪ সৈয়দ আহমদ এবং রাজশাহী জেলায়: কং/৬৩৯ দয়াবক্স মজুমদার।

এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর যে অতুলোনীয় ভূমিকা তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। যা কিনা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই প্রশাসনিক বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়িয়ে তুলবে বহুগুণ। সেই সঙ্গে দেশ ও জনগণের প্রতি নিবেদিত হতে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হবে পুলিশ। জানা গেছে, পুলিশের তবে ২০১৮ সাল থেকেই পূর্ণ উদ্যোমে সেই বীর পুলিশ সদস্যদের সকল তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য বিষয়গুলো গুছিয়ে আনতে কাজ শুরু করে পুলিশ প্রশাসন। যা অতিশীঘ্রই সম্পন্ন হবে বলেও জানান কর্তৃপক্ষ।