শিল্প-সাহিত্যে ১৫ আগস্ট

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০১৯, ০৫:৫০ পিএম শিল্প-সাহিত্যে ১৫ আগস্ট

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় ঘটনা বিশ্ববাসীকে স্তব্ধ করে দেয়। শিল্পী-সাহিত্যিকরা উদ্বেলিত ও স্তব্ধ হন ঘটনার আকস্মিকতায়। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক চর্চার দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল, তা থমকে দাঁড়ায় পঁচাত্তরের খুনিদের উল্লাসের নিচে। একাত্তরের ষড়যন্ত্রকারী পরাজিত শক্তির চক্রান্ত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশকে নিয়ে যায় সন্ত্রাসের করতলে, স্বৈরশাসকের হাতের মুঠোর ভেতরে। বন্ধ হয়ে যায় মুক্তবুদ্ধির শিল্পচর্চা। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর ভীতসন্ত্রস্ত খুনিরা রাষ্ট্রপতির জনপ্রিয়তাকে মুছে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় কবরস্থ করে। ৩২ নম্বর থেকে জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় তাকে পাঠানো হলো ঠিকই, কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরো বেশি প্রেরণার উেস পরিণত হয়ে উঠলেন। ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুই প্রকাশিত হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, রেখা-ভাষা-ছন্দে-সুরে। দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে মুজিবের আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত আছে তাকে কেন্দ্র করে অন্য ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের রচনায়।

বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে কেন্দ্র করে গান লেখা হয়েছে, রাজনৈতিক পোস্টারে মুদ্রিত তার প্রতিকৃতি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। একাত্তরে গণসংগীতের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি। ১৫ আগস্টের পর চিত্রকলার অজস্র তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো আর মুখাবয়বের পেলবতা। ডাকটিকিট আর ম্যুরাল-ভাস্কর্যে তার উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। ছোটোগল্পের বিষয়বস্তুতে সচেতনভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। শাহাদাত বরণের পর গল্পের উপাদান হিসেবে কেবল পটভূমি নয়; ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানবিকতার উন্মোচনে কল্পনার রঙে রাঙানো হয়েছে তাকে।

‘আগস্টের একরাত’ উপন্যাসের রচয়িতা সেলিনা হোসেন একটি যুগের সমগ্র ইতিহাস পরিবেশন ও পর্যালোচনা করতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর শক্তিমান, তীক্ষধী, কূটনৈতিক ও সাহসী ভূমিকা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে তার বিরোধ ও জাতির জীবনে মুক্তি-অন্বেষী মুজিবকে ঐতিহাসিক করে তুলেছেন তিনি। ঐতিহাসিক বিষয়ের সঙ্গে কাল্পনিক প্রেমকাহিনি বুনে দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক তার ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’ উপন্যাসে। ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন। তাদের উপস্থাপনে ঐতিহাসিকতা বজায় রেখেছেন মোস্তফা কামাল, মহিবুল আলম, শামস সাইদ, সমীর আহমেদ, হুমায়ূন মালিক, আবদুল মান্নান সরকার প্রমুখ।

মানব-মানবতা ও মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিককে উত্সাহী করেছেন স্বাভাবিকভাবে। কারণ মানবমুক্তির গান কবি-সাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন। এজন্য মহামানবের মাঝে প্রেরণা অন্বেষণ করে জাতি ও জনতাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে কবিতা ও ছড়ায় বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের মাধ্যমে। শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার আগেই তাকে নিয়ে কবিতা লেখা শুরু হয়। নির্মলেন্দু গুণ ও জসীমউদ্দীন ষাট-সত্তরের দশকে তাকে কাব্যের ভেতর দিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পরস্ফুিট করেছেন। ষাট ও সত্তরের দশক ধরে বিশ্বব্যাপী মুক্তিপাগল মানুষের তেজোদীপ্ত প্রতীক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দেশের বৈরী পরিবেশে কবিরা স্মরণ করেছেন তাকে। পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক পট পালটে গেলেও মুজিবের অনুপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মেনে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিরা। কবি বলেছেন, ‘বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’

 লেখক :অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়