ঘাত-প্রতিঘাত

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২১, ০৭:৪৮ পিএম ঘাত-প্রতিঘাত

বিশ্বস্তসূত্রে খবর আছে, প্রবীর রঞ্জনকে আজ অবধি একজনই ভালোবেসেছিলেন–স্ত্রী পৃথা। তবে বেশ কয়েক বছর হলো তিনি পূর্ণব্রহ্মপ্রাপ্ত হয়েছেন।
প্রবীর রঞ্জন মূলত বিষয়ী লোক– হিসেবটা ভালো বোঝেন। প্রাইভেট কনসার্নে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে রোজগার বাড়ানোর জন্য শেয়ারমার্কেট খেলতেন। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, শেয়ার কেনাবেচা করে মোটের ওপর তার লাভই হয়েছে। ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রী বলতেই পারেন, “সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে!” কিন্তু প্রবীর রঞ্জন বোকা নন এবং স্বাভাবিকভাবেই বুঝেছিলেন ত্রেতা যুগের সংজ্ঞা কলিতে অচল। ফলত ছাত্রজীবনে অঙ্কের পাকা মাথা তিনি কর্মজীবনে এসে মোক্ষের পেছনে ক্ষয় করেননি, অর্থের সন্ধান করেছিলেন।
রাশভারী হতে গেলে যে তত্ত্বজ্ঞানী হতেই হবে, এমন এক বহুল সমর্থক ভাবধারাকেও প্রবীর রঞ্জন ভুল প্রমাণ করেছিলেন। পাড়ার ছেলেরা শীতলা পুজোর চাঁদা চাইতে এসে আমতা আমতা করলেও তিনি কথা না বাড়িয়ে একশ এক টাকা চাঁদা দেন।
তিনি কিপটেও নন। হলে মধ্য কলকাতায় অমন দোতলা বাড়ি হাঁকাতে পারতেন না।
দোষের মধ্যে তিনি একজন বাড়াবাড়ি রকমের একগুঁয়ে প্রকৃতির লোক। আর এখানটাতেই পুত্র প্রতীনের সঙ্গে তার বিরোধ। সে বিরোধ তেমনভাবে কখনোও প্রকাশ্যে না এলেও ওই দোতলা বাড়ির দুই বাসিন্দার মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভের আঁচ জেগেই থাকে। ফলত, সিপাইয়ের ঘোড়া হওয়া দূরে থাক, প্রতীন কখনো সচেতনভাবে বাপের ব্যাটা হওয়ারও চেষ্টা করেনি। সে শিক্ষিত, রুচিবান, সংবেদনশীল, কিন্তু দৃঢ়চেতা।
প্রতীন জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পূর্ব লগ্নে পৃথা মারা যান। সেদিন থেকে শুরু করে আজ তিরিশ বছরের প্রতীনে প্রতীনকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবীর রঞ্জনের শুধু অর্থ জোগান ছাড়া আর কোনো অবদান নেই–থাকলেও প্রতীন সেটা খুঁজে পায়নি।
সে তার মায়ের ছাঁচে ঢালা। এখনো পৃথার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করে, “এ লোকটাকে কী দেখে পছন্দ করেছিলে মা?”
থেকে থেকে তার মনে পড়ে যায় সেই দুপুরবেলার কথা। মাকে ঘরে শোয়ান। নিথর। প্রবীর রঞ্জন পাড়ার ডাক্তার ধরে ডেথ সার্টিফিকেটও বের করে নিয়েছেন। মাসিরা এসে গেছে। মামাদের আসতে একটু দেরি। এমন সময় প্রতীনের ঘরে ঢুকে চাপা গলায় তিনি বলেছিলেন, “তোদের সব এসে-টেসে গেলে যাবার আগে ডাকিস।”
মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর প্রতীন আবিষ্কার করেছিল প্রবীর রঞ্জন তার ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। যার স্ত্রী মারা গেছেন একটু আগে, তিনি দিনদুপুরে শ্মশানে যাওয়ার আগে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। প্রতীন ভেবেছিল, “প্রাণে কি বিন্দুমাত্র...”
মা-ন্যাওটা ছেলের সঙ্গে বাপের যে দূরত্ব শুরু থেকেই ছিল, সেটা যে এ ঘটনার পর থেকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, তা বোধহয় আর বিস্তারে বলবার প্রয়োজন নেই।
প্রবীর রঞ্জনের আদর্শে ঋতুরাজ কোনোকালেই বিশেষ খাজনা পাননি। ঠিক তেমনই, প্রতীনের জীবনযাত্রাতেও চৈত্রে কুড়িয়ে পাওয়া সর্বনাশের কোনো আরক মেশানো ছিল না। কন্দর্প বসন্ত দিয়ে নয়, বর্ষা দিয়ে ঘায়েল করলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল আজকের দিনেই–পাক্কা এক বছর আগে। বিশ্বস্তসূত্রে খবর আছে, সেই সময় প্রজাপতি মৃদু করে হেসেছিলেন।
অফিসের বাসস্ট্যান্ডে প্রতীনের সঙ্গে নয়নিকার প্রথম দেখা হয়েছিল। সেদিনও আজকের মতোই বৃষ্টি হচ্ছিল–এবং বৃষ্টিটা হঠাৎই নেমেছিল। বাসস্ট্যান্ডের কোনো শেড ছিল না। আশপাশের দোকানগুলো কী বেশ একটা কারণে বন্ধ ছিল, আর ধারেকাছে তেমন কোনো বাড়িও ছিল না যার বারান্দার তলায় গিয়ে একটু দাঁড়ানো যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ছাতা কোথায় ছিল? উত্তর হলো–ছাতা প্রতীনের মাথায় ছিল আর নয়নিকার হাতে ছিল। কিন্তু অন্তরীক্ষের ষড়যন্ত্রে তার হুকটা এমনই জ্যাম হয়েছিল যে বিস্তর টানাটানির পরও সেটা না খোলায় মেয়েটি বুঝেছিল–ভেজা ছাড়া গতি নেই। প্রতীনই প্রথম তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ছাতাটা বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, “যদি কিছু মনে না করেন...”
প্রতীনের ছাতার তলায় নয়নিকা সেদিন ‘কিছু মনে না করে’ই এসে দাঁড়িয়েছিল। বাকি প্রায় নির্জন সে বাসস্টপে অর্ধেক অর্ধেক ভেজার বিবরণে যাওয়া নিষ্প্রয়োজন।
না, প্রতীনের মনে তখনো এ বারিধারার কোনো ঝাপটা এসে লাগেনি। তাই দুজনেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল। প্রজাপতি শেল হানলেন মিনিট তিনেক পর।
দূরে একটা বাস আসতে দেখে নয়নিকা বলেছিল, “আমার বাস এসে গেছে।” ও গলার আওয়াজে প্রতীন প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল। পাশে দাঁড়ানো নয়নিকার দিকে চাইতে সে বলেছিল, “আসি, ধন্যবাদ!” তারপর বাসে উঠে গিয়েছিল। আর প্রতীন আবিষ্কার করেছিল–মেয়েটার চোখ দুটো টানা টানা–ঠাকুর ঠাকুর!
এখন, এমন এক পরিবেশে এমনতর নারী সংস্পর্শ জীবনে এই প্রথম বলেই প্রতীনের ‘মনে হওয়া’ শুরু হলো কি না, বিশ্বস্তসূত্রে তার কোনো খবর পাওয়া যায় না।
সেই শুরু। আজ ঠিক এক বছর হল প্রতীন আর নয়নিকার ভালো লাগা ভালোবাসা ছাপিয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে উত্তপ্ত প্রতীন ঠিক করেছে –ব্যস, বাড়ি তথা প্রবীর রঞ্জনকে ছেড়ে বেরিয়ে আসার এই-ই প্রশস্ত সময়।
পৃথা কোনো এক দিন প্রতীনকে বলেছিলেন, “আমার যদি কখনো কিছু হয়ে যায়, বাপিকে দেখিস কিন্তু।”
না, প্রতীনের বিন্দুমাত্র সে ইচ্ছা নেই। যার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে প্রতিটা ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য, আর যিনি চিরকাল কেবল চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করে এসেছেন–তাকে ‘দেখে রাখবার’ বিন্দুমাত্র তাগিদ প্রতীন অনুভব করে না।
কিন্তু বেরোনোরও তো একটা কারণ থাকা চাই। সেটা আছে– নয়নিকাই প্রতীনের মুক্তি। একজন অকারণে ডিকটেট করা বাপ যে ফস করে ছেলের পছন্দ করা মেয়ে মেনে নেবেন না, এটা প্রতীন ভালোই বুঝতে পেরেছিল।
ফলত...
দুর্জনে বলে, প্রবীর রঞ্জন যদি জানতে পারেন যে প্রতীন গণসংগীত পছন্দ করে, তিনি ইচ্ছে করে পান্নালালের শ্যামাসংগীত বাজাবেন। অকারণে প্রতীনের দিকে ঠারেঠোরে “কী যে হচ্ছে...” গোত্রীয় শব্দ ছুড়ে দেবেন আর “নিয়তি-নিয়তি” মার্কা শখের বিলাপ করে জগৎ সংসারকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন, “আজকালকার ছেলেছোকরারা...”!
আসলে প্রস্তর যুগ থেকেই দুই শ্রেণির লোক চিরকালই পৃথিবীতে সহাবস্থান বজায় রেখে চলেছে। এক দল বঙ্কিমী ভাষ্যকেই ধ্রুব মনে করে, তো আর এক গোষ্ঠী নজরুল পড়ে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠবার চেষ্টা করে।

*
দোতলার ওই কোণের ঘরটা প্রবীর রঞ্জনের, আর এ কোণের ঘরটা প্রতীনের। প্রতীন ঘরে বসে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, রোজকার মতোই প্রবীর রঞ্জন তার শেয়ারবাজারসংক্রান্ত কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে আছেন।
...আজ আবার কী সব জানি লিখছেনও।
ইদানীং অর্থশাস্ত্র নিয়ে প্রবীর রঞ্জন একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চাকরিতে থাকাকালীন সেভাবে ‘বাজার’ ধরতে না পারলেও, এখন বছর দুই হল তিনি ঝাড়া হাত-পা। রিটায়ার করে নিজেকে সম্পূর্ণ শেয়ারে ডুবিয়ে দিয়েছেন–প্রতি সন্ধেয় নিয়ম করে কাগজপত্র নিয়ে বসেন। আজও সেই এক পরিস্থিতি–দরজার দিকে পেছন ফিরে, সামনের ডেস্কে গুচ্ছের ফাইল নিয়ে রুলটানা ফুলস্কেপ কাগজের তাড়ার ওপর ঈষৎ ঝুঁকে প্রবীর রঞ্জন লিখছেন–প্রতীন তার ঘর থেকে পর্দার আড়াল দিয়ে দেখতে পাচ্ছে।
পুত্রকে তার ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং পেরিয়ে তবে পিতার ঘরে পৌঁছতে হবে। কিন্তু এই মাঝের কয়েক মিটারের যা বন্ধুরতা, তা শুধু পুত্রই জানে।
কথায় বলে দুর্বলের ঘুম সবলের ঘাম। এই মুহূর্তে প্রতীন মানসিক বলে বলীয়ান হয়ে উঠে ঘামছে কি না, তা বোঝা না গেলেও, সে যে সন্ধের চিত্রনাট্য মনে মনে আওড়াচ্ছে–সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
প্রতীন ভাবল স্বেদবিন্দু অপনোদনের মধ্যে দিয়ে যে প্রেমের শুরু, তার পরিণতিতে ঘাম ঝরবে না–তা হয় না! তার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। সেদিনও বাসস্টপেই দেখা। প্রতীনের তখন চোখ ফুটেছে। সেই ছত্রকাণ্ডের পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। তখন প্রতীন অফিসফেরতা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াত বাস ধরার এবং ছাড়ার জন্য।
এমনই কিছু ধরা-ছাড়ার মধ্যে বেশ কয়েকবার নয়নিকা ধরা দিয়েছে। কিছু “ভালো আছেন” গোত্রের কুশল বিনিময়ও হয়েছে– এবং এটুকুর ফলেই প্রতীন হঠাৎ করে ঘাড়ে বেশি করে পাউডার মাখা শুরু করেছিল।
প্রজাপতি তাকে ঘামিয়ে ছেড়েছিলেন এর বেশ কিছুদিন পরে। সেই এক বাসস্ট্যান্ড। তত দিনে আধো আলো আধো ছায়া কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। সেদিনও নয়নিকার বাস আগেই এসেছিল। কিন্তু চুলে ক্লিপটা ভালোভাবে আটকানোর জন্য সে প্রতীনকে যে প্লাস্টিকের ব্যাগটা ধরতে দিয়েছিল, সেটা না নিয়েই বাসে উঠে পড়ে।
পরবর্তী দৃশ্য–বাস ছুটছে, প্রতীন হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে তার পেছন পেছন ছুটছে। কন্ডাক্টর কন্দর্পের মতিগতি বিশেষ বোঝেনি। ফলে বাস নেক্সট স্টপেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নয়নিকা ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি নেমে উল্টোপথে জোর কদমে হাঁটা লাগিয়েছিল। শেষে দুই স্টপেজের মাঝে ফের চারিচক্ষুতে মিলন। নয়নিকা বলেছিল, “ছি ছি! দেখুন দিকি...”
প্রতীন হেসে ফেলেছিল। ঘেমে গেছিল।
শব্দবিনিময় এদের দুজনের মধ্যে তখনোও খুব বেশি হয়নি। নয়নিকা রাস্তার পাশের একটি কফি শপ দেখে প্রতীনকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তাড়া আছে?”

*
সাধারণত প্রণয়ঘটিত বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়েদের তরফ থেকেই অসুবিধেটা বেশি দেখা যায়। মেয়ের বাপ-মা হলেই পাত্র হিসেবে হয় সরকারি অফিসের কর্মচারী (সে করপোরেশনের ধাঙর হলেও হবে) না হলে বিল গেটস (দেশি মুকেশ অম্বানিতে চলবে না কিন্তু)-এর বাইরে মোটে অ্যালাউ করেন না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। যেহেতু প্রবীর রঞ্জন কখনো কারোর কথা শোনবারই চেষ্টা করেননি, সেহেতু ছেলের পছন্দ একবাক্যে যে মেনে নেবেন না–এ কথা আন্দাজ করা মোটের ওপর সোজাই।
তবু প্রতীন গত মাসদুয়েক ধরে প্রেমের উত্তাপে দগ্ধ হয়ে তথা পিতার সঙ্গে মহারণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আজ বলবে বলে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ, “আমি নয়নিকাকে বিয়ে করতে চাই।”
না, এ কথা শুনে প্রবীর রঞ্জনের আকাশ থেকে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বিন্দুমাত্র সংবেদনশীল যদি হতেন, তাহলে যেদিন প্রতীন প্রথম নয়নিকাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে সেদিনই তার ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার কথা।
মাস ছয়েক আগেকার ঘটনা। এমনিতে প্রতীনের বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই। তবে শ্যামল বা শান্তনু মাঝেমধ্যে আসেটাসে। সেখানে ফস করে একজন পূর্ণাঙ্গ সুন্দরী যুবতীকে বাড়িতে এনে সে বাপকে কী বলবে, সেটা ভাবতেই সপ্তাহ দুয়েক সময় কেটে গেছিল। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর হয়ে দেখা দিয়েছিল। বাপ-প্রেমিকা বলছিল কথা, প্রতীন ছিল নিরুত্তর।
যথারীতি সেদিন প্রবীর রঞ্জন নয়নিকাকে দেখে অসন্তোষ ফুটিয়ে গাম্ভীর্যের ওপর আরও কিছুটা গাম্ভীর্য চাপিয়ে অকারণে পরিবেশ গুরুগম্ভীর করে তুলেছিলেন। সে আলাপে সাধারণ কুশল বিনিময় থাকলেও “এসো ভাই, বসো ভাই” গোত্রীয় কোনো মনোভাব তার ছিল না।
নয়নিকা তাকে প্রণাম করায় নিয়মমতো আশীর্বাদও করেছিলেন। খুব অল্প সময়ই কথা হয়েছিল তাদের, এবং তা-ও খুবই সাধারণ কথাবার্তা। কোথায় চাকরি কর, কী কাজ কর, কোথায় থাক, বাড়িতে কে কে আছেন, বাবার নাম কী, কী করেন...ইত্যাদি।
আলাপটা যে খুব একটা সহৃদয় গোত্রীয় ছিল না, সেটা নয়নিকা বেশ বুঝতে পেরেছিল। ফেরার সময় প্রতীন যখন তাকে বাসে তুলে দিতে আসে, তখন সে তাকে বলেছিল, “তোমার বাবা বোধ হয় আমায় খুব একটা পছন্দ করেননি।”
যুদ্ধের আভাস প্রতীন সেদিনই পেয়ে গেছিল। সে রাত্রে ঘুম হয়নি তার। প্রবীর রঞ্জনের শীতল আচরণের প্রত্যুত্তর দিতে গেলে যে পৌরুষ থাকতে হয়, তা ক্রমান্বয়ে অর্জন করবার চেষ্টা শুরু করেছিল।
কথায় বলে, প্রেম নাকি মানুষকে বোকা করে তোলে। পরদিন সন্ধেয় কোনো এক পার্কে বসে “আমি তোমার সঙ্গে আছি” এবং “বাবা না মানলেও কিছুতে আটকাবে না”– এ ধরনের একঘেয়ে বস্তা পচা তথা আশ্বাসমূলক কিছু বাক্যাংশ উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রতীন শুরু করেছিল এই বলে– “তোমাকে একটা চুমু খাব?”
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, প্রতীন সেদিন নয়নিকাকে চুমু খেয়েওছিল। তবে সে চুম্বনসম্পৃক্ত উত্তাপে উত্তপ্ত প্রতীন প্রবীর রঞ্জনের শীতলতার সম্মুখীন হতে পারবে কি না, তা তখনো বোঝা যায়নি।

*
প্রতীন আরো কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল ভেবে শেষে উঠে পড়ল। নিজের ঘরের দরজা অবধি এগোল, তারপর দেয়ালে সাটানো আয়নার দিকে চোখ পড়তে তাতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখখানা একটু ফ্যাকাশে লাগছে।
কোনো এক শীতের সন্ধেয় ঠান্ডায় জবুথবু প্রতীনকে দেখে নয়নিকা হেসে বলেছিল, “এত শীতকাতুরে! একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছ...”
প্রতীন তত দিনে সাবালক হয়ে উঠেছে। একটু হেসে বলেছিল, “ভাবছি একটু তোমার গা ঘেঁষে চলি। যদি কিছুটা উষ্ণতা...”
প্রেম জিনিসটা খুব একটা খারাপ নয়, এবং এক বছর প্রেম করেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়–শাস্ত্রে তেমন কিছু লেখাও নেই। উপরন্তু তিরিশ বছর বয়সটাই যে বিয়ের পক্ষে আদর্শ–মাস চারেক আগে পর্যন্ত প্রতীন এমন কথাও মনে করত না।
গন্ডগোলটা পাকালেন বনবিহারীবাবু। প্রবীর রঞ্জনের কলিগ ছিলেন। যে কজন লোকের সঙ্গে তিনি মিশতেন, বনবিহারী ঘোষাল তাদের মধ্যে একজন। সমস্যা সেখানেও নয়। মুশকিল হল তখন–যখন প্রতীন দেখল–বনবিহারী জেঠু ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসা শুরু করেছেন। সেই জেঠুর আবার একটি কন্যারত্ন আছে। সে-ও দুদিন এলো। প্রতীন অবাক হয়ে লক্ষ করল, প্রবীর রঞ্জন ঠিক যেমনটি নয়নিকার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন, ততটা শীতলতা বা গাম্ভীর্য নিয়ে এর সঙ্গে কথা বলছেন না। বরং অকারণে উৎসাহী শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করছেন– “তারপর, এই চাকরিটাই কন্টিনিউ করবে, নাকি বেটার কিছু...”
বনবিহারীবাবু সঙ্গে লেজুড় জুড়ছেন, “হেঁ হেঁ, শুধু চাকরি করলেই তো হবে না। এবার থিতু হওয়ার চেষ্টা করতে হবে...বুঝলেন না!”
এহ বাহ্য! একদিন এমনই এক সন্ধেয় প্রবীর রঞ্জন প্রতীনকে তার ঘর থেকে ডেকে খানিকটা অযাচিতভাবেই বলে বসলেন, “এই হচ্ছে নীলা। ও তোর ছবি-টবিগুলো একটু দেখতে চায়। তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে ওগুলো দেখাও।”
তা-ও না হয় মানা গেল। কিন্তু প্রবীর রঞ্জনের কথার পিঠে বনবিহারীবাবু যা বললেন, সেটা শুনে প্রতীনের মনে কু-ডাকটি বেশ জোরের সঙ্গে বেজে উঠেছিল। পিতার বন্ধুসম কলিগ সেদিন বলেছিলেন, “সেই ভালো, বুড়োদের মাঝে বসে না থেকে ওরা না হয় নিজেরাই কথাটথা বলে নিক। আমরা আর কদিন...”
এই ঘটনার পরদিনই এক পড়ন্ত বিকেলে ময়দানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রতীন নয়নিকাকে বিড়বিড় করে বলে ফেলেছিল, “আর বোধ হয় দেরি করা ঠিক হবে না।”

*
প্রবীর রঞ্জন বিড়বিড়ানি বা ফিসফিসানি পছন্দ করেন না। তিনি স্পষ্টবক্তা এবং স্পষ্টই শুনতে পছন্দ করেন। প্রতীন তাই গলাটা একটু ঝালিয়ে নিল। অনেকটা কমল মিত্র-উত্তম কুমার গোছের চিত্রনাট্য হতে চলেছে। প্রবীর রঞ্জন বলবেন, “পাখা গজিয়েছে? লায়েক হয়ে গেছ?” প্রতীন আয়নাটার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে জবাব করল, “তিরিশেও গজাবে না তো কি ছাপ্পান্নয় গজাবে?”
একটা নাইট ল্যাম্পের আলোয় ড্রয়িংরুমজুড়ে এক মায়াবী পরিবেশ। এ আলো-অন্ধকার পার করে প্রতীনের এই যুদ্ধাভিযান। ফ্ল্যাটজুড়ে এক চুপি চুপি আবেশে সময়ও থমকে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে সেই একঘেয়ে বৃষ্টিটা পড়ে চলেছে।
এমনিতে প্রবীর রঞ্জন হয়ত অতটাও খারাপ নয়–তবে অকারণে লোকের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাটাকেই প্রতীন মানতে পারে না। যত দিন নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি, তদ্দিন মেনেছে। তারপর থেকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছে–তুমি ডাঁয়ে বললে আমি বাঁয়ে যাব।
কী হুলস্থুল কাণ্ড! যখন প্রতীন বলেছিল ছবি আঁকা নিয়ে হায়ার স্টাডি করবে। “ও আবার কেউ করে নাকি”, “ওতে ভবিষ্যৎ কী”, “জেনারেল লাইনে পড়” এবং “সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দাও” – এমনতর টিপিক্যাল কিছু কথা বেশ জোরের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন তিনি। প্রতীন সেদিন সে কথাগুলো মানেনি বলেই আজ সে এক বিখ্যাত পত্রিকার ইলাস্ট্রেটর এবং নিজের ছবি নিয়ে বেশ কয়েকটা একজিবিশনও করে ফেলেছে।
প্রতীন তার মায়ের মতো হয়েছে। মা ছবি আঁকতে পারত খুব সুন্দর। আর নজরুলগীতি গাইত। কী মিষ্টি গলা ছিল মায়ের।
তবে অবাক করা ব্যাপার! প্রতীন কিন্তু কোনোদিন তার বাপ-মায়ের মধ্যে কোনোরকম কোন্দল গোত্রীয় কিছু দেখেনি। সেই ছোটবেলায় যখন সবার বাড়িতে কালার টিভি কেনা হচ্ছে, পৃথা প্রতীনকে বলেছিলেন, “বাপিকে বলব আমাদের জন্যও টিভি কিনে আনতে।” প্রতীন উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, “বাপিকে রিমোটওয়ালা টিভি কিনতে বলবে মা। যেমন বিল্টুর বাবা কিনে এনেছে...”
সেই সন্ধেই কোনো এক অমোঘ কারণে দেখা গেল, প্রবীর রঞ্জন আপিস থেকে ফেরার পথে ট্যাক্সি করে নতুন টিভি নিয়ে ফিরছেন। কিন্তু কোথায় রিমোট! টিভি দেখে প্রতীনের মুখ গোমড়া হয়ে গেছিল। সেটা বুঝতে পেরে পৃথা প্রবীর রঞ্জনকে বলেছিলেন, “একবার বলবে তো যে আজ টিভি কিনতে যাবে...”
কেন?
খোকা বলছিল রিমোটওয়ালা টিভি...
রিমোট? কিসের রিমোট? টিভি দেখবে না রিমোট দেখবে?
পৃথা শুনে হেসে ফেলেছিল। চায়ের জল বসাতে বসাতে বলেছিল, “সত্যি, তোমায় নিয়ে আর পারলাম না...”
প্রতীনের হঠাৎই মায়ের কথা মনে অড়ে যায়। আজ মা থাকলে...
“যন্ত্রণা!” সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একটু জল খাওয়া প্রয়োজন। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। মেজাজটাও আস্তে আস্তে খিচরে যাচ্ছে। তা, প্রতীন জল খেল। ফের এগোল, প্রবীর রঞ্জনের ঘরের দরজা অবধি পৌঁছল। তারপর যথারীতি, ফের দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় অসহায় লাগছে নিজেকে, বড় ক্লান্ত। কাঁহাতক আর প্রতি ব্যাপার নিয়ে দ্বন্দ্ব করা চলে!
নয়নিকা–কী করছে সে এখন? সে কি জানে কতটা অস্বস্তির মধ্যে প্রতীন পড়ে আছে? কতটা ক্লান্ত হয়ে আছে!
ক্লান্ত...ক্লান্ত প্রতীন সেদিনও ছিল। অফিসে প্রমোশনের ঝক্কি। প্রথম কদিন কাজ অতিরিক্ত দায়িত্ব বুঝে নিতে একটু বেশিক্ষণ ধরেই মাথা খাটাতে হয়েছিল, যার ছাপ এসে পড়ে তার মুখেচোখে–যা দেখে নয়নিকা সেই সন্ধেয় বলেছিল, “টায়ার্ড?”
এই আর কী!
কী?
...
বলবে না?
“তেমন কিছু না,” প্রতীন হেসে বলেছিল, “অফিসের লোডটা একটু...”
চা খাবে?
চল।
এখানে নয়।
তবে?
চল আমার সঙ্গে।
নয়নিকা প্রতীনকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেছিল। আর প্রতীন বাড়িতে ঢুকে জানতে পেরেছিল, সেই সন্ধেয় নয়নিকার বাবা-মা তাদের কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছে।
প্রতীনকে বসবার ঘরে বসিয়ে নয়নিকা জামাকাপড় পাল্টে চা করতে গেছিল। প্রতীন সোফার পেছনে মাথাটা এলিয়ে চোখ বুঝে বসেছিল।
কিছুক্ষণ পর নয়নিকা চা নিয়ে এসেছিল। এসে প্রতীনের সামনেটায় দাঁড়িয়েছিল, “চা...”
প্রতীন দেখেছিল নয়নিকাকে। তার সামনে, খুব সামনে। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিয়েছিল...

*
তারপর একদিন প্রতীন ফোন পেল নীলার, “প্রতীন বলছেন?”
বলছি।
আমি নীলা।
নীলা? ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। বলুন।
ব্যস্ত?
না, তেমন কিছু নয়। বলুন।
আমারও তেমন কিছু নয়। তাই, ভাবলাম আপনাকে একটু বিরক্ত করি।
প্রতীন প্রত্যুত্তরে হেসেছিল। নীলা বলেছিল, “বিরক্ত হচ্ছেন তো?”
নাহ্‌!
সে কী! আমার তো মনে হয়–আমার সঙ্গে দেখা হলেই আপনি বিরক্ত হন।
ছি ছি, এ কী বলছেন!
হন না?
প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে কথা বলেন না কেন?
কথা বলি না? মানে?
মানে, সেদিন যে আপনাকে আমার নাম্বারটা দিয়ে এলাম–তারপরে একবারের জন্য হলেও ফোন করলেন না কেন?
ওহ্‌!
কী?
না মানে...
মানে কী?
প্রতীন অপ্রস্তুত, “আসলে ঠিক মনে ছিল না।”
“আমি কিন্তু আপনাকে ভুলিনি”–এটুকু বলে নীলা ফোন রেখে দিয়েছিল।
সে সন্ধেয় প্রতীন এই শেষ বাক্যটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবেছিল।
খটকাটা জোরদার হয়েছিল রাতে খাবার টেবিলে। প্রবীর রঞ্জন পুঁইচচ্চরি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলেছিলেন, “ইদানীং দেখছি, তোমার অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরি হয়। কাজের কী খুব চাপ চলছে?”
প্রতীন সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিতে পারেনি। একটু পর বলেছিল, “প্রমোশনটার পর একটু বেশিই দায়িত্ব...”
সেই। ঠোঁটে লাল রঙের ছোপ দেখে বেশ বুঝতে পারি, প্রমোশনের কতটা চাপ!
প্রতীন শুনে থম মেরে গেছিল। এটা কী বললেন প্রবীর রঞ্জন?
ফের কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ। তারপর এক সময় প্রবীর রঞ্জন বললেন, “ভাল কথা, এ রোববার কি তোমার অন্য কোনো কাজ আছে?”
না।
তাহলে সন্ধেয় আমার সঙ্গে বনবিহারীবাবুর বাড়িতে চল। ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে নিমন্ত্রণ করে গেছেন।
প্রতীনের কাঁটা বাছা নিমেষে বন্ধ হয়ে গেছিল, “কেন?”
এমনিই...
লোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার ব্যাপারে প্রবীর রঞ্জন কোনোকালেই খুব একটা সড়গড় ছিলেন বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে হঠাৎ করে রোববার বনবিহারী বাবুর বাড়ি...
পরিস্থিতি কি পাকিয়ে উঠছে? কিন্তু প্রতীনের পক্ষে তো নয়নিকাকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবাই সম্ভব নয়।
সে রাত্রে প্রতীনের বেশ কিছুটা রাগই এসেছিল। এ কেমনধারা জিনিস হয়ে চলেছে? তার কি ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছুই নেই? যা প্রবীর রঞ্জন ঠিক করে দেবেন, সেটাই তাকে মুখ বুজে মেনে নিতে হবে?
পরদিন অফিসফেরতা নয়নিকার সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে মানসিক উদ্বেগটা ঠিক চেপে রাখতে পারেনি। নয়নিকা বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিল, “কিছু হয়েছে?”
নাহ্‌!
লুকোচ্ছ?
আরে না না!
তবে বল।
নানান কথা বলে, এটা সেটা টেনে এনে একসময় প্রতীন বলে বসেছিল, “বাবা...”
নয়নিকা কিছুক্ষণ প্রতীনের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে একটু হেসেছিল, “তাতে কী? সেক্ষেত্রে বিয়ে করবে না আমায়।”
প্রতীনের আরও রাগ হয়েছিল, “মানে?”
নয়নিকা আর কোনো উত্তর দেয়নি। প্রতীন বলেছিল, “এটা বলতে পারলে?”

*
এই বলাবলিরই আজ ক্লাইম্যাক্স! যা হবে হয়ে যাক। ধীর পায়ে এগোচ্ছে প্রতীন। সিদ্ধান্ত শোনাতে চলেছে।
প্রতীন পিতার ঘরে ঢুকে আসে। প্রবীর রঞ্জন এখনও লেখায় নিমগ্ন। সাবলীল দক্ষতায় হিসেব করে চলেছেন কোনটা বাড়বে আর কোনটা কমবে। প্রতীন ভাবে–এতটা অনায়াস যদি আমার সঙ্গে হতে পারতে...
তার অসাড় পদক্ষেপ কোনো এক অমোঘ নিয়মে যেন আকৃষ্ট হচ্ছে ওই মানুষটির দিকে। এক প্রাচীরের দিকে।
প্রতীনের সামনের দেওয়ালে চোখ পড়ে। মায়ের ছবি। মা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রতীন ‘বাপি’ বলে ডাকতে যায়...
কিন্তু সে ডাক বেরোবার আগেই সামনে উলটো মুখ করে বসে থাকা প্রবীর রঞ্জনের গম্ভীর কন্ঠ শোনা যায়, “খোকা!”

*
ডাকটা আচমকা এল–এটা প্রতীন একেবারেই আশা করেনি। ফলত হতচকিতের মতো সঙ্গে সঙ্গেই সে উত্তর দিয়ে ফেলে, “অ্যাঁ!”
এদিকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই এমন একটা ‘অ্যাঁ’ শুনবেন, তা-ও আবার ঠিক পেছন থেকে–প্রবীর রঞ্জনও এটা আশা করেননি। তিনি তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে তাকান। তারপর প্রতীনকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠেন, “কী রে! তুই...এখানে?”
হ্যাঁ মানে...
কিছু বলবি?
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রতীনের যেন কথার খেই হারিয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “হ্যাঁ।”
কী?
প্রতীনের মুখ গম্ভীর, “ডাকছিলে?”
“ও,” প্রবীর রঞ্জন যেন হারিয়ে যাওয়া কথার খেই ধরে বলে ওঠেন, “হ্যাঁ, তা একটু ডাকছিলাম।”
প্রতীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রবীর রঞ্জন কলমটা সরিয়ে রেখে ডেস্ক থেকে একটা রুলটানা কাগজ গোছাতে গোছাতে বিড়বিড় করেন, “মায়ের নাম মালবিকাই বলেছিল তো...নাকি”। তারপর প্রতীনের দিকে হাত বাড়িয়ে কাগজটা দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, ভালো কথা! চিঠির শুরুটা এমনই রাখব ঠিক করেছি।”
প্রতীন কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে তাতে লেখা – 
মহাশয়/মহাশয়া,
আগামী ২৩শে অগ্রহায়ণ ১৪২৩ (ইং ৯-ই ডিসেম্বর, ২০১৭) শুক্রবার আমার পুত্র শ্রীমান প্রতীন চৌধুরীর সহিত মানিকতলা নিবাসী শ্রী উপেন্দ্রনাথ সরকার ও শ্রীমতি মালবিকা সরকারের একমাত্র কন্যা কল্যানীয়া নয়নিকার...

*
না, গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
কাগজটা হস্তান্তর করেই প্রবীর রঞ্জন আবার ডেস্কের দিকে ঘুরে গেছেন। যথারীতি বিড়বিড় করাও শুরু করে দিয়েছেন, “ঘোরাঘুরি তো অনেক হলো। এবার থিতু হও। পরিবারের একটা মানসম্মান রয়েছে...”
প্রতীন কাগজটা হাতে নিয়ে মিনিট দুয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভাবতে পারছে না কিছু। এটা কী হলো, আর কীভাবে হলো? ৯-ই ডিসেম্বর? আস্তে আস্তে চাপা রাগটা প্রতীনের মধ্যে বাড়তে থাকে। ভদ্রলোক ওঁদের সঙ্গে কোনরকম কথা না বলেই ডেট ঠিক করে ফেললেন? তাঁর মতামতই ফাইন্যাল?
ধীরে ধীরে ভ্রুকুটি দেখা দেয় প্রতীনের মুখে। চেক-মেট। তার দানে তাকেই মাত দিয়েছেন প্রবীর রঞ্জন।
পুরো ব্যাপারটা আত্মস্থ করে সে গম্ভীর গলায় বলে, “এর মানে কী?”
প্রবীর রঞ্জন তার দিকে মুখ না ফিরিয়েই বলেন, “এর মানে না বোঝার মতো কচি খোকাটি তো তুমি নও,” তারপর একটু থেমে আস্তে করে বললেন, “আমার মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে।”
প্রতীন নিমেষে জবাব দেয়, “তাতে কী হল?”
“মানে,” এবার প্রবীর রঞ্জন ঘুরে তাকান প্রতীনের দিকে।
প্রতীন বলে, “আমি নীলাকে বিয়ে করতে চাই। কোনো নয়নিকাকে নয়–এটাই বলতে এসেছিলাম।” তারপর প্রবীর রঞ্জনকে কোনোরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বিস্বস্ত সূত্রে খবর আছে, সে সময় নাকি প্রতীনের মুখে কোনো প্রেমজ আর্তি ফুটে ওঠেনি। তবে হ্যাঁ, তার মুখ এক পৈশাচিক ঘাত-প্রতিঘাতের ছায়ায় ঢেকেছিল।