চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

অভাব-অনটনে দিন কাটছে নিহতদের পরিবারের

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০১৯, ১০:৫১ এএম অভাব-অনটনে দিন কাটছে নিহতদের পরিবারের
চকবাজার চুড়িহাট্টার আগুনের পুড়ে গেছে সব- ছবি: কাশেম হারুন

 

চকবাজার চুড়িহাট্টার আগুনে রিকশাচালক সাইফুল নিহত হবার পর তার স্ত্রী খালেদা পরের বাড়িতে চুক্তিতে কাজ করে সন্তান খাদিজা(৮), সাদিয়া (৫) এর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাতেও তার সংসার চলছে না, অর্থ সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের আর্থিক অনুদান পাবার আশায় দিন কাটছে খালেদার। 

শুধু খালেদা-ই নন, চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির শিকারে পরিণত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের বেশিরভাগ পরিবারই দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত। কেননা মৃত্যুবরণকারীদের বেশিরভাগই ছিল সংসারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ-ই এমন কোনো সহযোগিতা পাননি, যা দিয়ে তাদের পুনর্বাসন সম্ভব। যেমনটা হয়েছিল রানা প্লাজার ভবন ধস, তাজরিন ফ্যাশনস-এ অগ্নিকাণ্ডসহ আরও কিছু ভয়াবহ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষেত্রে।

ছবি: কাশেম হারুন

রিকশাচালক সাইফুলের ছোট ভাই ফজলু জাগরণকে বলেন, ‘ভাইটা মারা যাওয়ার পর তার ওপর পরিবারের পুরা চাপ পইরা গেসে। বাচ্চা দুইটাও ছোট। দুইটারের নানার বাড়িতে রাইখা ভাবি মানষির বাড়িত বাড়িত কাম করে। কী করব নাইলে? খাইতে তো হইব। আমরা তো তেমন পয়সাপাতির মালিক না যে, ভাইয়ের সংসার আগলায়া রাখতে পারুম, খেতে কামলা দিয়া খাই।

তিনি জানান,  শুনছিলাম সরকার নাকি ১ লাখ টাকা করে দিব। কিন্তু কই, কবে দিব?

সাইফুলের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলায়।

ছবি: কাশেম হারুন

গত ২০ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে ৭১জনের মৃত্যু ঘটে। কেউ মারা যান ঘটনাস্থলে, কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন পথের পাশের ব্যবসায়ী ও পথচারি।

বাল্যবয়সে বাবা সোহরাব হোসেনকে হারানো সোলাইমান (২২) ছোট ভ্যানগাড়িতে করে ভাজা পোড়া খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতেন চুড়িহাট্টায়। আগুন তাকে অঙ্গার বানিয়ে দেয়। সাইফুলের ছোট ভাই জুলহাস (২০) নিজ এলাকার একটি ইটভাটায় দৈনিক চুক্তিকে কাজ করেন। তাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে।

সোলাইমানের মা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, বোধশক্তি কম। কথাবার্তা গুছিয়ে বলতে পারেন না, কাকে কেমন করে কি বলতে হয়, সেই সক্ষমতা তার নেই। কিন্তু বড় ছেলে মারা গেছে, সেটা ঠিকই বোঝেন, মাঝে-মধ্যে ছেলের কবরে গিয়ে চোখের পানি ফেলেন।

ছবি: কাশেম হারুন

কিন্তু ছেলে কী আর মায়ের বুকে ফেরে- খুব নম্র সুরে এই কথা জাগরণকে জানিয়ে সোলাইমানের গ্রামের ঘনিষ্ঠ চাচা জিন্নাত আলী বলেন, ওর মায়েরে দেখলে খুব কষ্ট লাগে। এলাকার লোকজন মিল্লা তাকে দেইখা-শুইনা রাখি। একদম কিছু বুঝে না, পাগলামি করে, কথাবার্তা গুছাইয়া কইতে পারে না। জুলহাসও সারাদিন থাকে না বাসায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সোলাইমানের মরদেহ গ্রহণ করেছিলেন জিন্নাত আলী। তিনি আরও বলেন, সেই সময় ঢাকার ডিসি অফিস থেইকা ২০ হাজার টাকা দিসিলো। পরে একদিন কোন মন্ত্রণালয় থেইকা জানি আমারে মোবাইল কইরা খোঁজ-খবর নিল, কইল ১ লাখ টাকা নাকি প্রধানমন্ত্রী দিব। সেইটাও তো বহুতদিন হইল। এরপরে আর কোনো খবর নাই। এই টাকাটা পাইলে বহুত উপকার হইত পরিবারটার।

সোলাইমানের তিন বোন। এরমধ্যে দুই বোন সংসারি। বাবার অনুপস্থিতিতে দুই বোনের বিয়েতে আর্থিক সহযোগিতাসহ অন্য তদারকিতে ছিল এলাকাবাসীর সহযোগিতা। এমনকি যে ৩ শতাংশ জায়গায় সাইফুলের ভিটাবাড়ি, সে তিন শতাংশের মধ্যে ১ শতাংশ এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা করে দেন।

জিন্নাত আলী বলেন, গরিব মানুষ, কই থাকব। আমরাই একটা ব্যবস্থা কইরা দিসিলাম।

ছবি: কাশেম হারুন

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (৪১) চুড়িহাট্টার শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন ছোট ছোট দুই সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে। প্রথম সন্তান মাহি ঢাকার আজিমপুরের একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ৪ বছর বয়স্ক সানজিদার শেষ আশ্রয় এখন মা নাহিদা রহমান-ই।

ঘটনাস্থলের পাশে মঞ্জুর একটি ওষুধের দোকান ছিল। পাশপাশি তিনি মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের এজেন্টও ছিলেন। এ দিয়েই স্ত্রী-সন্তানসহ থাকতেন ঢাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে মরদেহ গ্রহণ করেন মঞ্জুর নিকটাত্মীয় মাইনুল হোসেন চৌধুরী।

তিনি বলেন, এলাকার একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির দেয়া অনুদান, মঞ্জুর দোকানের আশপাশের কিছু ব্যবসায়ীর দেয়া অনুদান, ঢাকা জেলা প্রশাসনের দেয়া ২০ হাজার টাকার বলে এখনও টিকে আছে মঞ্জুর পরিবার। কিন্তু এভাবে কয়দিন? জমানো টাকা তো শেষ হয়ে যাবে। কোনো রোজগার নেই পরিবারটির।

‘শুনেছিলাম, সরকার নাকি ১ লাখ টাকা করে দেবে, কিন্তু এখন এসব বিষয়ে আর কোনো কিছু শুনি না’- বলেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।

ছবি: কাশেম হারুন

গত ২১ ফেব্রুয়ারি-ই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কাছে সেবাবুথ স্থাপন করেছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন। সেখান থেকে মরদেহ বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছিল স্বজনদের। নগদ ২০ হাজার টাকাও দেয়া হচ্ছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সেসময় বুথে দফায় দফায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা, কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কয়েকজনের সাথে শনিবার (২৭ এপ্রিল) যোগযোগ করে জাগরণ।

তাদের দুইজন নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, নিহতদের পরিবারকে এক লাখ করে টাকা দেবার পরিকল্পনা সরকার করেছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেবার কথা। তথ্য উপাত্তও সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। কিন্তু নানা ইস্যুর কারণে এটি এখন চাপা পড়ে গেছে। কবে নাগাদ দেয়া হবে, সেটা বলা মুশকিল।

আরএম/এসএমএম/টিএফ