মহামারি ঠেলে এলো খুশির ঈদ

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২১, ১০:৪২ পিএম মহামারি ঠেলে এলো খুশির ঈদ
সৃজনশীল চিত্র ● সংগৃহীত

মাওলা আলি ।।

‘‘আনন্দে মহিমান্বিত ঈদ। ঈদুল আজহা মানে— লোক দেখিয়ে বহুদামে কেনা পশু জবাই নয়। রুটি-গোশত খাওয়ার দিনও নয়। নয় দানের নামে লোক দেখিয়ে গোশত বিলানো। আল্লাহভীতি থেকে আত্মত্যাগের শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর পথে কোরবানি করাই হলো ঈদের শিক্ষা’’

কবি নজরুলের ভাষায়—

চাহি নাকো গাভী দুম্বা উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’

ঈদুল আজহাতে চাঁদ দেখার আনন্দময় অনিশ্চয়তা নেই। ১০ দিন আগেই ১২ জুলাই (সোমবা) নিশ্চিত হয়ে গেছে পবিত্র ঈদুল আজহার দিনক্ষণ। সে অনুযায়ী পছন্দের কোরবানির পশু কিনেছেন সামার্থ্যবানরা।

নাড়ির টানে শহরবাসী পথের ক্লান্তি ভুলে মায়ের স্নেহভরা কোলে ফিরে গেছেন। দিনের শুরুতেই মুসল্লিরা ঈদগাহে যাবেন ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ে। ফিরে এসে আল্লাহর পথে পশু কোরবানি করবেন।

৪ হাজার বছর আগে মুসলমানদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হন সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার। পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) ছিলেন তার সবচেয়ে আদরের ধন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিজ পুত্রকেই কোরবানি করার উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার কুদরতে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়।

হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভের আশায় তার পথে পশু কোরবানি করেন।

ঈদের পরের দুই দিনও পশু কোরবানির বিধান রয়েছে। ২৩ জুলাই আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত কোরবানি করা যাবে। সামর্থ্যবানদের জন্য কোরবানি ফরজ হলেও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে না দরিদ্ররাও। কোরবানির পশুর গোশতের তিন ভাগের এক ভাগ তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার বিধান আছে।

ঈদ মুসলমানদের সার্বজনীন অনুষ্ঠান হলেও, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাঙালি মুসলমানরা জৌলুসপূর্ণ ঈদ উদযাপন করেন। বাংলাদেশে ইসলামের প্রথম যুগে ঈদ সাদামাটাভাবে উদযাপন করা হলেও মোগল ও নবাব আমলে তা উৎসবের রূপ পায়। ১৭ শতকে পরিব্রাজক মীর্জা নাথানের ‘বাহরিস্তানে গায়েবি’ বইয়ে বাঙালির বর্ণিল ঈদের বর্ণনা পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুযায়ী, ‘ঈদে বাঙালি মুসলমানরা একে অন্যের বাড়িতে যেতেন। সেখানে আহারের ব্যবস্থা থাকত। ঈদের দিন মুসলমান নারী-পুরুষ ও ছেলেমেয়েরা সুন্দর কাপড় পরত। সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রা সহকারে ঈদগাহে যেত। অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মুক্ত হস্তে অর্থ ও উপহারাদি ছড়িয়ে দিতেন। আর সাধারণ মুসলমানরা গরিবদেরকে দান-খয়রাত করতেন।’

বুধবার (২১ জুলাই) যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। তবে এবারো ঈদ এসেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। গত বছরের মতো এবারো মুসলিম বিশ্ব যখন কোরবানি ঈদ উদযাপন করছে তখনো বিশ্বব্যাপী চলছে মহামারী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর মহাতাণ্ডব।

এই করোনা মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত মানুষ।  মঙ্গলবার (২০ জুলাই)  দেশে করোনায় মারা গেছেন ২০০ জন।  আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৫৭৯ জন। তাদের জীবনের ওপর নেমে আসা এ দুঃসময়ের অন্ধকার কবে কাটবে, তাও অজানা।

করোনার কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও চলছে অর্থনৈতিক সংকট। যারা গতবার কোরবানি দিয়েছেন তাদের অনেকেই এবার কোরবানি দেয়া সামর্থ্য হারিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কোরবানি দিতে পারছেন না প্রায় ৩০ শতাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তার পরও ঈদের অনেক কিছুই চলবে চিরাচরিত ধারা মেনে। মানুষ একে-অপরকে শুভেচ্ছা জানাবেন। রাজনীতিবিদরাও দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবেন।

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা আলাদা বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। 

ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে ভিডিও বার্তায় ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোরবানির ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

মঙ্গলবার (২০ জুলাই) এক ভিডিওবার্তায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

চলমান করোনা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, এ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততেই হবে। করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।

ভিডিও বার্তার শুরুতেই দেশবাসীকে সালাম জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল পবিত্র ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা জানাই সকলকে। প্রবাসী ভাই-বোনদের প্রতিও রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই বুধবার কোরাবানির ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এবার এমন এক সময়ে ঈদ এসেছে যখন মহামারীর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। আর এই লড়াইয়ে আমরা অনেক আপনজনদের হারিয়েছি। আজকে তাদের স্মরণ করছি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তবে এই লড়াইয়ে আমাদেরকে জিততেই হবে এবং আমরা জিতব ইনশাল্লাহ।

ঈদের শুরুটা হয় ঈদগাহে সবাই মিলে নামাজ পড়তে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। করোনার কারণে গত ৫১ বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নেই আয়োজন প্রধান জামাতের। ঐতিহাসিক শোলাকিয়াতেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না বৃহৎ জামাত। করোনার বিস্তার রোধে দেশের কোথাও এবার ঈদগাহে জামাত হবে না। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদুল আজহার প্রথম জামাত সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত হবে। 

সরকার বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবজনিত প্রেক্ষাপটে ঈদুল ফিতরের মতো ঈদুল আজহার ঈদের নামাজের জামাতের সময় মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না। নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসবেন। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে অজু করে মসজিদে আসতে হবে এবং অজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদে অজুর স্থানে সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে এবং মসজিদের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার/হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান-পানি রাখতে হবে।

ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে আসতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। শিশু, বৃদ্ধ, যেকোনো ধরনের অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করা যাবে না।

করোনা ভাইরাস মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ শেষে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করার জন্য খতিব ও ইমামগণকে অনুরোধ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য ইমাম ও মসজিদগুলোর পরিচালনা কমিটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাঙালির কাছে ঈদ শুধু আনন্দের নয়, সব ভেদাভেদ ভুলে পরম শত্রুকেও বুকে টেনে নেয়ার দিন। কিন্তু করোনার সংকটে এখানেও বাধা রয়েছে। ঈদ জামাতের পর কোলাকুলি করা যাবে না, হাত মেলানো যাবে না। 

প্রতি বছর ঈদে সরকারি ভবন, সড়ক সাজানো হয় রঙিন বাতি ও পতাকায়। করোনার কারণে এবার নেই কোনো সাজসজ্জা। প্রতি বছর ঈদে নতুন করে সাজে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, বিনোদন কেন্দ্র। লাখো মানুষের ভিড় হয়। এবার করোনা ঠেকাতে সব বন্ধ। তবে সরকারি আশ্রয়কেন্দ, হাসপাতাল, কারাগারে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। করোনার কারণে নাটক, সিনেমার শুটিং বন্ধ। তাই নেই নতুন টিভি অনুষ্ঠান।

জাগরণ/এমএ/এসএসকে