জনকল্যাণমূলক বাজেট

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০১৯, ০৩:২২ পিএম জনকল্যাণমূলক বাজেট

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাজেট হয়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেওয়া প্রথম বাজেট যেখানে ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, সেখানে ৪৭ বছর পর ১৩ জুন (২০১৯) বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শীর্ষক ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করে বিস্ময় জাগিয়েছেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেট ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ বড়।

৩০ জুন এই বাজেট পাস হবে। ১৪ জুন (২০১৯) ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ খুশি কিনা তা দেখতে হবে। এটা আমাদের ১১তম বাজেট। যতটুকু আমি বলেছি তার থেকে অনেক বেশি কিছু রয়েছে বাজেটে। এই বাজেট জনকল্যাণমূলক। বাজেট যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য সবাই কাজ করবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশেকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, উন্নত করা, সমৃদ্ধিশালী করা এবং স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার লক্ষ্যে যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগে বাইরে গেলে বাংলাদেশকে কেউ চিনত না। এখন আমাদের সবাই চেনে। এটাই আমাদের বড় পাওনা।’

তাঁর মতে, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা সরকারের লক্ষ্য; এসডিজি বাস্তবায়ন ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, আগামী অর্থবছরের বাজেট ‘জনকল্যাণমূলক’। কারণ জনগণের কল্যাণচিন্তার অনেক প্রসঙ্গ রয়েছে এই বাজেটে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সামাজিক সুরক্ষা’ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি।

   
অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটের বিশেষ দিক হলো ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে’র দিকে সরকারের অধিক মনোনিবেশকরণ। কেবল বরাদ্দ নয়-  মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, হিজড়া ও চা শ্রমিকসহ পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে; যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরও বেশি মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ বাবদ ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচ বছরে এ খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার রয়েছে।  


বর্তমানে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তাসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থাই হলো ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’। যদিও বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; তবু অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এখনও বিপুলসংখ্যক। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ১২.৩০ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করছে সরকার। এই বাস্তবতায় বর্তমান বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সাড়ে ৭৪ লাখ মানুষ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন।

সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) চৌদ্দটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চিহ্নিত করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে বাজেটে ‘বয়স্ক ভাতা’ কর্মসূচিতে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪৪ লাখে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতার বিষয়েও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে বয়স্ক ভাতাভোগীর মতো এ ভাতারও পরিধি ও বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ লাখ উপকারভোগী প্রতিমাসে ৫শ’ টাকা হারে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৭ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

 
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে বাজেটে ১২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে সম্মানী ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। এছাড়া তাদের উৎসব ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা, নববর্ষ ভাতা হিসেবে ২ হাজার টাকা এবং বিজয় দিবস ভাতা ৫ হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার ক্ষেত্রে ভাতাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ লাখ উপকারভোগী প্রতি মাসে ৭শ’ টাকা হারে এ ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ ৫৪ হাজারে উন্নীত হচ্ছে। একই সঙ্গে ভাতার হার প্রতি মাসে ৭শ’ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 


এছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রমে ভাতাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব; ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা; চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি; কর্মজীবী মার সহায়তা তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ভিজিডি কার্যক্রমে তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। উপরন্তু অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি কার্যক্রমে তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা অপরিবর্তিত। বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম ২০১৯-২০ সালে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ৬৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। অবশ্য শুধু বেদে জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে ১০ হাজার নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ খাতের আওতায় ৭১ হাজার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা হচ্ছে।

মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিফলন বাজেটে হয়েছে বলেই অঙ্গীকারগুলো পূরণে বিশেষ মনোযোগ ও বরাদ্দ এসেছে। এর ফলে সরকারের ঘোষিত রূপকল্পগুলো প্রত্যাশিত গতি পাবে। এছাড়া নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে এবারের বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং কৃষি ভর্তুকি, ঋণ ও কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া হবে। গ্রাম যেন উন্নত হয়, সেখানকার মানুষ যেন শহরের মানুষের সুবিধা পায়, সেজন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচির আলোকে পল্লি এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দেশের প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ চলছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য তরুণদের কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। সে লক্ষ্যে যে কাজ করছে সরকার। অন্যদিকে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হবে বলেই বাজেটে তার নির্দেশনা রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে শিল্প বিপ্লব অনিবার্য।


তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ( সেফটি নেট) ও সুরক্ষা খাতে গত এক দশকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। মানবিক সহায়তা, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগে ক্ষতির পুনর্বাসন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসৃজনসহ জনহিতকর বিভিন্ন খাতে এই অর্থ দেয়া হচ্ছে। এবারের বাজেটে এ বিষয়টি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের কাছে।

লেখক :  অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়