অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা না থাকাই বাংলার মূল সমস্যা

শিশির ভট্টাচার্য্য প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ০৫:০২ পিএম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা না থাকাই বাংলার মূল সমস্যা

মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাগরণ অনলাইনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা: ভালোবাসা না কোনঠাসা শীর্ষক এক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাগরণ অনলাইন প্রধান বিধান রিবেরুর সঞ্চালনায় তাতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবঙ্গের ব্যাকরণবিদ পবিত্র সরকার এবং প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক চিন্ময় গুহ। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী শিশির ভট্টাচার্য্য।

 

অনুষ্ঠানে করা প্রশ্ন ও শিশির ভট্টাচার্য্যের দেয়া উত্তর এখানে তুলে ধরা হলো।  

 

প্রশ্ন: আমি প্রথমেই শিশির ভট্টাচার্য্য আপনাকে দিয়ে শুরু করতে চাই। আপনার একটি লেখায় আমি পড়ছিলাম, ইংরেজি এখন সুয়োরানী আর বাংলা হচ্ছে দুয়োরানী। আপনি ডি-জুরে এবং ডি-ফ্যাক্টোর কথা বলছিলেন। বাংলা কাজীর খাতায় আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই এরকম একটি ব্যাপার আপনি বোঝাতে চেয়েছেন। বাংলা ভাষাকে যদি ঠিকঠাকভাবে আবার প্রথম সারিতে বা ভালোবাসার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হয় কোনঠাসার অবস্থা থেকে তাহলে ভাষানীতি বা ভাষা আইন প্রচলন করার প্রয়োজন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন সেই লেখায়। কিন্তু, আপনার কি মনে হয়না যে এ সমস্ত কিছু করার পেছনে একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারেরও ব্যাপার রয়েছে?

 

শিশির ভট্টাচার্য্য: নিশ্চয়ই রয়েছে, আমাদের যা যখন দরকার, আমরা তা না করে অন্য একটা কাজ শুরু করি। আমাদের বায়ান্ন সালে স্লোগান ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই্, সেটা ভুলে গিয়ে হঠাৎ করে বছর বিশেক আগে আমরা মাতৃভাষা দিবস পালন শুরু করলাম। মাতৃভাষা নিয়ে কিন্তু কারো কোনো সমস্যা ছিলো না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে কিনা সেটাই ছিলো সমস্যা। তো, বাংলা আমি মনে করি এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা নয়, কারণ, এটা উচ্চশিক্ষার ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষার অঙ্গন থেকে এটা দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছে এবং তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে, ইচ্ছাপূর্বক। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিকে ইংলিশ ভার্সন ছিলো, সরকার এ বছর থেকে প্রাথমিকে ইংলিশ ভার্সন চালু করছে। আমি জানি না ইংলিশ ভার্সনে কে পড়াবে? আমাদের এখানে ইংরেজি পড়ানোর লোক নেই। আমি যখন ছোট ছিলাম আমাকে ইংরেজি পড়ানো হতো চট্টগ্রামী ভাষায়। আমাদের সমস্ত কিছুই চট্টগ্রামী ভাষায় পড়ানো হতো। এখন আরো কুড়ি বছর পরে আমি জানি যে অবস্থা আরো খারাপ। আমাদের ইংরেজি শিক্ষক নেই, ইংরেজি পড়ানোর লোকই নেই। ইংরেজি মাধ্যমে কারা পড়াবে আমি ঠিক জানি না। এর ফলে আমরা যে ছাত্র পাচ্ছি তারা না হচ্ছে শিক্ষিত, না জানছে ভাষা। তারা ইংরেজিও পারে না, বাংলাও পারে না, বিষয়ও পারে না। তারা হচ্ছে অর্ধভাষী এবং অর্ধশিক্ষিত। কিন্তু সরকার এবং জনগণ জেনেশুনে এ ধরনের রাজনীতি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমাদের কথা শুনছেও না। আমরা প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে বলে যাচ্ছি এবং তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

 

আবার আরেকটা নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে এ বছর। বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষা করতে হবে, এটাকে জাতিসংঘের ভাষা করতে হবে। তার জন্য নাকি কয়েক হাজার কোটি টাকা দরকার। আমি জানি না যেখানে রাষ্ট্রভাষাই এখনো করতে পারিনি সেখানে সেটাকে জাতিসংঘের ভাষা করে যে কি এমন আমাদের অর্জন হবে, আমার জানা নেই। সুতরাং, এগুলো আমি প্রতিবছরই বলি, এবারও বলছি, আমি আপনাদের ভাবনার জন্য কথাগুলো আবারো বললাম। বলে বলে আমাদের এখন ইংরেজিতে যাকে বলে একদম ফেড-আপ।

 

শিক্ষার্থীরা হচ্ছে আগামী দিনের বিচারক, আগামী দিনের প্রশাসক, আগামী দিনের নেতা, সবকিছু শিক্ষা থেকেই আসে। তো, শিক্ষার মাধ্যম যদি বাংলা না হয় তাহলে কোনো কিছুর মাধ্যমই বাংলা হবে না। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আজকাল ইংরেজিতে ক্লাস নেওয়া হয়। বাংলায় পাঠদান করা হয় না। বলা হয় কি, বাংলায় যথেষ্ট বই নেই। আমার কথা হচ্ছে, যত পাঠ্যবই আছে সেগুলো কেন বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাকেন্দ্র বা এ ধরণের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে তারা কেন সমস্ত পাঠ্যবই বাংলায় অনুবাদ করাচ্ছেন না? তাহলে তো পাঠ্য বইয়ের ঝামেলাটা চলে যায়। এভাবে যদি বাংলাকে উপেক্ষা করা হয় শিক্ষার ক্ষেত্রে! এটা ঠিক যে প্রশাসনিক কাজকর্ম বাংলা করছি, কিন্তু প্রচুর ভুল বানানে এবং ইচ্ছামতো বাংলা লেখা হচ্ছে সেখানে। এবং জনগণের মধ্য থেকেই এই অভিযোগগুলো আসছে। সেটাও কিন্তু ঠিক নয়। তারপরও আমি বলব যে প্রশাসনে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে এটা একটা বড় ব্যাপার, কিন্তু বিচারালয়ে দু’একটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো আদালতের ভাষা কিন্তু বাংলা নয়। শিক্ষার মাধ্যমটা হচ্ছে প্রধান সমস্যা। এবং একটি ভাষার কিন্তু তিনচার ধরনের প্রতিষ্ঠা আছে। একটা হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা। আমার মনে হয় বাংলার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা নেই, এটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। যদি এটা অর্জন করা যায় তবে বাংলা অতিসত্ত্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠবে।