সৈয়দ আবুল মকসুদ

আপনাকে মনে রাখবে বাংলাদেশ

ফয়সাল আহমেদ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৩:১১ পিএম আপনাকে মনে রাখবে বাংলাদেশ

লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদকে প্রথম সরাসরি দেখি আমার জেলা শহর কিশোরগঞ্জে। বছর দশেক আগে একটি সামাজিক সংগঠনের আমন্ত্রণে তিনি এবং অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন কিশোরগঞ্জ শহরে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল শহরের জজ কোর্টের হলরুমে। সেখানে তাঁরা বক্তব্য রেখেছিলেন। দর্শক-শ্রোতায় প্রায় পরিপূর্ণ মিলনায়তনে তাঁদের জ্ঞানগর্ব বক্তৃতা আমাদের ঋদ্ধ করেছিল। তখন সংগঠনটির সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত থাকায় তাঁদের অনেক কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। নানা বিষয়েই তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন। এখানেই শেষ নয়, সেদিন তাঁদের আগ্রহে হাওর ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সড়কপথে একই গাড়িতে এবং নৌকায়ও তাঁদের সঙ্গে ছিলাম আমি। নানা বিষয়ে তাঁদের আলোচনা শুনছিলাম অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে। যত দূর মনে পড়ে ঠিক সেই দিনই ঘোষণা আসে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একুশে পদক পেয়েছেন। আমরা সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাই। তাঁদের লেখালেখির সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত থাকার সুবাদে দুইজনেই আমার অত্যন্ত প্রিয়, অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যতিক্রমী সেলাইবিহীন সাদা পোশাক পরিহিত সৈয়দ আবুল মকসুদই কিন্তু সেদিন আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন তাঁর দিকে। আমি শুধু তাঁকেই দেখছিলাম, তাঁর কথা শুনছিলাম, সুযোগ পেলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিশোরগঞ্জের হাওরে সে সময় পানি না থাকায় হাওরের অন্য এক রূপ দেখেছিলাম আমরা। তখন পূর্ণ কৃষির সময়। কৃষকরা ব্যস্ত ফসল ফলাতে। ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠছে পানিতে টইটম্বুর থাকা আমাদের প্রাণের হাওর। নৌকায় কিছু দূর যাওয়ার পর অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু জমির পাশে নৌকাটি নোঙর করল। সেদিন ঢাকার অতিথিরা তো বটেই আমরাও মুগ্ধ হয়েছিলাম হাওরের রূপ দেখে। হঠাৎ্ খেয়াল করলাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন নিজের মতো করে। লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে জমিতেই কী যেন একটা পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন। তারপর কৃষকদের সঙ্গে কথা বললেন, সঙ্গে সঙ্গে নোটও নিলেন। আমরা ফিরে আসার সময় সৈয়দ আবুল মকসুদ ও অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে এক কৃষক তাঁর জমিতে চাষ করা লাউ উপহার দিলেন, আমরা টাকা দিতে চাইলে কৃষক তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। এর কিছু সময় পর আমরা ফিরে আসি চমৎকার এক অভিজ্ঞতা নিয়ে। সন্ধ্যার পর তাঁরা কিশোরগঞ্জ শহর ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেদিনের সেই স্মৃতিটুকু আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে। এরপর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে আবার দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, খুব অল্প সময় কথাও হয়েছিল। এরপর অনেকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু কথা হয়নি। কথা না হলে কী হবে, তিনি তো আমাদের হৃদয়েই ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
যাঁকে নিয়ে এসব কথা লিখছি তিনি গতকাল সন্ধ্যায় অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের মাঝে আর কখনো ফিরে আসবেন না। নদী ও পরিবেশের সুরক্ষায়, সড়ক নিরাপদ রাখার আন্দোলন কিংবা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আর কখনো রাজপথে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন না তিনি। 
সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। পরে তিনি সাপ্তাহিক ‘জনতা’য় কাজ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) কাজ করেছেন। ২০০৪ সালের ২ মার্চ বার্তা সংস্থার সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন। প্রথম আলো সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১ মার্চ পত্রিকাটিতে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত–ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শীর্ষক সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা প্রকাশিত হয়। তখন আবুল মকসুদ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক ছিলেন। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আবুল মকসুদকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকারে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে কলাম লিখতেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ঋষিজ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—কবিতা: বিকেলবেলা, দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা; প্রবন্ধ: যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি; জীবনী: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি; ভ্রমণকাহিনি: জার্মানির জার্নাল, পারস্যের পত্রাবলি।

এ ছাড়া সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও মমত্ববোধ তাঁকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের আকস্মিক এই প্রয়াণে অসংখ্য মানুষ ব্যথিত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে হাজারো মানুষের ফেসবুক ওয়ালে তাঁকে দিয়ে দুঃখগাথা, স্মৃতিচারণাও ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কতটা আপন ছিলেন সাধারণের।

তিনি ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করে সেলাইবিহীন সুতির সাদা কাপড় পরা শুরু করেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতি। তাঁর চলে যাওয়ায় এখন আমার বুঝতে পারব তিনি আমাদের জন্য, এই দেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক ছিলেন। এখন থেকে নদী, পরিবেশ তথা মানুষের অধিকার রক্ষায় সড়কে কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে, সভায় কিংবা মানববন্ধনে সাদা চুলের শুভ্র মানুষটিকে আমরা আর দেখতে পাব না, অফসোস। তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন এটাই কামনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।