করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

ঢালাও লকডাউনের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে

সাইফুর রহমান তপন প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম ঢালাও লকডাউনের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে

করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ প্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রাণঘাতি এই জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত লোকের সংখ্যা। একই সাথে দ্রুত লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রথম ঢেউয়ের সময় যেখানে দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল ৪ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি, সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ যেন শুরুই হয়েছে ৪ হাজারের বেশি দিয়ে। প্রথম ঢেউ শুরু হয়েছিল গত বছরের ৮ মার্চ, যা চূড়ায় ওঠেছিল ২৯ জুন। যেদিন দেশে করোনা-সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৪০১৪। আর চলমান দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে মার্চের ১ তারিখ বা তার দু’একদিন আগে। মাত্র ২৬/২৭ দিনে যা প্রথম ঢেউয়ের চ’ড়া ছুঁয়ে যায়। এর মাত্র দুই বা তিন দিন পর দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার, সম্প্রতি যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও খুব দ্রুত ৫০ ছাড়িয়ে যায়। প্রথম ঢেউয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু ঘটেছিল ৩০ জুন। এদিন ৬৪ জন মারা যায়। আর তা ঘটেছিল ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম মৃত্যু ঘটার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর। কিন্তু চলমান ঢেউয়ে ৬৬ জন মারা যায় ঢেউ শুরুর মাত্র ৩২/৩৩ দিনের মাথায়। এই মৃত্যুর সংখ্যাটা গত ৮ এপ্রিল ৭৪ হয়ে যায়।

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা প্রথম ডেউয়ের জন্য যেমন প্রস্তুত ছিল না, এখনও তেমন প্রস্তুত নয়। প্রথম ঢেউয়ের সময় করোনা রোগীর প্রাথমিক প্রয়োজন যে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ তারই ব্যাপক ঘাটতি ছিল। এমনকি রাজধানীর কুয়েত-মৈত্রীর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। আর আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের অপ্রতুলতার কথা তো বলাই বাহুল্য। ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেসময় বহু করোনা রোগী শুধু অক্সিজেন না পেয়ে মারা গেছেন।
বলা হচ্ছে, গত এক বছরে প্রচুর করোনা চিকিৎসার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। বহু জেলা শহরে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে, কোথাও কোথাও আইসিইউ-ও বসানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনও প্রাথমিক অবস্থায় আছে এখনই হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে ভরে গেছে। বিশেষ করে, ঢাকা চট্টগ্রামে রোগীরা সিট পাচ্ছেন না, পেলেও আইসিইউ বেড বা ভেনটিলেশন না পেয়ে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছেন।

খুব দুঃখজনক বিষয় হলো, গত জুন মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জেলা সদরে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা এবং আইসিউ স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এজন্য দ্রুত টাকাও বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পগুলোর ৫০ শতাংশও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী জুলাই/আগস্ট মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন খুব স্পষ্টভাবেই মার্চ মাসে করোনার সম্ভাব্য আঘাত নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকেরা তা খুব আমলে নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা তারা যদি তখন আমলে নিতেন তাহলে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হতে না হতেই চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ত না। করোনা রোগীদেরকেও  হাই-ফ্লো অক্সিজেন বা একটা আইসিইউ বেডের জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় প্রাণ হারাতে হতো না।

অনেকের মনে থাকার কথা, প্রথম ঢেউয়ের সময় খুব হাঁকডাক করে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকায় দুটি ফিল্ড হাসপাতাল, একটি বসুন্ধরার একটা ভবনে আরেকটি মহাখালিতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বা ডিএনসিসি’র একটি পরিত্যক্ত ভবনে করা হলো। কিন্তু সেগুলো অপারেশনে আসতে আসতে করোনা সংক্রমণ কমে গেল। আর তা দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগুপিছু কিছু না ভেবে ওই হাসপাতাল দুটি গুটিয়ে নিল। এখন আবার একটি ১০০০ বেডের ফিল্ড হাসপাতাল করা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। হয়ত আবার দেশের কষ্টার্জিত কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে। কিন্তু তা মরণাপন্ন করোনা রোগীদের কতটুকু কাজে লাগবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে নিজেরা খালাস পেতে চাইছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিদিন বলছেন, ভ্যাকসিন আসার পর নাকি মানুষ বেপরোয়া জীবন যাপন করছে তাই করোনা এতটা আগ্রাসী রূপ নিতে পেরেছে। কথাটা মেনে নেওয়া যেত যদি প্রশাসনের লোকদেরকে বিগত মাসগুলোতে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে বাধ্য করতে তৎপর দেখা যেত। 

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রীপরিষদ একাধিকবার মাস্ক পরার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করেছে। মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জারিকৃত এসব নির্দেশনার খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও দু’একবার মাস্কবিহীন পথচারী ও পরিবহন-যাত্রীদেও জরিমানা করতে দেখা গেলেও এতে খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতির কোনো ইতরবিশেষ হয়নি।

শুধু তা নয়, এ সময়ে দেশে ঢোকার সব পয়েন্টে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের নিয়মিত স্ক্রিন করার কথা থাকলেও তা কি যথাযথভাবে করা হয়েছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাজ্যে অক্টোবরের শেষ দিকে যখন করোনার একটা নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেল তখন লন্ডন থেকে আসা যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হলো। বলা হলো, করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটবিহীন যাত্রীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?

সর্বশেষ গত মার্চে যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশের— যেসব দেশে ওই লন্ডনি করোনা ছড়িয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে, নাম উল্লেখ করে বলা হলো— ওই দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদেরকে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকলেও ৭ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তা-ও ঠিকমত প্রতিপালিত হয়নি। 

মিডিয়াতে এ নিয়ে বহু রিপোর্ট বেরিয়েছে যে, ওই ধরনের যাত্রীদেরকে কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ হাত-পা গুটিয়ে বসেছিল। এই সুযোগে সংশ্লিষ্ট যাত্রী কোয়ারেন্টিনকালে শুধু হোটেল রুমে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা মারা নয় নিজের বাড়ি পর্যন্ত ঘুরে এসেছে। আজকে যে চোখের পলকে করোনা পরিস্থিতি রীতিমতো আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গেছে তার মূল কারণ কোয়ারেন্টিনের নামে এহেন প্রহসনের মধ্যেই নিহিত। 

করোনার প্রথম ঢেউ এদেশে ছোবল মেরেছিল প্রধানত ইতালি-ফেরত বাংলাদেশিদেরকে ঠিকঠাক কোয়ারেন্টিনে রাখতে না পারার কারণে। আর জীবাণুটিকে প্রায় কোণঠাসা করে দেওয়ার পরও দেশে করোনা যে আজ প্রবল আগ্রাসন চালাচ্ছে তার পেছনে আছে লন্ডন বা বিদেশ-ফেরত লোকদেরকে যথাযথভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে না পারার ব্যর্থতা।
স্মর্তব্য, প্রথম ঢেউয়ে যত করোনা কেস পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগ ছিল ইতালি বা পশ্চিম ইউরোপীয় করোনা ভেরিয়েন্ট-জাত। আর এখন যেসব কেস পাওয়া যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় বের হয়েছে, তার ৯০ শতাংশেরও বেশি সাউথ আফ্রিকান ও লন্ডনি ভেরিয়েন্ট-জাত।

লন্ডনি ভেরিয়েন্ট ইতালিয়ান বা প্রথম ঢেউয়ের যেকোনো ভেরিয়েন্টের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সংক্রামক বলে প্রমাণিত। আর সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টটা লন্ডনি ভেরিয়েন্ট থেকে জন্ম নিলেও এর রোগীকে মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা অন্য ভেরিয়েন্টগুলোর চেয়ে বেশি। ভাইরলজিস্ট প্রফেসর নজরুল ইসলামের মত অনেকের ধারণা, চলমান ভয়ংকর করোনা পরিস্থিতির জন্য এই ভেরিয়েন্টগুলোই দায়ী।
বিষয়টা সম্পর্কে সম্ভবত সরকারের সর্বোচ্চ মহলও অবগত। এ জন্যই তাঁরা দৃশ্যত এক ধরনের অনিচ্ছা নিয়ে হলেও লকডাউনের পথে হেঁটেছেন। অনিচ্ছার কথাটা বলা হলো, এ কারণে যে গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ করে মানুষ যখন দেশব্যাপী ৭ দিনের লকডাউনের ঘোষণা শুনল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন যে লকডাউন মানে লকডাউন। তারা, বিশেষ কওে ঢাকা শহরে যাদের একদিনও বসে বসে খাওয়ার উপায় নেই, হুড়াহুড়ি করে মফস্বল বা গ্রামে নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটলেন। কিন্তু লকডাউন যখন শুরু হলো, তখন দেখা গেল, লকডাউন আসলে নো-লকডাউন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে পড়েই সরকার লকডাউনকে এতটা নমনীয় রূপ দিয়েছে।

অবশ্য এখন আবার ৭ দিনের ‘কঠোর’ লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু এ লকডাউনে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস প্রতিষ্ঠান কারখানা বন্ধ থাকবে। কোনো ধরনের পরিবহন চলতে পারবে না। 

সরকারের এ ‘কঠোর’ লকডাউন বাস্তবে কী রূপ নেবে, তা কেবল ওই সময়টাতেই বলা যাবে। তবে এটা ঠিক, ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে যতটুকু সময় পর্যন্ত মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা প্রয়োজন ততক্ষণ সব কিছু বন্ধ করে রাখার বাস্তবতা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক, বাংলাদেশে নেই।

এখানে সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে, যারা জনসংখ্যার খুবই ক্ষুদ্রাংশ, কি মধ্যবিত্ত কি নিম্নবিত্ত, কারোরই ১৫ দিনও বসে বসে খাবার সুযোগ নেই। হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং তাদেও ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ কর্মচারি প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা এখনও সামলে ওঠতে পারেনি। ফলে বিজনেস কমিউনিটির বিভিন্ন অংশ থেকে যে বলা হচ্ছে, আরেক দফা লকডাউন তাদেও কাছে হবে মরার ওপর খাড়ার ঘা দেওয়ার মতো, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তা বলে আমরা করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণও করতে পারি না। তাই সরকারকে ঢালাও লকডাউনে না গিয়ে বিকল্প কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। একটু লম্বা সময়ের জন্য কোনো কোনো সেক্টর বন্ধ রাখলে দেশের খুব বেশি ক্ষতি হবে না, আবার বড় শহরগুলোতে জনচলাচলও সীমিত রাখা যাবে, তা বের করতে হবে। এরকম কিছু করা গেলে পাবলিক প্লেসে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কড়াকড়িও আরোপ করা যাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক