১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহান বিপ্লব, যার ফসল হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিবিপ্লব। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় প্রতিবিপ্লবীরা ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ১৫ আগস্টের পর এ দেশে কায়েম হয় প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের রাজত্ব। ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে একত্রিত না হলেও পাকিস্তানের আদর্শ, নিয়ম-কানুন, চিন্তা-চেতনা বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হতে কোনো সমস্যা হয়নি। যে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা হলো। কেননা ১৫ আগস্টের পর যারা বাংলাদেশ শাসন করছিলেন তারা ছিলেন পাকিস্তানেরই প্রেতাত্মা।
বাংলার মাটি ও মানুষের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। পলি মাটি শুকালে যেমন শক্ত হয়, ভিজলে তেমনি নরম হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাংলার মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, আবার আষাঢ় মাসে বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে যায়। বাংলার মানুষ এই বাঘ, আবার এই বিড়াল। নেতৃত্ব পেলে এরা বীর, নেতৃত্ব শূন্য হলে এরা কাপুরুষ। ১৯৫৪ সালে শতকরা ৯৭ ভাগ জনগণ যেখানে যুক্তফ্রণ্টকে ভোট দিল, সমর্থন করল, শত প্রলোভন ও অত্যাচারকে তারা ভ্রূক্ষেপ করল না। মাত্র দুই মাসের মাথায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২ ক ধারা প্রয়োগ করে বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে দিল। মন্ত্রীসভার সদস্য শেখ মুজিবসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং শত শত ছাত্র ও আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করতে লাগল। সেই জনগণ কোনো ‘রা’ শব্দ না করে নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে রইল। দ্বিতীয় ঘটনা হলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়, হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে হওয়া দরকার ছিল সেভাবে হয়নি। এটাই দুঃখের বিষয়। কথায় বলে, “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।” বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মানুষ যেন তাই হয়ে গিয়েছিল, হতোভম্ভ ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্বশূন্য হলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর অপরাধ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। সে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তিনি পেয়ে গেছেন। বাঙালি হলো একটি বিভক্ত, বিশৃঙ্খল, পরাধীন জাতি। শত শত বছর তারা পরাধীন থাকতে থাকতে পরাধীনতায় তারা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যেমন চোখে ঝাপসা দেখা যায়, তদ্রুপ বাঙালিরা হঠাৎ স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে আলো না দেখে অন্ধকারই দেখেছিল। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসদের মুক্ত ঘোষণা করলে দাস মালিকদের সাথে দাসরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দাসরা ভেবেছিল তারা কিভাবে বাঁচবে, কী করে খাবে, কোথায় ঘর-বাড়ি, টাকা-কড়ি পাবে? একটা পাখিকে দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দি করে রাখা হলে, তাকে এক সময় মুক্ত করে দিলেও সে ঘুরে-ফিরে খাঁচার কাছেই ফিরে আসে। কারণ সে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার আস্থা হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর অনেক বাঙালির মুখেই শোনা যেত এর চেয়ে তো পাকিস্তানই ভালো ছিল। শেখ সাহেব দেশটাকে ভেঙে দিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যদি বাংলাদেশে গণভোট দেওয়া হতো যে, তোমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ চাও, না অখণ্ড পাকিস্তান চাও, তাহলে অধিকাংশ বাঙালি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিত এতে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই তো বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন ১৫ আগস্টকে কেউ নাজাত দিবস পালন করে, কেউ জন্মদিন না হলেও জন্মদিনের উৎসব পালন করে। যারা নিজেদেরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তাদের ভূমিকাও সরব ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা মুখে উচ্চারণ করতে সাহস করেননি যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তাদের সার্টিফিকেট থাকলেও তারা তা পুড়িয়ে ফেলেছেন, ছিঁড়ে ফেলেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, দল ত্যাগ করেছেন, আদর্শ ত্যাগ করেছেন; প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা। উঁচু মাপের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা দিয়েছিল। তবে কাদের সিদ্দিকীর মতো কতিপয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ, বিদ্রোহ করলেও টিকে থাকতে পারেননি, এমনকি দেশেও থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর এ দেশে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এ শব্দগুলো যেন নিষিদ্ধ ও পাপিষ্ঠ হয়ে গেল। চারদিকে ভীতিকর অবস্থা। এ যেন প্রতিক্রিয়াশীলদের সফল প্রতিবিপ্লব।
বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য চীনপন্থি বামপন্থি দল যেমন মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি, আবদুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি (মা-লে), সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং জাসদ কম দায়ী নয়। এরা কৃষক শ্রমিকের রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে দেশে হত্যা-খুন, ডাকাতি, লুট-তরাজ শুরু করে দেয়, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়। দক্ষিণপন্থিদের মতো এরাও ছিল চরম বঙ্গবন্ধু ও ভারতবিরোধী। ভাবটা যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে এবং ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করে মহা অন্যায় করেছে।
বড় দুঃখ লাগে পাশ্চাত্যের আচরণ দেখে। তারা নিজেদেরকে সভ্য, ভব্য, মানবিক বলে দাবি করেন। তারা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কথা বলেন। অথচ বেআইনি ও অমানবিক কাজ তারাই করে বেড়ান। তারা মুখে আইনের শাসনের কথা বলেন, আর পৃথিবীর যতো অপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও খুনি আছে তাদেরকে তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। যতো বড় অপরাধীই হোক তাদের কাছে একবার পৌঁছতে পারলে তার যেন সাত খুন মাফ। তারা বলেন তাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই। এ অজুহাতে কি তারা খুনিদের আশ্রয় দিতে পারে? তাদের দেশে যে আইন আছে সে আইনেও তো তাকে বিচার করে না। তখন বলবে- এক দেশের অপরাধীকে অন্য দেশের আইন দিয়ে বিচার করা যায় না। অপরাধীকে তারা নিজেরা বিচার করবে না, অপরাধীকে তার নিজের দেশে পাঠিয়ে বিচারের সম্মুখীন করবে না, তাহলে আইনের শাসন কীভাবে হবে?
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শিশু ও নারীদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। এতো বড় হত্যাকাণ্ডে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চুপ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করতে জারি করা হলো ইনডেমনিটি এ্যাক্ট তাতেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চুপ। জেলখানা হলো সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। সেই জেলখানায় ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান) কে হত্যা করা হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তখনও চুপ। ৭ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চুপ। ৭৫ পরবর্তী সেনাশাসনে শত শত সেনাসদস্য ও অফিসারকে কোর্ট মার্শালের নামে হত্যা করা হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চুপ। ৭১ সালে পাকিস্তানিরা ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সেখানেও চুপ। যখন যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পাকিস্তানি এদেশীয় দোসরদের বিচারের আওতায় আনা হলো তখন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ঘুম থেকে জেগে উঠে সোরসার লাগিয়ে দেয়।
১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ‘Bangladesh Execution : A Discrepancy’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। এতে তথ্য দেয়া হয় যে, আগের বছরের ২ অক্টোবর এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঘটনায় ২১৭ জনের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আলফ-ই- বার্গেসেন এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে একটি গোপন বার্তা পাঠান। কিন্তু পররাষ্ট্র দফতরের সূত্র এটি মিডিয়ায় ফাঁস করে দেয়। এ বার্তা থেকে জানা যায়, যে ২১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার মধ্যে প্রায় ৩০-৩৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পূর্বেই। এই গণপ্রাণদণ্ডের চার মাস পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন ‘Human Rights Watch’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। ১৯৭৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘বাংলাদেশ টাইমস’ পত্রিকায় শিরোনাম দিয়ে মানবাধিকারের এ তথ্য প্রকাশ করে। মানবাধিকার হচ্ছে পশ্চিমাদের কাছে একটি অস্ত্র। যাকে দেখতে নারি তার বিরুদ্ধে তারা এটা প্রয়োগ করে থাকে।
পশ্চিমারা নিজ দেশে আইন করে মৃত্যুদণ্ড রহিত করে, আবার তারাই পরদেশে হত্যাকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটায়। যে সমস্ত শাসক তাদের আজ্ঞাবহ হবে না, তাদের স্বার্থে কাজ করবে না এ রকম জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক শাসককে উৎখাত করতে, হত্যা করতে বা করাতে, হত্যার প্ররোচনা দিতে তারা কুন্ঠাবোধ করেনি। চিলির আলেন্দে, ঘানার ড. কাউয়ামে নক্রুমা, গুয়াতেমালার জ্যাকোবা অরবেঞ্জ, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুলুম্বা, নাইজেরিয়ার আবু বকর তাওয়াফা বলেওয়া, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি প্রমুখকে তারা হত্যা করতে এবং করাতে বা উৎখাত করতে দ্বিধা করেনি। কারণ তাঁরা ছিলেন বাম ঘরানার শাসক। আমেরিকা বহু চেষ্টা করে শুধু কিউবার ফিডেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে পারেনি।
বাংলাদেশ তথা ভারতে মৃত্যুদণ্ডের আইন করে বৃটিশরা। সে আইনকে ব্যবহার করে তারা এ দেশের হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। অথচ আজ তারা ফাঁসির বিরুদ্ধে কথা বলছে। কানাডা, আমেরিকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের দেশের কোনো অপরাধীকে আমাদের দেশের মতো কোনো দেশ আশ্রয় দিলে কি সে দেশের কোনো উপায় থাকত? তারা সন্ত্রাসের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করত, বোম্বিং শুরু করে দিত। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে, আবার সুইস ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ব্যাংক খুলে দুর্নীতিবাজদের টাকা-পয়সা জমা রাখছে, তাদের অর্থ-বিত্তের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তারা সন্ত্রাস দমনের কথা বলে। আবার সন্ত্রাসীদের মদদ তারাই দেয়। তারাই তালেবান, আল-কায়দা, আইএস তৈরি করে। তারাই প্রতিবিপ্লবী সৃষ্টি করে এবং যাকে দেখতে নারি তার বিরুদ্ধে তারা তাদের ব্যবহার করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা তার ব্যতিক্রম নয়। তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যদি হয় বিপ্লব, তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হচ্ছে প্রতিবিপ্লব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।
দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।