স্মরণ

আছো তুমি লক্ষ কোটির অন্তরে

আবেদ খান প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২২, ১২:৫১ পিএম আছো তুমি লক্ষ কোটির অন্তরে

নিরপরাধ ও কুসুমকোমল শিশুরা যখন নৃশংসতার শিকার হয়, তখন আসলে আক্রান্ত হয় পুরো মানবতাই। আমি যখনই বনানী কবরস্থানে যাই, তখন একটি কবরের পাশে গিয়ে নীরবে দাঁড়াই। ছোট্ট রাসেলের কবর। ৪৭ বছর আগে হত্যা করা হয়েছিল সেই শিশুটিকে। হত্যা করা হয়েছিল আমাদের মানবিক সত্তাকে। ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল নিষ্ঠুর রাতে হায়েনার দল বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলেসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হত্যা করেছিল। তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাকি সবার কবর বনানী কবরস্থানে। এই কবরগুলোর সামনে দাঁড়ালে বাঙালি হিসেবে আমার মনে এক নিদারুণ অপরাধবোধ জেগে ওঠে। এই কবরগুলো, বিশেষ করে একটি ছোট্ট কবরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ। কবরের নীরবতা ছাপিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি! কার সামনে দাঁড়িয়ে আছি! এখানে শুয়ে আছে স্বপ্নজাগানিয়া অপূর্ব মানসলোকের একটি শিশু—শেখ রাসেল!

এখানে দাঁড়িয়ে ধ্যানস্থ হয়ে যাই আমি! ডুবে যাই গভীর বোধে! আমার মাথা যেন ঝিমঝিম করে। আমাকে নিভৃতে তাড়া করে বেড়ায় এক বিবশকরা ‘বোধ’ সেটা জীবনানন্দ দাশের মতো করে বলতে চাই—‘আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়,/ কোন এক বোধ কাজ করে! ... আমি তারে পারি না এড়াতে,/সে আমার হাত রাখে হাতে;/ সব কাজ তুচ্ছ হয়, —পণ্ড মনে হয়।’ আমার মাথার ভেতরেও কোনো এক বোধ তোলপাড় করে। সব কাজ আমার তুচ্ছ মনে হয়, বৃথা মনে হয়। আমার স্নায়ুর সরোবরে যেন ঝড় ওঠে, যখন ভাবি—পৃথিবীর অন্যতম নান্দনিক অপূর্ব সুন্দর অপাপবিদ্ধ একটি ছোট্ট শিশুকেও খুন করতে দ্বিধা করেনি বাঙালি জাতির মনুষ্য নামধারী হিংস্র শ্বাপদের দল।

৪২ বছর আগে ৬ সেপ্টেম্বর আমার প্রথম সন্তানকে আমি নিজের হাতে আজিমপুর কবরস্থানে রেখে এসেছিলাম। অকালে হারিয়ে যাওয়া সেই সদ্যোজাত শিশুটির জন্য এখনো আমার অবচেতন মনে এক দুর্মর হাহাকার গুমরে মরে। আমার সন্তানের কবরের কাছে এলে জগতের অকালপ্রয়াত সকল শিশুর জন্য আমি সন্তানহারা শোকে বিষণ্ন হই। জগতের সকল শিশুর কোমলতা আমার বুকের মধ্যে এক অব্যক্ত কাতরতা ছটফট করে। যখন আত্মজের কবরের কাছে যাই, তখন আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। সেখানে একটি চিহ্ন ছিল, একটি গাছ ছিল, সেসব কিছুই এখন নেই। আমার ছোট্ট সন্তানটির বাহ্যত কোথাও কোনো চিহ্ন নেই; এখন কেবল সময়ের চিহ্ন ধরে, ক্যালেন্ডারের তারিখ ধরে সে এসে প্রতিমুহূর্তে ইচ্ছে হয়ে থাকে মনের ভেতরে। আমার সেই সন্তানের সঙ্গে সেখানে হয়তো অকালে ঝরে যাওয়া আরও শত শত শিশু ঘুমিয়ে আছে। এ জন্য কবরের কাছে গেলে জগতের সকল শিশু এসে যেন আমার ওপর ভর করে। আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। অন্য এক বোধ, বিহ্বলতা আমার সত্তার গভীরে বাসা বাঁধে। ভেতরের এ রক্তক্ষরণ কোনো শব্দবাক্য দিয়ে বোঝা যায় না, বোঝানোও যায় না। পারিজাতের কুসুমকলি এ জগতের প্রতিটি শিশু। সুকুমার রায় যেমনটি লিখেছেন : ‘কবি বলেন, শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি,/উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি।/হাসিতে তার চাঁদের আলো, পাখির কলকল,/অশ্রুকণা ফুলের দলে শিশির ঢলঢল।’ কবির মতো আমিও উপলব্ধি করি : ‘শিশুর প্রাণে চঞ্চলতা আমার অশ্রুহাসি,/আমার মাঝে লুকিয়েছিল এই আনন্দরাশি।’

আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই আনন্দরাশি তখনই গভীর বিষাদে পরিণত হয়, যখন কোনো শিশুর অকালপ্রয়াণ ঘটে। আর কোনো শিশু যদি এ জগতের নৃশংসতার শিকার হয়, তখন নিজেকে মানুষ বলে ভাবতে ঘৃণা লাগে, নিজেকে পিতা বলে ভাবতে লজ্জা লাগে। সিরিয়ার ছোট্ট আয়লান কুর্দি যখন তুরস্কের উপকূলের বালুকাবেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, তখন মনে হয় আমিই যেন মানবতার ফসিল হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। ছোট্ট আয়লানের মৃতদেহের ছবিটি যারাই দেখেছেন, তাদের চোখই আর্দ্র হয়ে উঠেছিল। আয়লানের বাবা আবদুল্লাহ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে গভীর রাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ত্যাগ করেছিলেন। সেই অন্তিম সমুদ্রযাত্রার একপর্যায়ে পনেরো ফুটের দৈত্য ঢেউয়ে ভেসে চলে যায় ছোট্ট আয়লান। আমরা দেখেছি যে কোনো দেশের অস্থির সময়ে সবচেয়ে আগে আক্রান্ত হয় নারী ও শিশুরা। এ জন্য শতবর্ষ আগে মার্কিন রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ এইচ ওয়ারেন জনসন বলেছেন, ‘দ্য ফার্স্ট ক্যাজুয়ালিটি হোয়েন ওয়ার কামস ইজ ট্রুথ।’ যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে সবচেয়ে আগে আঘাতপ্রাপ্ত হয় ‘সত্য’।

''ছোট্ট রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য মিনতি করছিল আর রক্তপিপাসুরা যেন হায়েনার ক্রুর হাসি হেসে বলেছিল যে রাসেলকে তারা মায়ের কাছেই নিয়ে যাবে। অজানা আশঙ্কায় রাসেল যেন মায়ের আঁচল খুঁজে পেতে চাইছিল, যেখানে গেলে পৃথিবীর আর কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু রাসেল জানে না, সেই আঁচলও তখন রক্তের সাগরে ডুবে যাচ্ছে...।''

কেমন ছিল সেই ছোট্ট শিশুটি? কী ঘটেছিল সেদিন? আমার বন্ধু-সুহৃদ চিকিৎসক বরেন চক্রবর্তীর ইংরেজি কবিতার বই ‘আ ন্যাশন কনফিসেস’ থেকে ‘দ্য বয় হু ওয়াজ কিল্ড ইয়েসটারডে নাইট’ শিরোনামের কবিতাটির বঙ্গানুবাদ (তাপস কুমার দত্ত অনূদিত) সেদিন হঠাৎ আমার নজরে পড়ে। কবিতাটি পড়তে পড়তে সজল হয়ে ওঠে আমার চোখ। বরেন লিখেছেন : ‘সেদিন দিবাকর অস্তাচলে যাবার সাথে সাথে/দীর্ঘ ছুরির মতো ধারালো একটি রাত জেঁকে বসছিল।/মৃদুমন্দ শান্ত সমাহিত বাতাস হঠাৎই যেন হিমশীতল হয়ে উঠল।/অমানিশার শামিয়ানা জেঁকে বসল চরাচরজুড়ে। ... বত্রিশ নম্বর রোডে এসে নেকড়েরা জড়ো হতে থাকে। /ভ্যাম্পায়াররা ছুটতে থাকে পবিত্র রক্তের সন্ধানে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে।/তারা নিচে একটি ছোট ছেলে খুঁজে পায়,/কী বুঝেছিল ঐ অপূর্ব অমল ছেলেটি এক বিবশকরা ভয়ে কাঁপছিল সে। কান্না করছিল আর আকুল হয়ে উঠেছিল মায়ের কাছে যেতে।’

আহা! দশ বছরের ছোট্ট একটি ছেলে, যার কোনো অপরাধ থাকতে পারে না, পাপ থাকতে পারে না, যে কিনা কিছু মানুষরূপী হিংস্র দানবদের দেখে কাঁপছে। এটা কি শুধু ছোট্ট রাসেলের ভয়? এই ভয় তো পুরো বাংলাদেশের! এই ভয় তো পুরো মানবজাতির! এই ভয় মানবতার! ছোট্ট রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য মিনতি করছিল আর রক্তপিপাসুরা যেন হায়েনার ক্রুর হাসি হেসে বলেছিল যে রাসেলকে তারা মায়ের কাছেই নিয়ে যাবে। অজানা আশঙ্কায় রাসেল যেন মায়ের আঁচল খুঁজে পেতে চাইছিল, যেখানে গেলে পৃথিবীর আর কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু রাসেল জানে না, সেই আঁচলও তখন রক্তের সাগরে ডুবে যাচ্ছে...।

বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধু তার নাম ‘রাসেল’ রেখেছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে ভালোবেসে। বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’। রাসেল চেয়েছিলেন, এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করতে হবে। বার্ট্রান্ড রাসেলের এ যুদ্ধবিরোধী শান্তিময় আদর্শের মানসচেতনা বঙ্গবন্ধুও তাঁর কনিষ্ঠপুত্রের মানসে প্রোথিত করতে চেয়েছিলেন। রাসেলরাই তো এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযুক্ত করবে। পরাজিত করবে মানবতাবিরোধী হায়েনাদের। ছোট্ট থেকেই রাসেল পরিবারের সবার অতি আদরের নয়নের মণি হয়ে বেড়ে উঠছিল। একটু একটু করে বড় হতে হতে সে বুঝতে পেরেছিল, জেলখানাই যেন তার পিতার সঙ্গে দেখা করার একমাত্র জায়গা। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেলগেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে রাসেলের প্রতি অপত্য স্নেহ আর পিতাকে ছেড়ে যাওয়ার অব্যক্ত কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তাঁর বাবাকে রেখে আসবে না। ছোট্ট আদুরে সন্তানটিও পিতার সান্নিধ্য চায়। আকুলভাবে চায়। অবুঝ সে। কেন সে পিতাকে রেখে একা বাড়ি ফিরবে? এসব বুঝে মন খারাপ থাকত বঙ্গবন্ধুর। ‘কারাগারের রোজনামচা’র আরেক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”

রাসেল তার ছোট্ট জীবনে কী না দেখেছে! বাবার বারবার কারাবাস আর একাত্তরের ভয়াল নয়টি মাস। পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্য ওঠার পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাপান সফর করেন, সেদিন ছিল রাসেলের নবম জন্মদিন। জাতির পিতার সঙ্গে রাসেলও জাপানে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের একটি ভিডিও ক্লিপে আমরা দেখেছি, কী অপূর্ব উচ্ছল প্রাণবন্ত ছিল রাসেল! বাবা আর রেহেনা-আপুর মাঝখানে রাসেল যেন পুরো সফরের মধ্যমণি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞের মধ্যে রাসেলও সম্ভ্রমের সঙ্গে সসম্মানে মিষ্টি হাসিতে করমর্দন করছিল বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে। ছোট্ট আঙুলের চপলতায় নিজের সুটের বোতাম লাগিয়ে নিচ্ছিল নিজে নিজেই। ছোট্ট প্রিন্স যেন চলনে-বলনে আচরণে-আবেগে-ভালোবাসায় বিশ্বপাঠশালা থেকে ক্রমশ অপূর্ব পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছিল।

রাসেলের ছোট্ট একটি সাইকেল ছিল। দুরন্ত রাসেল বিকেল হলেই ধানমন্ডির ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বর দিয়ে সাইকেল নিয়ে সাঁই-সাঁই করে চলত। চলতে চলতে পড়েও যেত, যেন কিছুই হয়নি এমনই আত্মবিশ্বাসে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার সাইকেল নিয়ে মিলিয়ে যেত লেকপাড়ে। লেকের পূর্বপাড়ে চক্কর মেরে মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্ব প্রান্তের সাদা একটি বাড়ি পর্যন্ত ছিল তার সাইক্লিংয়ের চৌহদ্দি। ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্নেহময়ী মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন তাঁর চোখের সীমানার বাইরে না যায়।

রাসেল তো রাসেল নয়, যেন আমাদের স্বাভাবিক শৈশবের প্রতিভূ। অসীম সম্ভাবনাময় স্বাভাবিক মানবশিশুর প্রতিভূ। এমন শিশুকে কী করে হত্যা করা সম্ভব? বরেন চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘রাতের গভীরে তার আর্তনাদ আর কান্নায় বিদীর্ণ হলো চরাচর!/আহা! অমন মায়াভরা মুখ দেখেও কি কোনো মানুষ নৃশংস হতে পারে?/কিন্তু ভ্যাম্পায়ারদের তো কেবল রক্ত চাই—/হায়েনা নেকড়ে পিশাচের দল কী করে বুঝবে মানবশিশুর কোমলতা!/ বৃথা যায় তার আকুতি, কান্না, আর্তনাদ। /সহসা শত শত বুলেট বাতাসে শিস কেটে বিদ্ধ করে/ অপাপবিদ্ধ শিশুর কোমল শরীরটিকে। /ফিনকি দিয়ে বের হতে থাকে রক্তস্রোত, ছুটে চলে নদীর মতো!/ যেন মিশে যায় ধানমন্ডির হ্রদের জলের স্রোতে...।’

এই সেই হ্রদ যার পাশ দিয়ে স্বপ্নচারীর মতো হেঁটে-চলে বেড়াত রাসেল। তাকে শেষ জীবিত দেখা গিয়েছিল এই হ্রদের ধারেই, চোদ্দ আগস্ট সন্ধ্যায়। তার পর আর সে নেই! হ্রদের পানি আগের মতোই বয়ে যায়, চারপাশের গাছগাছালি আগের মতোই দোল খায় বাতাসে, পাতা ঝরে পড়ে হ্রদের জলে আর ভেসে যায় নৌকার মতো করে। সবই আছে আগের মতো, নেই শুধু সেই ছোট্ট ছেলেটি! চোদ্দই আগস্ট সন্ধ্যায়ও সে ছিল অপূর্ব প্রাণশক্তিতে ভরপুর! কিন্তু ১৫ আগস্টের ভোর কত নির্মম! কেড়ে নিল তাকে। দশ বছরের একটি ছেলে! কী পাপ করেছিল সে?

আসলে হায়েনাদের কাছে তার পাপ ছিল তার পিতার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অপরাধ ছিল, সে ছিল বাংলাদেশের স্থপতির আদরের সন্তান। এই দেশ স্বাধীন করা, একটি জাতি গঠন করা, একটি পরাধীন জাতিকে মুক্তির সোপানতলে নিয়ে আসাই ছিল ঘাতকদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অপরাধ।

আমরা বাঙালি জাতি মাকড়সার বাচ্চাদের মতো হত্যা করলাম জন্মদাতাকে। তারপর জারি করলাম ইনডেমনিটি! রুদ্ধ করলাম বিচারের পথ! যেসব মানবতার ধ্বজাধারী দেশগুলো মানবতার কথা বলতে বলতে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলে, তারাও কী নির্মমভাবে চুপ ছিল বছরের পর বছর। ইনডেমনিটি তো কেবল ঘাতকরা জারি করেনি, ইনডেমনিটি তো আমাদের ভেতরেও প্রোথিত।

রাসেল আমাকে নিদারুণভাবে অপরাধী করে। অসহ্য এই আত্মদহন, অসহ্য এই মনোবেদনা। বরেন যেমন লিখেন : রাসেলকে হত্যা করার এই পাপ এই অপরাধ এই হত্যা এই ধ্বংস এই নৃশংসতা এই কলঙ্ক কোনোদিন আমাদের ললাট থেকে মুছবে না কখনো। এ এক অনপনেয় কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণার ক্ষমাহীন ইতিহাস।

এ জন্য বনানীতে যখনই রাসেলের কবরের সামনে দাঁড়াই, আমি দীর্ণ হই এক অলঙ্ঘনীয় অপরাধবোধে। বাঙালি হিসেবে লজ্জা পাই, মানুষ হিসেবে নিজেকে ধিক্কার দিই। হত্যা তো শুধু পিতা-মাতা-ভ্রাতা-সন্তানদের করা হয়নি, ধ্বংস করা হয়েছে আমাদের আদর্শ আস্থা ভরসাকে। হত্যা করা হয়েছে আমাদের বিশ্বাস চেতনা ভালোবাসাকে। ইতিহাসের জঘন্য নৃশংস ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের পরও যারা চুপ ছিল বছরের পর বছর, যারা নিজের মনের চারাপাশে গেঁথে দিয়েছিল ইনডেমনিটির দেয়াল, আমরা তো সে-ই বাঙালি! আমাদের ললাটে রাসেল দেখতে পায় সেই ইনডেমনিটির কলঙ্করেখা! যেই হায়েনাদের জন্য রাসেলকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, গর্তের ভেতরে থেকেই সর্বশক্তি দিয়ে এখনো ঘোঁট পাকাচ্ছে তারা, অপেক্ষায় আছে নতুন কালরাত সৃষ্টির। আর সব জেনেও, সব বুঝেও কী করছি আমরা?

রাসেল যেন বলতে চায় এই দেশকে মানুষের বসবাস উপযুক্ত করতে, মানবতাবিরোধী হায়েনাদের পরাজিত করতে আমরা যেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাই। রাসেলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সংশপ্তকের মতো সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অমোঘ বাণী শুনতে পাই আমি। আমরা যেন এ বাণী না ভুলি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতা থেকে ধার করে দ্ব্যর্থহীন চিত্তে বলতে চাই : যে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে। আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।

 

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক কালবেলা।