• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০১৯, ০৪:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১২, ২০১৯, ০৪:২৪ পিএম

ডিসেম্বরের স্মৃতি

ডিসেম্বরের স্মৃতি

ডিসেম্বর মাসটা অন্যরকম। কখনই হয়নি যে ডিসেম্বর মাস এসেছে আর একাত্তরের সেই বিস্ময়কর জাদুকরী দিনগুলোর কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ওঠেনি। মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমরা কী অসাধারণ সৌভাগ্যবান  একটি প্রজন্ম, আমরা এবং শুধু আমরা ডিসেম্বর মাসের সেই বিজয় দিবসের অবিশ্বাস্য আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। মাঝে মাঝেই কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন কোন্টি? শুধু দিনটি নয় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তটি পর্যন্ত বলে দিতে পারি। ষোলোই ডিসেম্বর যখন আমি প্রথম প্রকাশ্যে জয় বাংলা শ্লোগানটি উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত।

সেই অবিশ্বাস্য আনন্দময় মুহূর্তের পর আমরা যখন একে অন্যের দিকে তাকিয়েছিলাম তখন আমাদের সবার চোখে ছিল অশ্রু। আনন্দের অশ্রু নয়, গভীর বেদনার অশ্রু। কারণ একাত্তরের সেই বাংলাদেশে আমরা সবাই আমাদের কোন না কোন আপনজনকে হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ ছিল গভীর আত্মত্যাগ, অবিশ্বাস্য বীরত্ব এবং বিশাল একটি অর্জন। কিন্তু সবার ওপরে সেটি ছিল আমাদের সবার নাড়িছেঁড়া ক্রন্দনের ইতিহাস। এই দেশের মাটির মতো পৃথিবীর আর কোন দেশ তাদের বক্ষে এত বেদনা ধারণ করেছে কি না আমি জানি না।
একাত্তর দেখেছে সে রকম মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব দ্রুত কমে আসছে। আর কয়েক বছর পর সে রকম মানুষের সংখ্যা হবে একেবারে হাতেগোনা কয়েকজন। এই দেশের নতুন প্রজন্ম তখন আর কারও কাছ থেকে সেই ইতিহাসটুকু কারও কণ্ঠে নিজের কানে শুনতে পাবে না। তখন তারা কী কখনও কল্পনা করতে পারবে এই দেশের মানুষ পাকিস্তানী মিলিটারি এবং তাদের পদলেহী রাজাকার-আলবদরের হাতে কী অবিশ্বাস্য  নৃশংসতার ভেতর দিয়ে গিয়েছে?

আমার মনে আছে আমার একজন আমেরিকান বন্ধু সত্তরের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে এসেছিল। এখানে বেশ কিছুদিন থেকে সে আবার আমেরিকায় ফিরে আমাকে একটা বিস্ময়কর কথা বলেছিল। সে বলেছিল, তোমাদের দেশের গণহত্যাটি এত ভয়ঙ্কর, এত নৃশংস এবং এত অবিশ্বাস্য যে বেশ কয়েক বছর পর সেটি আর কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি কিন্তু নব্বইয়ের  দশকে ফিরে এসে দেখি এই দেশেই যুদ্ধাপরাধীর দলটি সগর্বে বসবাস করছে। বাইরের পৃথিবী নয়, আমার দেশেই যুদ্ধাপরাধীর দল ‘একাত্তরে কোন ভুল করিনি’ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে অঙ্গীকার করে এই দেশে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না এই সহজ সত্যটিকেও আমরা এখনও পুরোপুরি কার্যকরী করতে পারিনি। আমার মাঝে মাঝে জানার ইচ্ছা করে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধটি কি শুধু কিছু তথ্য, কিছু ইতিহাস নাকি তারা সেটি হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে পেরেছে? যদি না পেরে থাকে সেটি হবে আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা।

২.
ডিসেম্বর মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধটি দর্শক হিসেবে আমাদের অনেকের নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণার পর গভীর রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এন্টি এয়ার ক্রাফট গান দিয়ে আকাশে গুলি করছে, আমরা সবাই আকাশে সেই গুলির নকশা দেখছি। পৃথিবীর যে কোন দেশে যখন বিমান আক্রমণ হয় তখন সাইরেনের তীব্র শব্দে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত হয়। সব মানুষ তখন প্রাণ রক্ষা করার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে থাকে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাইরেন শুনে কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যায়নি। এক ধরনের উল্লাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। শুধু তাই নয় দিনের আলো ফোটার পর ঢাকা শহরের বিল্ডিংয়ের ছাদে মানুষ আর মানুষ! সাইরেনের শব্দ শুনে কেউ পালিয়ে যাচ্ছে না ছাদে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ বিমানের ডগ ফাইট দেখছে! পৃথিবীর কতজন মানুষ সত্যিকার যুদ্ধের সময় আক্রান্ত শহরের ছাদে দাঁড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করতে করতে যুদ্ধ বিমানকে আক্রমণ প্রতি আক্রমণ করতে দেখেছে। যুদ্ধ বিমানকে ধ্বংস হতে দেখেছে? পাইলটদের প্যারাস্যুটে নামতে দেখেছে? এ রকম বিচিত্র যুদ্ধ নিশ্চয়ই পৃথিবীর খুব বেশি জায়গায় হয়নি!

একেবারে প্রথম কয়েকদিনের ভেতর বাংলাদেশের পুরো আকাশ মিত্র বাহিনীর দখলে চলে আসার পর শুরু হয়েছিল আরও বিচিত্র একটি যুদ্ধ। সেটি হচ্ছে বেতার তরঙ্গের যুদ্ধ। রেডিওতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য একটি এবং শুধু একটি বার্তা! সেই বার্তাটি হচ্ছে : ‘হাতিয়ার ডাল দো’ বাংলায় নিশ্চয়ই তার অর্থ ‘অস্ত্র সমর্পণ করো’ কিংবা সোজা কথায় ‘আত্মসমর্পণ করো’। একটি কথা কতবার কতভাবে উচ্চারণ করা যায় আমরা তার নমুনা দেখেছিলাম।

আমাদের কাছে সেটি ছিল প্রায় কৌতুকের মতো কিন্তু খাঁচায় আটকে  থাকা ইঁদুরের মতো পাকিস্তান বাহিনীর কাছে সেই বার্তাটি ছিল নিশ্চয়ই এক ভয়ঙ্কর বার্তা, সেগুলো নিশ্চিতভাবে তাদের নার্ভের দফা রফা করে ফেলেছিল।শুধু যে রেডিওতে আত্মসমর্পণ করার কথা বলেছিল তা নয় আকাশ থেকে ক্রমগত লিফলেট ফেলা হচ্ছিল। সেই লিফলেটে নানা ধরনের বার্তা, তবে যে লিফলেটটি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ডে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল তার ভাষাটি ছিল এ রকম : আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর, তা না হলে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের ধরে ফেলবে। পাকিস্তান বাহিনীর কাছে এর চাইতে রক্তশীতল করা বার্তা আর কী হতে পারে?

যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে যাত্রাবাড়ীতে একটা পরিবারের সঙ্গে ছিলাম, সেই পরিবারে অনেকগুলো শিশু বাচ্চা। যখন যুদ্ধ পুরো মাত্রায় চলছে তখন একেবারে কানের কাছে গোলাগুলির শব্দ, শেলিংয়ের শব্দ। বাইরে কার্ফু কোথাও যাবার উপায় নেই। তখন বাসার সামনে একটি ট্রেঞ্চ কাটা। হলো যখন শেলিংয়ের শব্দ অসহ্য মনে হয় তখন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ট্রেঞ্চে বসে থাকি।দিনের বেলা দেখতে পাই সারি সারি কনভয়, ট্যাঙ্কের বহর যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। সৈনিকরা রাস্তার দুই পাশে লাইট পোস্টের আড়ালে মেশিনগান বসিয়ে সামনা সামনি যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাসায় বসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়।

তারপর ষোলোই ডিসেম্বর একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পেলাম। সেনাবাহিনী, তাদের কনভয়, তাদের ট্যাঙ্ক নিয়ে ফিরে আসছে। কাউকে বলে দিতে হয়নি তাদের মাথা নিচু করে হেঁটে যেতে দেখেই আমরা বুঝে গিয়েছি তারা এখন পরাজিত, নিঃশেষিত। তখন আমি একটি করুণ দৃশ্য দেখেছিলাম সেই  দৃশ্য কখনও ভুলতে  পারব না। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাচ্ছে অসংখ্য বিহারী পরিবার। ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত পুরুষ, রঙিন কাপড় পরা মহিলা, বিভ্রান্ত কিশোর এবং ভীত  আতঙ্কিত শিশু। তাদের জীবনে যে অমানিশা নেমে এসেছিল তারা কী কখনও সেখানে থেকে বের হতে পেরেছিল? পৃথিবীর যুদ্ধ থেকে বড় নিষ্ঠুরতা কী আর কিছু আছে।
৩.
ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ ভোরবেলা আমি একা একা ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। মানুষের আনন্দের এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত বহির্প্রকাশ আর কখনও দেখা যাবে কিনা আমি জানি না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের আনন্দ উল্লাস। মুক্তিবাহিনী, স্বাধীন বাংলার পতাকা এবং জয় বাংলা শ্লোগান।হেঁটে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই চোখ সরিয়ে নিতে হয়েছিল। পথে-ঘাটে এখানে-সেখানে মানুষের মৃতদেহ। কিছু পাকিস্তানী সেবাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড কিছু সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া। রাজাকার-আলবদর কিংবা বিহারীদের ওপর নেয়া প্রতিশোধ। একাত্তরে এই দেশের মানুষ যেভাবে মৃতদেহ দেখে অভ্যস্ত হয়েছিল আর কিছুতে সে রকম অভ্যস্ত হয়েছিল কি  না তা আমার জানা নেই।

হেঁটে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে দেখি একটা খবরের কাগজ বিক্রি হচ্ছে। দেশ মুক্ত হওয়ার পর প্রথম পত্রিকা। দুই পৃষ্ঠার পত্রিকা কিন্তু সেটা খুলেই মনটা ভার হয়ে গেল। সেখানে আমি প্রথম জানতে পারলাম বিজয়ের শেষ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর বদর বাহিনী এই দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গেছে। বধ্যভূমিতে তাদের অনেকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, অনেকে এখনও নিখোঁজ।তখনও আমরা জানতাম না তাদের কেউ আর বেঁচে ফিরে আসবে না।

বিজয়ের ঠিক আগের মুহূর্তে প্রতিহিংসার এ রকম ভয়ঙ্কর রূপ কি কেউ কখনও চিন্তা করতে পারে?আমার মাঝে মাঝেই ভাবনা হয়, আমাদের নতুন প্রজন্মকে কী আমরা জানিয়ে যেতে পেরেছি কত মূল্য দিয়ে আমরা এই স্বাধীনতাকে কিনেছি?


লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক