• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২০, ০৯:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১, ১২:৫৭ পিএম

স্মরণ

অনুসরণীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী

অনুসরণীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী

রাশিয়াতে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম সবল প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমার্ধে।  সেই ধারা আরও জোরালো হয়েছিল নারোদানিকদের মাধ্যমে।  আর বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বলশেভিক বিপ্লবীদের নেতৃত্বে প্রবল সংগ্রাম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।  আবার চীনে আফিম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সূচনা হয়।  সেই ধারায় ১৯১৯ সালের ৪মে জাপানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শহীদী আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে চীনের জনগণ সংগঠিত হয়। 

এরপর দুনিয়া কাঁপানো লং মার্চ এবং জাপ বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সিড়ি বেয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর।  হোসে মার্তি এবং সাইমন বলিভারের পথ ধরে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি স্বৈরাচারি বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কিউবান বিপ্লব সম্পন্ন হয় ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারার নেতৃত্বে।  বাংলাদেশেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের মতো অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ; সিপাহী বিদ্রোহ এবং ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদার, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজসহ অসংখ্য বিপ্লবীর আত্মদানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সরাতে পারলেও নতুন করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতায় আবদ্ধ হই। 

এরপর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা লাভ করি।  কিন্তু এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হয়নি।  এতক্ষণ ধারাবাহিক সংগ্রামের এত বড় গৌরিচন্দ্রিকা লেখার মূল কারণ হলো গত ১০ ডিসেম্বর সদ্যপ্রয়াত হওয়া আমার বাবা কমরেড আজিজুর রহমান মনে করতেন এরকম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আত্মত্যাগ এবং লড়াইয়ের ধারা বেয়েই শোষণমুক্তির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।  প্রকৃতই, স্বর্গের আগুন মানবজাতির জন্য চুরি করে প্রমিথিউস যে বিদ্রোহের বীজ বপণ করেছিলেন এবং স্পাটাকার্সের দাস বিদ্রোহ যে শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহের সূচনা ঘটিয়েছিল, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে সেই ধারাকে যারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন আমার বাবা ছিলেন তাদেরই একজন উত্তরাধিকার।

আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান

আজিজুর রহমানের জন্ম ১৯৪৪ সালে এখনকার ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে।  তখনকার অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মতারিখ মনে রাখার তেমন একটা প্রচলন ছিল না বলে বাবার জন্মতারিখটা কখনোই জানা যায়নি।  আজিজুর রহমানের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ জাহাজের একজন সাধারণ নাবিক।  বিভিন্ন সমুদ্র এবং মহাসমুদ্রে বছরের পর বছর কাঁটানোর ফলে তার সান্নিধ্য বাবা শৈশবে তেমন একটা পাননি।  মূলত মায়ের উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় তার শিক্ষাজীবনের শুরু।  তার মা প্রয়োজনে কেরোসিনের কূপি জ্বালানোর জন্য অন্য বাড়ী থেকে কেরোসিন ধার করে আনতেন এবং বাবা সেই আলোয় পড়াশোনা করে ওই গ্রামের জুগিভরাট প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন।  তখনকার সময়ে তার গ্রামসহ আশেপাশের অনেক গ্রামের মধ্যে তিনিই প্রথম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেছিলেন।  এরপর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া উন্মত্ত মধুমতি নদীর ওপার মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার আরএসকেএইচ ইন্সটিটিউশনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পাড়ি জমান খুলনা জেলায়।  খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত হাজী মুহাম্মদ মহসিন স্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি পাশ করেন। 

এরপর খুলনার ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিজ্ঞান শাখার একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে তখন ওই কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ প্রয়াত মুসা আনসারীর সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন।  ঠিক একই সময়ে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির গ্রুপ কমিটির অন্তর্ভূক্ত হন এবং অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন।  ১৯৬৪ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আমার বাবাসহ অনেকেই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে দৌলতপুর অঞ্চলে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।  ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়।  ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ও মতিয়া গ্রুপ নামে পরিচিতি লাভ করে।  তখন বাবাসহ খুলনা জেলার অধিকাংশ নেতা-কর্মীরা এই বিভক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তাদের অনেকেই ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।  ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন(মেনন গ্রুপ)-এর খুলনা জেলা সম্মেলনে আজিজুর রহমান জেলা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  একই বছর তিনি বিপুল ভোটে খুলনা পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। 

১৯৬৮ সালে বাবার শিক্ষাজীবন শেষ হলে তিনি চাকুরীতে না যোগদান করে তৎকালীন পার্টির সার্বক্ষণিক হিসাবে পেশাদার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন।  ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মতাদর্শিক মহাবিতর্কের কারণে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গিয়েছে।  আজিজুর রহমান ক্রশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা ইপিসিপিএমএলের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।  এ সময় তিনি খুলনার বয়রা অঞ্চলে অবস্থানরত তিনটি কড়াই কোম্পানীর মানবেতর জীবনযাপনকারী শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি এবং আট ঘন্টা শ্রম সময়ের দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আন্দোলন চলাকালে গ্রেপ্তার হন।  এই সময় থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি কারা অন্তরীণ থাকেন। 

১৯৭১ সালে ইপিসিএমএলের একইসঙ্গে দুই শত্রুর মোকাবিলার ভ্রান্ত লাইন গোটা পার্টিকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।  তখন আজিজুর রহমানরা এই বাম হঠকারী লাইনের পক্ষে থাকলেও কিছুদিন পরেই এর ভ্রান্ততা উপল্বদ্ধি করতে থাকেন।  তিনি ১৯৭৩ সালে এই বেআইনী পার্টির খুলনা জেলা সম্পাদক এবং ১৯৭৫ সালের কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির বিকল্প সদস্য নির্বাচিত হন।  ইতিমধ্যে মাও-সে-তুংয়ের ‘দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের ওপর বাবার নেওয়া পার্টি ক্লাসে আমার মা প্রয়াত সুরাইয়া ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।  ১৯৭৩ সালে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ১৯৭৫ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।  ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক আইনে আমার বাবা গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে খুলনা, যশোর ও রংপুর জেলে কারান্তরীণ থাকেন।  

এই সময়ে বাইরে অবস্থানরত তৎকালীর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) বেশ কয়েকজন নেতা এবং জেলের ভেতর থেকে বাবাসহ আরও কয়েকজন পার্টির বাম হঠকারী লাইন পরিত্যাগ করেন এবং প্রকাশ্য পার্টি গড়ে তোলা ও গণআন্দোলন এবং গণসংঠন গড়ে তোলার লাইন গ্রহণ করেন।  এই সময়ে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তী সময়ে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।  ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি(মেনন-রনো) ঐক্যবদ্ধ হলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৪ সালে এই পার্টির যশোর কংগ্রেসে তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।  বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা আন্ত:পার্টি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। 

২০০৯ সালে এই পার্টির বিলোপবাদী লাইনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সুনির্দ্দিষ্ট মতাদর্শিক পার্থক্যের ভিত্তিতে তিনিসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ওয়ার্কার্স পার্টি পরিত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।  ২০১৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ এবং বাবাদের নেতৃত্বাধীন পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হলে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।  মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।  তিনি সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী হিসাবে সাতক্ষীরা-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্ধিতা করেন।  পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে বিভিন্ন পার্টি কংগ্রেস এবং গণসংগঠনের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। 

তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেছেন।  এই অঞ্চলে ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে ঘেরবিরোধী কৃষক আন্দোলন, জলাবদ্ধতা নিরসনের আন্দোলন এবং ভূমিহীন আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন।  এছাড়া খুলনার ডুমুরিয়া, রূপসাসহ অসংখ্য অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।  তিনি কৃষক-শ্রমিক মেহনতী জনতার জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন।  দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাদের এই কাজের ধারাটি প্রায় বিলুপ্ত।  সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, মনি সিংহ , খোকা রায়, অজয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত সরকার, জ্ঞান চক্রবর্তী, শচীন বসু, অমল সেনসহ অসংখ্য কমরেড রাজনৈতিক লাইনের সীমাবদ্ধতা এবং বিচ্যুতি সত্ত্বেও জনগণের জীবনের সঙ্গে যেভাবে মিশে যেতে পেরেছিলেন, আমার বাবা ছিলেন সেই ধারার প্রকৃত অনুসারী।  তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই ধারাটির এক ধরনের বিলোপ ঘটলেও আগামীতে এদেশে মানবিক সমাজ গঠনের আন্দোলনে তাদের এই ধারা যেমন অনুসরণীয় হতে পারে এবং তাদের জীবন বড় ধরনের শিক্ষাও রাখতে পারে।   

লেখক: সাংবাদিক ও আজিজুর রহমানের একমাত্র সন্তান