• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০২০, ০২:২৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৫:৪৭ পিএম

বিবাহ বিচ্ছেদ

সবকিছুর সমাধান কি বিয়ে?

সবকিছুর সমাধান কি বিয়ে?

বিবাহ বিচ্ছেদের মুল কারণ কী? কৌতুক উত্তর হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারণ মূলত বিয়ে।

সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতায়, বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে করা একটি ফিচার দেখলাম, সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছি। মহামারী করোনাকালে, পারিবারিক কলহ, সহিংসতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিয়ে বিচ্ছেদ।

প্রথম আলোর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ঢাকায় গড়ে দিনে ৩৯ টি তালাক হচ্ছে, এবং চট্টগ্রামে হচ্ছে ১৮ টি তালাক। এবং ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে তালাক হয়েছে ৯২০ টি। তথ্যে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে ৭০ শতাংশ তালাকের আবেদন আসছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে।

বিচ্ছেদের কারণের দিকে তাকালে নারী এবং পুরুষের কারণগুলো ভিন্নভিন্ন। যেমন নারীদের কারণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, যৌতুকের দাবীতে নির্যাতন, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, স্বামীর অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, মাদকাসক্তি। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে, বেশিরভাগ কারণ দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া ও অবাধ্য হওয়া। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, স্ত্রীদের তালাক দেয়ার জন্য, বেশিরভাগ পুরুষদের দাবী করা কারণগুলো অতো গুরুতর না। মানে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, স্বামীদের প্রতি আনত অভিযোগগুলো বেশিরভাগই ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে, বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীর প্রতি আনা অভিযোগ মূলত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বা সন্তান জন্ম না দিতে পারা, যা ফৌজদারি অপরাধ না। যেমন, স্বামীর বদমেজাজের জন্য, কোন স্ত্রীকে সচরাচর তার স্বামীকে তালাক দিতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের স্ত্রীরা বদমেজাজী স্বামীর হাতে শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত, বদমেজাজ সহ্য করেন, এবং সহ্য করে করে বিয়েটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে অনেক পুরুষও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। কিন্তু  সামাজিক চাপে তারাও প্রকাশ করেন না পুরো সত্য, পাছে লোকে তাকে তার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করে!

বিয়ে বিচ্ছেদের কারণগুলো নিয়ে অনেকে মতামত দিলেও, কেউ এখনো এই বিষয়ে আলোচনা করছেন না যে আমাদের সমাজে, কেন সকল কিছুর সমাধান হিসেবে বিয়েকে বেছে নেয়া হয়?

করোনাকালে যেমন বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে, ঠিক তেমনি প্রচুর বিয়ে হয়েছে।

নারীদের নিরাপত্তার জন্য, এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষই মনে করে যে, বিয়ে সবচেয়ে কার্যকরী ও ভালো সমাধান। একটি বিয়ের মাধ্যমে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক ও পারিবারিক চাপে, অনেকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেন, বা সন্তানকে অভিভাবকরা অনেকটা জোর করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে থাকেন।

জীবন সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও, একটা মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে, বিয়েটা যতটুকু না ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘটে, তার চাইতে বেশি ঘটে থাকে পরিবারের সাথে পরিবারের। তাই ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা, কৈশোর থেকে বিয়েকেন্দ্রিক লালিত স্বপ্ন ও কল্পনা এবং পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের নানান চাওয়া পাওয়া সব কিছু মিলিয়ে, বিয়ে এবং বিয়ে সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় একটা বড় রকমের মানসিক চাপ তৈরি করে দম্পতির ওপর।

কৈশোর থেকে অনেকেই মানসিকভাবে বিয়ে সম্পর্কে একটা স্বপ্নজাল বুনে চলেন, একজন আরেকজনের কাছে নানান আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবী নিয়ে চলেন, বাস্তবতার সাথে সেই স্বপ্নের মিল না পেয়ে, আশাহত হন। 

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সবসময়ই নারীর শারীরিক এবং মানসিক প্রয়োজনকে অবহেলা করে এসেছে। যৌনজীবন সম্পর্কে অজ্ঞানতা এবং যৌনজীবনকে গুরুত্ব না দেয়াটাও বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। নারীদের হরমোনাল ইস্যু, মিন্সট্রুয়েশনের সময় চলমান মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বেশিরভাগ পুরুষেরই ধারণা থাকে না। সন্তান জন্ম দেয়ার পর সিংহভাগ নারীই স্বামীর কাছ থেকে যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন তা পান না। সংসারের কাজের ক্ষেত্রে নারীর উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে। সেক্ষেত্রে জেন্ডার শ্রম বিভাজনে চলমান বৈষম্য দাম্পত্য কলহ বাড়িয়ে দেয়।  

বিয়ের বয়স নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ২১ নির্ধারিত, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, শারীরিক বয়সে অনেকে পরিপক্ক হলেও মানসিক বয়সে প্রাপ্তমনস্ক হন না অনেকে। বিয়ে, বিয়ে সম্পর্কিত বাস্তব ধারণা, সম্পর্কের দায় দায়িত্ব ও মূল্যবোধ সম্পর্কে উপলব্ধি আসার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে যান।

আমাদের এই সমাজে বিয়ে করা এবং তা টিকিয়ে রাখার বিষয়টিকে দেখা হয় যোগ্যতা হিসেবে। আর অবিবাহিত থাকা বা বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়াটাকে দেখা হয় অযোগ্যতা হিসেবে। সমাজের চোখে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে চাওয়ার এই দৌঁড়ে অনেকেই বেছে নেন অসুখী জীবন। ব্যক্তি নিজে যদি মানসিকভাবে অসুখী থাকেন, তবে তার পক্ষে অন্যকে সুখে রাখার দায়িত্ব নেয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিবার। বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, এবং নতুন দম্পতিকে মানিয়ে নিতে, সাহায্য করার ক্ষেত্রে, পরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য।

বিয়ে পরবর্তী দাম্পত্য কলহ নিরসনের ক্ষেত্রে যেমন সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলিং প্রয়োজন, তেমনি বিয়ের আগেও প্রি ম্যারিজ কাউন্সেলিং প্রয়োজন। বিয়ে এবং বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, আইনগতভাবে এই প্রি ম্যারিজ ও ম্যারিজ কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি যদি অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ আরো সচেতন ও বিবেচক হবেন।

 

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী