• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২১, ০৯:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৭:৩৯ পিএম

আরেকজন মিজানুর রহমান খান আর আসবে না

আরেকজন মিজানুর রহমান খান আর আসবে না

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপডেট পাচ্ছিলাম বেশ কদিন ধরেই। তবে আরো অনেক করোনা রোগীর মতই ভাবছিলাম সেরে উঠবেন। সোমবার বিকেল ৫টায় তার ছোট ভাই সিদ্দিকুর রহমান খানের সাথে কথাও বলেছি। বড় ভাইয়ের জন্য তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাবিনি, সত্যি বলছি দূর কল্পনাতেও ভাবিনি কিছুক্ষণের মধ্যে মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুসংবাদ শুনতে হবে বা সইতে হবে। সত্যি বলছি, তার মৃত্যুসংবাদ শোনাটা এত বেদনার হবে, সেটাও বুঝিনি। ব্যক্তিগত পছন্দ বা সম্পর্কের বাইরে গিয়েও বলছি, মিজানুর রহমান খানের মৃত্যু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

করোনায় এপর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ১৭  লাখ এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এই তালিকায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সী মিজানুর রহমান খানের নামও ঢুকে যাবে ভাবিনি কখনো। গত ২ ডিসেম্বর মিজানুর রহমান খান করোনা আক্রান্ত হন। ৫ ডিসেম্বর তাকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১০ ডিসেম্বর তাকে মহাখালীর  ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। শনিবার বিকেলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। আর সোমবার সন্ধ্যায় তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য!

সাপ্তাহিক বিচিন্তা ও প্রিয় প্রজন্মের পর আমার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল বাংলাবাজিার পত্রিকা। বলা যায়, আমার পেশাদার সাংবাদিকতার শুরু। সৌভাগ্য মানি, পেশাদার সাংবাদিকতার শুরুর ক্ষণেই মিজানুর রহমান খানকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম। ৯৪ সালে সাংবাদিকদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে আমাদের ৬ জনকে ছাটাই করা হয়। বাংলাবাজার পত্রিকার দৃষ্টিতে ‘অপরাধ’টা ছিল আমার, কিন্তু চাকরি গিয়েছিল ৬ জনের। সেই তালিকায় ছিলেন মিজানুর রহমান খানও। বাংলাবাজার পত্রিকার দুর্ভাগ্য, তারা মিজানুর রহমান খানের মত রত্নকেও ছাটাই করেছিল। কিন্তু তাতে আটকে রাখা যায়নি মিজানুর রহমান খানকে। মেধা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা আর নিষ্ঠায় নিজেকে তুলে নিয়েছিলেন এক অনতিক্রম্য উচ্চতায়। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। কিন্তু প্রজ্ঞায় আর যোগ্যতায় ছিল যোজন যোজন ফারাক।

মিজানুর রহমান খান নিজেকে যেখানে তুলে নিয়েছিলেন, যেখানে তাকে ঈর্ষাই করা যায়, কিন্তু পৌছানো যায় না কখনো। ৫৩ বছর বয়সে তিনি যা করেছেন, কয়েক ৫০ বাঁচলেও আমরা তা পারবো না।

মৃত্যুর সময় তিনি প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু পদবী দিয়ে তাকে মাপাটা হবে মস্ত বড় এক বোকামি। মিজানুর রহমান খান নিজেকে এক ইনস্টিটিউশনে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে ইনস্টিটিউশন, সে ব্যাপারে ছিলেন বড্ড উদাসীন। আসলে তার মধ্যে ধ্যানী ঋষির ব্যাপার ছিল। শুধু মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতেন। সাংবাদিকতার নামে বা সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমরা অনেকে অনেক কিছু করি। কিন্তু আমার ধারণা এইসব ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি সারাক্ষণ পড়াশোনা করতেন অথবা ভাবতেন। হাঁটতে হাঁটতেও ভাবতেন মনে হয়। হঠাৎ কিছু জিজ্ঞাসা করলে চমকে যেতেন। তার মধ্যে একধরনের সারল্য ছিল। এখন বুঝি তিনি আসলে জ্ঞানের ধ্যান করতেন। আমরা আড়ালে-আবডালে তাকে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করেছি। কিন্তু তার ধ্যানমগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারিনি।

বাংলাদেশে আমরা চটজলদি সাংবাদিকতায় অভ্যস্থ। কিছু একটা হলো, আমরা চট করে একটা অবস্থান নিয়ে ফেললাম, না বুঝে লিখে ফেললাম। এটা হলো মাছরাঙ্গা সাংবাদিকতা, চট করে ছো মেরে মাছ ধরে বাহবা নিয়ে চলে যাওয়া। সবার সাংবাদিকতা যখন শেষ, তখন শুরু হতো মিজানুর রহমান খানের সত্য অনুসন্ধান। আমি আসলে বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে গর্ব করি, মিজানুর রহমান খান ছিলেন তাদের একজন। কারণ তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকেই অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়েছিলেন। আলো ফেলেছেন অনেক চাপা পড়া অধ্যায়ে। মার্কিন গোপন দলিল খুঁজে খুঁজে বের করে এনেছেন অনেক চমকে দেয়া সত্য।

মৃত্যুর পর জানলাম, মিজানুর রহমান খান পড়াশোনা করেছেন হিসাববিজ্ঞানে। একটু অবাকই হলাম, হিসাব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বরং পার্থিব লাভালাভ নিয়ে ভেবেছেন, এমন বদনাম কখনো শুনিনি। তার মাথাভর্তি ছিল আইন, সংবিধান, মানবাধিকার আর সবকিছুর উর্ধ্বে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। বিশেষ করে আইন ও সংবিধান নিয়ে তার পান্ডিত্য ছিল সত্যিই ইর্ষণীয়। শুধু জানা-বোঝা নয়, সেটা সঠিকভাবে বোধগম্য উপায়ে পাঠকের জন্য উপস্থাপন করতেন দারুণ মুন্সীয়ানায়। আদালতের কোনো জটিল বিষয় হলে আমি অপেক্ষা করতাম মিজানুর রহমান খানের লেখা বা বিশ্লেষণের জন্য। বেশি দেরি হলে ফোন করে জেনে নিতাম। একজন সাংবাদিকের মধ্যে যে গুনটি থাকা জরুরি, সেই সততা আর বস্তুনিষ্ঠতা ছিল তার সহজাত গুন। মিজানুর রহমান খান এসমন অনায়াসে সেটা অর্জন করেছেন, তিনি হয়তো বুঝতেই পারতেন না। তিনি সত্যটা লিখে ফেলতেন বা বলে ফেলতেন অবলীলায়। সত্য বলার যে ঝুঁকি আছে, সেটা হয় জানতেন না বা আমলে নিতেন না। সত্য বলার সাহস তার ছিল। আর এই সাহসের উৎস ছিল সততা। তার লেখা বা বলা কার পক্ষে বা বিপক্ষে গেল বা যাবে, সেটা বোধহয় তার বিবেচনায় থাকতো না। তাই তো বারবার বিরাগভাজন হয়েছেন আদালতের। কিন্তু পিছপা হননি কখনো। শুরুতেই বলেছি মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুতে দেশের সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত কেউ মারা গেলে এই কথাটাই বলি আমরা। আসলে প্রত্যেকটি মৃত্যুই অপূরণীয়। তবে মিজানুর রহমান খানের অভাব কোনোভাবেই পূরণ হবে না। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনোই আরেকজন মিজানুর রহমান খান পাবে না।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট