• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০২:০৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৫:৪৬ পিএম

নিকাহ নিবন্ধন ও নারীর অক্ষমতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

নিকাহ নিবন্ধন ও নারীর অক্ষমতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

বাংলাদেশের হাইকোর্টের সামনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে যে ভাস্কর্যটি রয়েছে সেটা নারীর অবয়ব। জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য। বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় ছিলো বলেই হয়তো ভাস্কর ভাস্কর্যের গায়ে শাড়ি চড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে নারীর জন্য বাস্তবতা আসলে কী? এই প্রশ্ন যখন করা হয়, তখন বিভিন্ন তর্কবিতর্কের ঝড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিড কাঁপতে থাকে।

বাংলাদেশে নারীর অবস্থান নিয়ে যখনই কোন আলোচনা হয়, সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়ে যায়। কিছু সংখ্যক মানুষ নারীজাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, কিছু সংখ্যক মানুষ শুধু নিজেদের পরিবারের নারীদের ছাড়া বাকি সকল নারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, কিছু সংখ্যক মানুষ নারীবাদীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, আবার কিছু সংখ্যক মানুষ পুরুষজাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। খুবই দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই বিদ্বেষের চর্চায় কেউ কোন সুস্পষ্ট সমাধানে পৌঁছায় না।

এই যে বিদ্বেষ এবং “নারী অবমাননা”র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চর্চা, এই চর্চাটিই যেন সমাজে বাস্তব পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীদের প্রতি বিদ্বেষ বা আক্রোশের একটা ভালো এবং বাস্তব উদাহরণ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। সেখানে নারী প্রসঙ্গে যেকোন আলোচনায় বিপুল পরিমাণে নারীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য দেখা যায়।

“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে” কাজী নজরুল ইসলামের এই উক্তি এখনো খুব বেদনাদায়কভাবে প্রাসঙ্গিক।

যেখানে আমরা সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল অনুযায়ী জেন্ডার ইকুয়েলিটির কথা বলছি, সেখানে আয়েশা সিদ্দীকা ৮ বছর ধরে লড়ে যাচ্ছেন তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্ত চাকরি এবং মর্যাদার জন্য।

মহামান্য হাইকোর্ট থেকে ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না নারীরা’ মর্মে একটি রায় এসেছে। সেই রায়ে উল্লেখ করা আছে যে একজন নারী প্রতিমাসে কিছুদিন শারীরিকভাবে অক্ষম থাকে। শারীরিকভাবে যে বিষয়টিকে অক্ষমতা বলা হলো, সেটা একজন সুস্থ নারীর প্রাকৃতিক নিয়মে হওয়া ঋতুস্রাব। এই ঋতুস্রাব যদি শারীরিক অক্ষমতা হয়, তবে এই দাবী প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়, কেননা এই প্রতিবন্ধকতা একজন নারী নিজের জন্য বাছাই করেন নি। এই ঋতুস্রাব তার শারীরিক গঠনেরই একটি অংশ। একে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা মানে, মানুষ হিসেবে নারীকে অপমান করা এবং তার মর্যাদায় আঘাত করা। এবং মানবাধিকার তখনই লঙ্ঘিত হয়, যখন একজন মানুষ তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

হাইকোর্টের সেই রায়ে এও বলা হয়েছে, “দেশের সামাজিক বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী” একজন নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না। এই রায়ে এই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয় এবং আদালত দ্বারা স্বীকৃত হয় যে, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা নারীবান্ধব নয়। অফিস আদালত বা বাইরের যেকোন কাজের ক্ষেত্রে, নারীর জন্য পরিবেশ বৈরী। নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন টয়লেট সুবিধা নেই। নারী সন্তানসম্ভবা হলে, এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ছাঁটাই করে দেয়, কারণ মাতৃকালীন ছুটির অধিকার তাকে দিতে হবে এবং বেতনও দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার নেই, নেই মাতৃদুগ্ধপান করানোর জন্য সুব্যবস্থা।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন ১৯৭৪ এর ১৪ নং ধারা অনুযায়ী আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট। সেই বিধিমালার ৮ নং অনুচ্ছেদে নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার জন্য প্রার্থীর যে যোগ্যতা সেখানে উল্লেখ করা আছে,

“কোন ব্যক্তি নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাইবার যোগ্য হইবেন না যদি না-

ক। তিনি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত কোন মাদ্রাসা হইতে আলীম সার্টিফিকেটধারী না হন;

খ। তাহার বয়স কমপক্ষে একুশ এবং অনূর্ধ্ব চল্লিশ বৎসর না হয়;

গ। তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা না হন। “

এখানে এই তথ্য পাওয়া যায় না যে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার নারী হতে পারবেন না, বা কোন নারী নিকাহ রেজিস্ট্রারের পদে আবেদন করতে পারবেন না।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন ১৯৭৪ সালের হলেও আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় ৩৫ বছর পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে। এর ঠিক তিন বছর পর  ২০১২ সালে আয়েশা সিদ্দিকা প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন। কিন্তু তাকে শুধুমাত্র অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, কেননা তিনি নারী।

প্রতিমাসে নারীর ঋতুস্রাবের জন্য একজন মুসলিম নারী তার ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা থেকে বিরত থাকেন, কিন্তু তারমানে কি এই যে তিনি মুসলিম থাকেন না?

নারীর ঋতুস্রাব হয়, তার মানে কি এই যে মাসের সেই কয়েকটা দিন সে আর মানুষ থাকে না?

মুসলিম বিবাহ দুজন মুসলিম নরনারীর ভেতরে একটি চুক্তি, যা তাদের যৌন জীবন এবং সন্তানের বৈধতা দান করে, তারা একজন আরেকজনের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হোন। মুসলিম বিয়ে পড়ানো ধর্মীয় একটি নিয়ম, কিন্তু মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রেশন একটা আইন দ্বারা বাধিত আনুষ্ঠানিকতা।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন এই দেশের সংবিধান। এবং সংবিধান প্রতিটি মানুষকে আইনের দৃষ্টিতে সমান হিসেবে দেখে। আর একটি রাষ্ট্রের আইন ও বিচার ব্যবস্থা চলে সেই দেশের সংবিধান অনুযায়ী।

সেই হিসেবে প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্র কী চায়? এই বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট নারীবান্ধব হয়ে উঠুক, না নারীবান্ধব নয় বলে নারীরা পিছিয়েই থাকুক? 

 

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী