• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৭:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৭:৪২ পিএম

উন্নয়ন আর দুর্নীতি একসাথে যায় না

উন্নয়ন আর দুর্নীতি একসাথে যায় না

ছুটির দিনটা সবাই পরিবারে সঙ্গে হালকা চালে একটু আয়েশ করে কাটাতে চায়। যারা কাটাতে চান, তারা দয়া করে শুক্রবার ছুটির দিনে পত্রিকা থেকে দূরে থাকবেন। আজকের ছুটির দিনে পত্রিকায় শুধু মন খারাপের খবর। দৈনিক প্রথম আলোর শীর্ষ সংবাদ, ‘বাংলাদেশী সাংসদের কুয়েতে কারাদণ্ড’। তার নিচেই আছে, ‘দুই ধাপ অবনতি বাংলাদেশের’। সবাই জানেন এটা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকের প্রতিবেদন।

এবার চলুন একটু পেছনের পাতায় যাই, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যা হচ্ছে’। এই রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর পরিদর্শন অভিজ্ঞতা থেকে। দুই মাসে আটটি জেলায় উন্নয়ন কাজ পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি যা দেখেছেন তা বিস্ময়কর কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়। কোথায় ভবন নির্মাণ শেষ না হতেই ভেঙ্গে পড়ছে দরজা। কোথাও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চুইয়ে পড়ছে পানি। কোথাও নিম্নমানের ইট দিয়ে বানানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ভবন। বিস্মিত সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, 'উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে একটি ধারণা মিলেছে যে কাজের গতি অত্যন্ত মন্থর। কোনো প্রকল্পেই কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের উপকরণ। যেখানে প্রকল্প নেয়া দরকার ছিল না, সেখানেও নাম ঢোকানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কাজগুলো খুবই নিম্নমানের। তবে কিছু কিছু জায়গায় ভালো কাজও চোখে পড়েছে। যেসব প্রকল্পে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে, সেসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের জানানো হয়েছে।’ যে তিনটি শিরোনামের কথা বললাম, তার মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পেলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটা গল্প বলে নেই।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শেষ দিকে মানে ’৮৯-’৯০ সালে আমাদের দিনের একটা বড় সময় কাটতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। কেন্দ্র তখন চার কুতুব—লুৎফর রহমান রিটন, আহমেদ মাযহার, আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানীর দখলে থাকত। যথারীতি কুতুব মিনার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। তখন থেকেই রিটন ভাই আমার প্রিয়। ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, ছড়াকার হিসেবেও লুৎফর রহমান রিটন আমার প্রিয়। তারচেয়ে বড় কথা তিনি আমার প্রিয় গদ্যকারও। বুকে বা ফেসবুকে, যখনই রিটন ভাইয়ের লেখা পাই আমি আটকে যাই। বৃহস্পতিবার ফেসবুকে নিজের এক অপারেশনের কথা বলতে গিয়ে ঘুরে এসেছেন অতীতের অনেক অলিগলি। সরস ও স্বাদু গদ্যে তিনি আমাদের টেনে নিয়ে নিয়েছেন নস্টালজিয়ায়। সেখানে রিটন ভাই আশির দশকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক পাঠচক্রে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের বক্তৃতার একটি লাইক চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল রিটন ভাইয়ের করোটিতে। আর রিটন ভাই সেটি গেঁথে দিলেন আমার মাথায়—অ্যাভ্রিথিং ইজ রিলেটেড টু অ্যাভ্রিথিং এল্‌স। এবার খুঁজে নিন সেই প্রশ্নের উত্তর, সবকিছুর সঙ্গে সবকিছুর কোনো না কোনো যোগসূত্র থাকেই। যে দেশের এমপি ঘুষ দেয়ার অভিযোগে আরেক দেশে দণ্ডপ্রাপ্ত; দুর্নীতি ধারণা সূচকে সেই দেশের অবনমন ঘটবে না তো কী ঘটবে? আর উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সচিব যা দেখেছেন, তাতে ধারণা সূচকে দ্বাদশ অবস্থান তো অনেক ভালো, আরো খারাপ হলেও অবিশ্বাস করার কিছু হতো না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে গতবছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। এবার দুই ধাপ পিছিয়ে নেমেছে বারোতে। তবে বাংলাদেশের স্কোর আগের দুই বছরের মতই আছে-২৬। তারপরও বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে, অন্য দুটি দেশের স্কোর ভালো হওয়ায় তারা টপকে গেছে, তাতেই বাংলাদেশ পিছলে গেছে। যারা অতি আশাবাদী, তারা বলতে পারেন, তালিকায় অবনমন হলেও স্কোর তো কমেনি, তারমানে দুর্নীতি বাড়েনি। এই আত্মপ্রসাদ একধরনের আত্মপ্রতারণাও। সবকিছুই যখন আগায়, তখন দুর্নীতির স্কোর না বাড়াও তো একধরনের অবনতিই। তালিকার নাম্বার আর স্কোর দিয়ে আসলে দুর্নীতি মাপা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ জানে দুর্নীতি কত প্রকার ও কী কী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সূচকটি একটি ধারণা সূচক। বাংলাদেশের দুর্নীতিও এখন সর্বব্যাপী ধারণা। আর বাংলাদেশে দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণাও পাল্টে গেছে। ঘুষ নিয়ে চাকরি দেয়া এখন বাংলাদেশে দুর্নীতি নয়। বরং যিনি ঘুষ নিয়ে চাকরি দেন, তাকে সবাই উপকারী মরে করে। দুর্নীতিবাজ হলেন তিনি, যিনি ঘুষ নিয়েও চাকরি দেন না, নেয়া ঘুষও ফেরত দেন না। বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রডের বদলে বাঁশ, সিমেন্টের বদলে বালুর খবর শুনলে একটু চমকাই বটে, কিন্তু নিম্নমানের উপকরণের ব্যবহারও গা সওয়া হয়ে গেছে। ঠিকাদারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। একটা কাজ পেতে পদে পদে পার্সেন্টেজ বিলি করে তার হাতে যা থাকে, তা দিয়ে কাজ শেষ করতে মান বিচারের সুযোগ থাকে না। মানসম্পন্ন উপকরণ দিতে গেলে তাকে নিজের জমি বিক্রি করতে হবে। পুরো ঘটনাই একটা চক্রের ফেসে গেছে। এই চক্র ভাঙতে না পারলে দুর্নীতির চক্কর থেকে বেরুনো যাবে না। নাম্বার আর স্কোরেই ঘুরপাক খেতে হবে।

২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। আর এখন দ্বাদশ। মনে হতে পারে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই তুলনায় কট্টর আওয়ামী লীগাররা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন, কিন্তু ২০০১ সালের বাংলাদেশের সাথে ২০২০ সালের বাংলাদেশের মধ্যে তুলনা করাটাই বিশাল পরাজয়। এই সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে হেঁটেছে রকেট গতিতে আর দুর্নীতি কমেছে কচ্ছপগতিতে। উন্নয়নের গতি বিবেচনায় দুর্নীতি কমেনি বরং বেড়েছে। অর্থপাচার বেড়েছে, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে লুটপাট হয়েছে, বড় প্রকল্প মানেই বড় দুর্নীতি। গত এক যুগে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অন্য মাত্রায় তুলে এনেছেন। কিন্তু দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে না পারলে উন্নয়ন অর্থবহ হবে না। রডের বদলে বাঁশ দিয়ে রাস্তা বানালে সে উন্নয়ন টেকসই হবে না। সময় এসেছে এখন উন্নয়নের কোয়ানটিটির সাথে সাথে কোয়ালিটি মাপারও।

দুর্নীতির তালিকায় নিচের দিকে থাকা দেশগুলো হলো: দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ভেনেজুয়েলা, সুদান, বিষুবীয় গিনি, লিবিয়া ইত্যাদি। এবারের ওপরের দেশগুলোর নাম শুনুন: ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ইত্যাদি। তার মানে দরিদ্র দেশে দুর্নীতি বেশি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে দুর্নীতির একটা বিরোধ আছে মনে হয়। তালিকা দেখলে মনে হয়, সমৃদ্ধি দরজায় এলে দুর্নীতি জানালা দিয়ে পালায়। কিন্তু এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সত্যি নয় কেন?

গত এক যুগে বাংলাদেশের অনেক উন্নতিই ছিল তাক লাগানোর মতো। নানান অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। মাথাপিছু আয় পৌঁছে দিয়েছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের দ্বারপ্রান্তে। করোনায় বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি যখন জবুথবু, তখনও বাংলাদেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। মাথাপিছু গড় জিডিপিতে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ভারতকেও। কিন্তু দুর্নীতির ধারণা সূচক এলেই কেন আমাদের মুখ লুকাতে হয়? কেন আমাদের নাম উচ্চারিত হয় আফগানিস্তান, সুদান, সিরিয়া আর সোমালিয়ার সাথে? আমরা উন্নয়ন, সমৃদ্ধি আর সক্ষমতার যে পর্যায়ে আছি; তাতে তো দুর্নীতি সূচকে আমাদের নাম থাকার কথা ডেনমার্ক, সুইডেন, সিঙ্গাপুরের সাথে!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তবে শুধু ঘোষণা হলে হবে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। মনে রাখতে হবে উন্নয়ন আর দুর্নীতি এক সাথে যায় না।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট