• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৭:৩২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৭:৩২ পিএম

চাপাতি নয়, জয় হোক আইন, মুক্তচিন্তা ও ভালোবাসার

চাপাতি নয়, জয় হোক আইন, মুক্তচিন্তা ও ভালোবাসার

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আদালত থেকে বেরুনোর পথে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিল কাদের মোল্লা। একে তো গুরু পাপে লঘুদণ্ড, তার উপর যুদ্ধাপরাধীর ঔদ্ধত্যে ফুঁসে উঠেছিল মানুষ। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা স্মার্ট ডিভাইস ছেড়ে নেমে এসেছিল মাঠে প্রতিবাদ জানাতে। শাহবাগে অবস্থান নেয় তারা। বিদ্রোহের সে আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। জন্ম হয় অসাধারণ এক আন্দোলনের—গণজাগরণ মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে গড়ে ওঠা সে আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ গণআন্দোলন। সমাজের সব বয়সের, সব শ্রেণী-পেশার, সব ধর্মের মানুষ দিনের পর দিন রাস্তায় কাটিয়ে দেয়।

সে আন্দোলনের বিপক্ষে কোনো জবাব ছিল না প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে। যুক্তির জবাব যে যুক্তি দিয়ে দিতে হয় সেটা তারা জানে না। জঙ্গীরা মাঠে নেমে পড়লো চাপাতি নিয়ে। আর হেফাজত মাঠে নামলো অপপ্রচার নিয়ে। হেফাজত খুব কৌশলে প্রচার করার চেষ্টা করলো, ব্লগার মানেই নাস্তিক। আর গণজাগরণ মঞ্চ মানেই নাস্তিকদের আন্দোলন। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ ছিল সত্যিকার অর্থেই সব মানুষের আন্দোলন। হেলাল হাফিজ যেমন তার বিখ্যাত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’তে লিখেছিলেন—মিছিলের সব হাত কন্ঠ পা এক নয়।/ সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে, কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার। কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার…,’ তেমনি গণজাগরণ মঞ্চের সব হাত, কণ্ঠ, পা এক ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাস্তিক থাকতেও পারে। কিন্তু জঙ্গীরা অঘোষিতভাবে আর হেফাজত ঘোষণা দিয়ে দিনের পর দিন গণজাগরণ মঞ্চের মত মহৎ আন্দোলনকে হেয় করেছে। সাধারণ মানুষের আবেগকে অপমান করেছে। তাদের মুখপাত্র ছিল মাহমুদুর রহমানের ‘আমার দেশ’।

আগেই বলেছি, যুক্তির জবাব তারা যুক্তি দিয়ে দিতে জানে না। তাদের মাথাভর্তি অন্ধকার আর হাতে চাপাতি। গোটা দেশকেই সেই অন্ধকারের দিকে টেনে নিতে চেয়েছিল তারা। গণজাগরণ মঞ্চ চলতে চলতেই ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের বাসায় খুন হন ব্লগার রাজিব হায়দার। পরের তিন বছরে জঙ্গিদের হাতে নিহত হন আরও আটজন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, অধিকারকর্মী ও নাট্যকর্মী। জঙ্গীদের টার্গেট খুব পরিষ্কার: মুক্তচিন্তা ও মুক্তমত। মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারকে তারা স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। মানুষের বিশ্বাস করা, না করার অধিকারকে তারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। অন্ধকারের জঙ্গীরা প্রশ্রয় পেয়েছিল প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তির।

২০১৩ সাল থেকে পরের তিনটি বছর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায়। ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ গড়তেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। সেই দেশে চাপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছিল গুপ্তঘাতক। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তচিন্তা, মুক্তমত আর ভিন্ন বিশ্বাস। প্রাণ বাঁচাতে অনেককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এখনও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হুঙ্কার দেয় বটে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে জঙ্গীবাদ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সেই খুনী জঙ্গীদের বিচার করার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার। বাংলাদেশ এখন সেই প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। রাজিব হায়দার হত্যা মামলায় দুই জঙ্গীর ফাঁসির রায় হয়েছিল আগেই। তিনদিনের ব্যবধানে আরো দুটি মামলার রায় এলো। ১০ ফেব্রুয়ারি ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় ৮ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে। আর ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিত রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড হলো আরো ৫ জঙ্গীর। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই রায়গুলো স্বস্তি এনেছে সাধারণ মানুষের মনে। একই রকমের আরো ৬টি হত্যা মামলার বিচার চলছে। যারা নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের সবাইকে একদিন ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে।

বাংলাদেশ একটি অসাধারণ রাষ্ট্র। ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম আর নয় মাসের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে। সংবিধানে রয়েছে: ৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে  (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।

জঙ্গীরা সাম্প্রদায়িক শক্তি, এরা সংবিধান মানতে চায় না, যুক্তি মানতে চায় না। এই রাষ্ট্রে মানুষের যে কোনো ধর্ম পালন করার, যে কোনো বিশ্বাস লালন করার অধিকার আছে। খালি দেখতে হবে, একজনের বিশ্বাস যেন আরেকজনের বিশ্বাসে অযৌক্তিকভাবে আঘাত না করে। একটি দেশ কখনোই একটি ধর্মের, একটি বিশ্বাসের, একটি বর্ণের, একটি গোত্রের মানুষের হতে পারে না। একটি সভ্য রাষ্ট্রে সব মানুষের মিশেল থাকে। অন্যের মতের সাথে আপনার নাও মিলতে পারে। কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আমি জীবন পর্যন্ত দিতে পারি। এই হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের মূল কথা। আমার যেমন বিশ্বাস করার অধিকার আছে, আপনার তেমন অবিশ্বাস করারও অধিকার আছে। স্বভাবতই আমি চাইবো সবাই আমার বিশ্বাসকে লালন করুক, কিন্তু আমি ভিন্নমতকে যুক্তি দিয়ে, ভালোবেসে জয় করবো, চাপাতি দিয়ে নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক