
তখনো তিনি ভীরু নব্বইয়ের অঙ্কে প্রবেশ করেননি। এক বাকি, উননব্বই। তাঁকে খুব করে চাইছিলাম একুশের দিনে, তিনি আসুন ‘সময় সংলাপে’। টেলিফোনে দাওয়াত করেছিলাম শঙ্কা নিয়ে, যদি না করে দেন! আজকাল অর্ধশতক ছোঁয়া মানুষেরাই কত যে কাহিল। সেখানে উননব্বই? বললেন, আপনি ডেকেছেন আসবই। একুশ আসতে দিন কয়েক বাকি। সেদিন শহর যেন তেতে উঠেছিল। বাংলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা। সেখানে অনেক ভিড় ছিল। আমার অনুষ্ঠানে ওনার বেলা একটায় যোগ দেওয়ার কথা। খবর রাখছি, সেখানে ভিড় ও তাপে সবার নাজেহাল অবস্থা। আমি আছি উননব্বইকে নিয়ে চিন্তায়। তিনি কাহিল হয়ে গেলে, আমার ইচ্ছে বুঝি এই একুশে পূরণ হবে না। দুশ্চিন্তায় যখন নিভে যাচ্ছি, এ সময়ই দপ করে চারদিক আলোকিত করে তুললেন তিনি, স্টুডিওতে হাজির আহমদ রফিক। ভাষাসংগ্রামী এই মানুষটা পাশে থাকলে আর কোনো বাতি জ্বলার প্রয়োজন হয় না। সেদিনের মতো স্টুডিওর বাতিকে আর কখনো এত নিষ্প্রভ মনে হয়নি।
আহমদ রফিক শুরু করলেন তাঁর আগুনঝরা কথা। যেন পলাশ ছড়িয়ে পড়ছে স্টুডিওজুড়ে। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ বায়ান্নর পর ছয় দশক পেরিয়েও আমরা হামিদুর রহমান এবং নভেরার করা মূল নকশার শহীদ মিনার তৈরি করতে পারলাম না। ডানাকাটা পরী দাঁড় করিয়ে রেখেছি। স্বাধীনতার পরও তৈরি হলো না মূল নকশার কাছাকাছি কোনো শহীদ মিনার। ‘শহীদ দিবস’ ধীরে ধীরে মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হলো না, এ নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণি ভুলে গেল, কারা স্বাধীনতা আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার অমৃত সুবিধাবাদী শ্রেণি আঁকড়ে রাখতেই জীবন ও জীবিকার ভাষা বাংলা রাখল না তারা। যার প্রভাব আমাদের শিক্ষাতেও রয়ে গেল। উপেক্ষিত হতে থাকল বাংলা।
সেদিন রবীন্দ্রনাথ নিয়েও কথা হলো। কিন্তু অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সম্পূর্ণতা পেতে এক বছরের প্রতীক্ষা। মাঝে ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। কুশল বিনিময়, বিভিন্ন আয়োজনের আশীর্বাদ প্রার্থনা। সবকিছুতেই না চাইতেই যেন সব পাওয়া হয়ে যায়। যেদিন তিনি নব্বইতে, সেদিন হাজির হলাম কেক, ফুল নিয়ে। সঙ্গে মাইক্রোফোনও। ওনার ইস্কাটনের বাড়িতে বসেই রের্কড করলাম বিশেষ সম্পাদকীয়। বললেন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অসম্পূর্ণ কথা। এক জীবন কীভাবে পার করলেন রবীন্দ্রনাথকে জানতে। বাঙালির কোনো যাপনেই রবীন্দ্রনাথকে দূরে রাখা যায় না। বললেন, তাঁর শৈশবের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শাহবাজপুর গ্রামের কথা। কৈশোরের নড়াইলের কথা। বললেন, কমিউনিস্ট পার্টির ফুলটাইমার হওয়ার কারণে চিকিৎসা পেশায় থাকা হলো না। বেছে নিলেন লেখালেখি। উদ্যোগ নিলেন ওষুধ কোম্পানির। কিন্তু নৈতিকতা বিসর্জন দেবেন না বলে সরে এলেন।
ধীরে ধীরে আহমদ রফিকের প্রতি আমার অধিকার, আবদার বাড়তে থাকে। কৈশোর তারুণ্যের বইমেলা, বই পাঠ আন্দোলনসহ সব কাজেই। তাঁর আশীর্বাদের আবদার । এভাবেই ২০১৯ সালে আবদার করে বসলাম, আপনাকে নিয়ে একুশ উপলক্ষে এক মিনিটের টেলিভিশন প্রমোশনাল বানাতে চাই। জানতে চাইলেন, কী করতে হবে? বললাম, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ কয়েকটি জায়গায় যেতে হবে। ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। তিনি আদুরে ধমক দিয়ে বললেন, কিছুতে ‘না’ করেছি আপনাকে কখনো? আমার চোখে সব পাওয়ার আনন্দজল। সেই বছরও প্রচণ্ড দাবদাহ। নব্বই পেরোনো তরুণকে পেশাদার মডেলই মনে হলো। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তার একাগ্রতা। কোনো বিরক্তি, অসুস্থতা বোধের চিহ্ন নেই মুখচিত্রে। লজ্জায় ডুবে যাই সহজ মানুষটিকে দেখে।
করোনাকালে তাঁর কাছে যাওয়া হয়নি। ফোনে খোঁজ নিয়েছি। যাইনি বলে অভিমান জন্মেছিল। বলেছি তাঁর সুরক্ষার কথা ভেবেই যাইনি। এর মধ্যে আমরা ভাবলাম পূর্বাচলে যে নতুন শহরটি হচ্ছে, সেখানে একটা শহীদ মিনার তৈরি করি। বন্ধুদের ছোটদের পত্রিকা ইকরিমিকরি উদ্যোগ নিল। সঙ্গে বর্ণ উৎসবও হবে। বর্ণ আঁকবেন নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা। সেই আয়োজন যখন তুঙ্গে, তখন মনে হলো তিরানব্বইয়ের সেই তরুণকে এবার চিত্রশিল্পী হতে বলি। ফোন করতেই কবুল। রং আর ক্যানভাস নিয়ে হাজির হলাম। রং ক্যানভাস নিয়ে যখন বসলেন, আমরা অবাক। মুহূর্তেই সহজ সেই মানুষটি চিত্রশিল্পী বনে গেলেন। আঁকলেন ‘অ’ এবং ‘ক’। লাল রঙে আঁকলেন। মনে হচ্ছে ক্যানভাসে ভাষাশহীদের রক্ত ঝরে পড়ছে বর্ণমালায়।
‘ক’ আঁকা শেষ করে মুখ তুলে চাইলেন শিল্পী আহমদ রফিক। বললেন, বাংলাকে জীবিকার ভাষা করতে হলে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। ঘটাতে হবে বিপ্লব। সেই বিপ্লবে অনেক মানুষকে সাথি করতে হবে। বাড়াতে হবে বঞ্চিতদের শক্তি। বললেন, মায়ের ভাষা ছাড়া কোনো সমৃদ্ধির মাইলফলকে পৌঁছা সম্ভব নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামনিস্ট